মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




উচ্চতার/ মহত্ত্বের স্বীকৃতি






[সেই কবে কোন কালে আমি কিছু বাজে কবিতা লিখেছিলাম তা ছেপে দিয়ে, আর তার পর থেকে ওঁর পত্রিকার কথনবিশ্বঅংশে আমাকে ডেকে নিয়ে সেখানে আমি কী নিয়ে লিখবো তা নিয়ে কখনও কিছু না বলার ঋণে বেঁধে, কাজলবাবু (সেন) আমাকে সমস্যায়ও ফেলেন। আমি সেখানে যা প্রাণ চায় তা নিয়েই লিখি, সেখানেই বেশি লিখি, আর অনেকেই যাঁরা সেসব লেখা কখনও পা দিয়ে ছুঁয়ে না দেখেই লাইকান, আর ভাবেন যা খুশি লিখতে পারা এই লোকটি কী সুখী, তাঁরা কেউ আমার বিপদটা বোঝেনই না! বউ যদি বলেন কী খাবে? কী পরবে/পরবো আজ? (গা ম্যাজম্যাজ করছে) একটু পা টিপে দেবে? তবে তার সদর্থক বা নঞর্থক উত্তর দেওয়া সহজ। কিন্তু বউ (বা প্রেমিকা) যদি এই বয়সে পাশে এসে বসে’ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান, তবে এই বুড়ো কী উত্তর দেবে? যেখানে সিলেবাসই নেই! কথনবিশ্বে আমার বিষয় নির্বাচন কতকটা এই সিলেবাসহীন ওপেন টেস্টের মতো! এই ভূমিকাটুকু বাদ দিয়ে বাকি লেখা পড়লে বাধিত (মানে আদি সংস্কৃত অর্থে বাধাপ্রাপ্ত নয়) হবো। তবে যোগ করে পড়লেও আমার আপত্তি নাই!]

একটা লেখা ভেবে রেখেছিলাম, ‘আমার ধর্ম, ওনার ধর্ম’। এই বাজারে হয়তো খেতো (লিখবোও পরের কোনো সংখ্যায়)। কিন্তু বিপদ বাড়িয়ে দিলো এক অনড্বান, যে পকেটে চারটে অনিকেত আর পাঁচটা অস্থিরতা নিয়ে, ফেসবুকে কবিতার দোষ ধরে বেড়াচ্ছে! তাতে নাকি প্রত্যাশিত ঝাঁঝ নেই! এতো মহা মুশ্‌কিল। শর্ষের তেলের বিজ্ঞাপনে সৌমিত্রর, মমতাশঙ্করের (অপরাজিতা আঢ্যর কি আছে? মনে পড়ছে না!) সব বিখ্যাত নাকের ঝাঁঝে তৃপ্ত কুঞ্চন দেখে অস্থির! তার মধ্যে কবিতাতেও ঝাঁজ! আর স্বাধীনতার পরে সঞ্জাত প্রজন্মের  প্রাজ্ঞদের মধ্যে কে না জানে যে ভেজাল তেলে ঝাঁজ মানেই শিয়ালকাঁটার রাজ্যি! সুকান্তর ‘বোধন’ (‘আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই/ স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের/চিতা আমি তুলবই’), অথবা নজরুলের ‘বিদ্রোহী’-র পুরোটা, বা ‘আমার কৈফিয়ত’, বা ‘কুলি-মজুর’ বা পুরো নজরুলই আছে সে বাংলা কবিতার ভাঁড়ারে, ইতিহাসে, সেখানে আজকের নিরালম্ব, ঈথারীয়, নির্মেদ, নিরঞ্জন কবিতায় এরকম সৌমিত্রর, মমতাশঙ্করের (অপরাজিতা আঢ্যর কিনা মনে নেই) মতো তেলঝাঁজ খুঁজে ফেরার দরকার কী?

