বারকোশ
সকাল থেকেই যমে মানুষে টানাটানি
চলছিল। দুপুরের
পরেই ডাক্তার স্যালাইন খুলে দিলেন। ‘কিছুই করার নেই আর’।
বম্মাকে বসার ঘরে শোয়ানো
হয়েছিল। এদিক থেকেই দেহ বার করা সহজ। কিন্তু বিকেল গিয়ে রাত ক্রমে গভীর হলো - বম্মা একইভাবে মুখ
খুলে, চোখ বুজে, প্রাণ আঁকড়ে রইলেন।
বম্মা মিমির বাবাদের জ্যাঠিমা।
মেজজ্যাঠার ফোন পেয়েই বাড়ি আসার
সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল মিমি। ওর বর চেঁচাচ্ছিলো, ‘তার তো হুঁশই নাই। এখন গিয়া কাম
কী? শ্রাদ্ধ ক্রিয়ায় একসাথে যামুনে’।
সারা বাড়িতে নিস্তব্ধতা যেন
ঝিঁঝিঁর পাখায় ঘুরছে। যে যার মত শুয়ে পড়েছে। বম্মাও কি ঘুমাচ্ছে? ভালো করে দেখে
মিমি। নাহ্
প্রাণ আছে। হঠাৎ মনে হল, কেউ যেন বলল, ‘বারকোশ’। চমকে উঠলো
মিমি।
বম্মার মাথার পাশেই মেজজ্যাঠা। গীতা পাঠ করতে করতে ঝিমুচ্ছেন। মিমি ঠেলে। অপ্রস্তুত জ্যাঠা মন্ত্র আওড়ান, ‘নৈনং
ছিন্দন্তি’, আর তখুনি মিমির মনে পড়ে যায় সব।
রথের মেলা থেকে তের বছরের মণিকুন্তলার
জন্যে চুড়িগুলো কিনেছিলেন ওর স্বামী মণীন্দ্রনাথ। শাশুড়ি বলেছিলেন ‘কাইল গুরুবার। স্নান সাইরা ঠাকুর সাক্ষী রাইখা পরাইয়ে দিমুনে। শাঁখা, লালচুড়ি,
আর নতুন সিন্দুর মা লক্ষ্মীর অনুমতি নিয়া পরলে চির-অক্ষয় থাকে।’
পরদিন ভোরে তড়িঘড়ি স্নান
সেরেছিল বালিকা। গরদের পাটভাঙা শাড়িও পরেছিল। কিন্তু শাশুড়ি মা আটকে গেলেন। রহিম
গাছী এসেছে। নারকেল গাছ সাফ হবে।
জমি নিয়ে একটা ঝামেলা মিটাতে
শহরে যেতে হচ্ছিলো মণীন্দ্রনাথকে। বেরোবার সময় পেছন ফিরে দেখেছিলেন এক ঝলক। চুড়ি হাতে
শাশুড়ির অপেক্ষায় বসে আছে বালিকা। মাথা নেড়েছিলেন মণীন্দ্রনাথ, সিদুঁর দেয়াটা
শিখলো না বউটা। সারা সিঁথি লেপ্টে আছে লালে।
সেদিন বালিকার প্রতীক্ষা যেন ফুরাচ্ছিল
না। রহিম গাছী নারকেল পাড়ছে তো পাড়ছেই। হঠাৎ বাইরে শোরগোল, বাবুদের গাড়ি উল্টেছে। কোন বাবু? খুড়িমা
ছুটলেন।
শাশুড়িমা ছুটলেন। ছুটলো অন্যরাও।
অতঃপর সন্ধে লাগার আগেই বালিকা শ্মশান
ঘাটে সিঁথি মুছে ফিরেছিল ঘরে।
ছোট মিমি জগৎসংসারের জটিলতা শেখেনি
তখনো, গল্পের সারও বোঝেনি। ‘চুড়িগুলান তুমারে পরায়ে দি বম্মা?’ বম্মা চোখ মুছে হেসেছিলেন, ‘চিতায় তুইলবার সুময়
দিবানে’।
সিন্দুকটা এখন কাকিমার ঘরের
এ্যান্টিক পিস। কিন্তু ভেতরের জিনিস? মিমির চেঁচামেচিতে বসার ঘরে ছুটে আসে সবাই। বম্মার মুখ খোলা। ‘আরে এহোনো শ্বাস আছে’, মা আশ্বাস দেন। মিমি ফোঁপায়, ‘বম্মার
বারকোশ’। সে তো জ্যাঠিমার দেরাজে।
মিমির খুশি ধরে না, আছে তবে।
চুড়িগুলো বম্মার হাতে ছুঁয়ে বলে
মিমি, ‘বম্মা তুমার চুড়ি’। ছোটকাকা পাশ থেকে নাড়ি দেখেন, ‘গেসে গা!’
অবাক কান্ড! বম্মার মুখ খোলা
নেই তো! ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি।
A wonderful saga that touches all hearts tenderly. The author is a gifted one.
উত্তরমুছুনTruly gifted short story writer, our Ranjana Bannerjee. Can't wait for her next gem
উত্তরমুছুন