তো, এত কথা না বলে, আমার এক প্রিয়তম অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বন্ধু একটা শিয়ালকাঁটার না যোগেই অল্প ঝাঁজের, রিফাইন্‌ড কাচ্চিঘানি কবিতা দিয়ে জানতে চাইলেন তাতে প্রার্থিত ঝাঁজ আছে কিনা! ছেলেটি আবার স্বঘোষিতভাবে নাকি যত কবিতা লেখে তার চেয়ে নাকি বেশি পড়েঅধ্যাপকের ইচ্ছে ছিল ফেসবুকে এমন সন্নিষ্ঠ কবিতা পাঠকের সন্ধান পেয়ে একটু আলাপ জমানো। যুবক উত্তর দিলো অপ্রত্যাশিত কাঁচা খিস্তিতে, যেমত কবি, সংঘী, জঙ্গীদের কাছে বৃদ্ধদের প্রাপ্যতাতে আবার যারপরনাই ব্যথিত হয়ে অধ্যাপকবন্ধুর অনাত্মীয়, আত্মীয়, ছাত্র কেউ কেউ তাকে এমন জবাব  দিলেন যে সেই বিদ্রোহী যুবার অবস্থা হলো কতকটা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীরকবিতার ক্লাস বইতে স্বরবৃত্তকে মাত্রাবৃত্তে জোর করে ঢোকালে কী হয় সে বিষয়ে তাঁরই বানানো লাইনটার মত— ‘চার্জন হাড়্গিলে ছোক্রা ঘুর্বার বাতিকে,/ কাত্রাতে কাত্রাতে চল্লো হাত্রাসের দিকে’।

এরপর আবার অনেকে ফোনে বন্ধুর  ‘স্ট্যাচার’-এর (কে জানে কবে কতটা ছিল? বউয়ের শ্রদ্ধার মতো, সিনিয়র সরকারের ওয়াটার অব ইন্ডিয়ার মতো, আমাদের স্ট্যাচার প্রতিবার গেলে তবে জানা যায় কোনদিন ছিল! স্ট্যাচার ‘মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই’) কথা মনে রেখে এই সব  রাস্তার ছেলেদের সঙ্গে টক্করে না যেতে সবিনয় অনুরোধ জানালেন। কেউ বুঝলেনই না, আমার বন্ধুর বা আমাদের একটা মুশ্‌কিল আসান করবে কে? ‘পাবলিক  স্ফিয়ার’ এড়ানো বিখ্যাতদেরও উচিত নয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শোকসভা’ প্রবন্ধে সেই কবে বলে গেছেন! আর সব ঘরের ছেলেও কখনও রাস্তায় যায়, নইলে আমাদের সমাজে গত প্রজন্মে ‘রকবাজ’ আর অ্যাংলো স্যাক্সন বিদেশে ‘ইয়ংস্ট্রিট কর্নার গ্যাং’ হতো না (বিনয় ঘোষের এ বিষয়ে অসাধারণ প্রবন্ধ পড়ে নিতে পারেন)। উলটো পক্ষে রাস্তার ছেলেও কখনও ঘরে আসে। তাদের কর্পোরেট আইডির গলায় ঝোলানো অভিজ্ঞানও নেই, যে অনায়াসে পা টিপে এড়িয়ে যাওয়া যাবে! মেজাজ খারাপ হওয়ায় বন্ধু ডিপেন্ডেন্সি তত্ত্ব নিয়ে লিখতে বসে খান পাঁচ বই খুলে, দ্রব্যগুণের সাহায্যে তাতে যা কিছু প্রাথমিকভাবে জানার দরকার আছে ছশো পঞ্চাশ শব্দে ভরে দিয়ে ভোম হয়ে বসে আছেন, এমন সময় রাত্রে, সদ্য, এমনকি অদ্য পুরস্কারপ্রাপ্ত এক কবি ফ্রেন্ড রিকো পাঠিয়ে মনে একটু মলম দিলেন। আর কে না জানে মনে মলম ফেভিকুইকের বাবা!





বন্ধুর কাতরোক্তি শুনে কিছুকাল আগে ঈদের দু’এক আগের দিনে  ফেসবুকে  মিউজিয়ম রক্ষিত মুঘল পেন্টিং-এ  মুসলমানি পোশাকে নন্দরাজার সঙ্গে কৃষ্ণের চাঁদ দেখানোর এক ছবি ঈদের চাঁদের মতো দেখাছে কিনা বলে’ সম্প্রীতির ছবি হিসেবে পোস্ট করে সঙ্ঘীদের হাতে নাকাল হওয়া আমার মাথায় বন্ধুর প্রতি সমব্যথা থেকে মনে এলো নাম্না ‘উচ্চতার/মহত্ত্বের স্বীকৃতি’লেখাটি। আমরা মহৎ/উচ্চ নই, একান্ত  কিন্তু যাঁরা মহৎ/উচ্চ, মহত্তর/উচ্চতর আর মহত্তম, তাঁদেরও সমাজে চলতে ফিরতে হয় অন্য অনেক লোকের সঙ্গে, যাঁরা মহত্ততা জিনিসটা কী দিয়ে খায় না পেতে শোয় তাই জানেন না। তাঁদের সমিস্যে আছে। ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,/ তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে’,  ওকথা কবি দক্ষিণের বারান্দায় বসে’ যতই লিখুন, দিনকাল আলাদা। রুটি-রুজির, উৎপাদনের উপকরণের মালিকানার অর্থে গণতন্ত্র না আসুক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গণতন্ত্র  দিব্যি এসেছে। ফলে উচ্চসংস্কৃতির সঙ্গে গণসংস্কৃতির পার্থ্যক্যের সাহায্যে অভিজাত, মহৎ, ইতরসমাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বুঁচিয়ে, আলাদা করে রাখতে পারা অতীতের উচ্চসংস্কৃতিবানদের মতো আধুনিক উচ্চসংস্কৃতিবানরা আর নিস্তার পাবেন না! মনে করুন চার্লস-লুই দ্য সেকদাঁ ব্যারঁ দ্য লা ব্রেদে এত মঁতেস্কু-র মতো পাঠপরিস্থিতি অনুযায়ী গ্রিক আর রোম্যান পোশাক পরে’, পরিস্থিতি নির্দিষ্ট সুবাস মেখে প্লেটো-সিসেরোর সঙ্গে কথোপকথন (অর্থাৎ পাঠ)-এর দিনও আর নেই। কিম্বা মার্কুইস ভিলফ্রেডো ফ্রেদেরিকো দামাস্কো প্যারেটোর মতো দরিদ্র রুশ কন্যা পরে পত্নীশেফ-এর সঙ্গে পলাতকা হলে’ শেফিত পত্নীর অবর্তমানে সেলিগ্নিতে ভিলা কিনে, একা ঘরে ‘খোলসের মধ্যে শামুকের মতো’, বাছাই ভিন্টেজ মদ আর উৎকৃষ্ট সব ডিশ খেতে খেতে, সমজবিজ্ঞানীদের জন্যে এলিট তত্ত্ব, আর অর্থবিজ্ঞানীদের জন্যে ইনডিফারেন্স তথা প্যারেশিয়ান কার্ভ উপহার দেওয়ার দিন নেই।

নেই, কারণ সংস্কৃতির ধারণাই পালটে গেছে। এখন আগে যে ভাষার বাধা সামাজিক বাধার সঙ্গে যুক্ত হতো তাই নেই! সাতটা ভাষায় অবলীলায় লিখতেন পড়তেন প্যারেটো ল্যাটিন-গ্রিক-ফরাসি-ইংরিজি ভাষায় মঁতেস্কু বাকিরা পড়তো (পারলে) ওই মিটে কি আশায়। আমাদের দেশে সংস্কৃত, ফার্সি ছিল। সংস্কৃতর কথা বাদই দ্যান। সেটা Sheldon Pollock-এর কথায় 'pre-form of racism', আর জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডের ভাষায় ‘upper-caste racism’- এর জায়গা! সংস্কৃত না জানলে বেদ পড়তে পারবে না, বেদ পড়তে না পারলে শুদ্ধতা বা সংস্কার পাবে না, উচ্চবর্ণ না হলে সংস্কৃত পড়তে পারবে নাসুন্দর বন্দোবস্ত! ‘মোগল পাঠান হদ্দ হলো, ফার্সি পড়ে তাঁতি’-র ফার্সি ও নেহাত মন্দ ছিল না! সেসব গিয়ে ইংরিজি এলো তার আলগা আড়াল কিছুকাল ছিল। কিন্তু লোকশিক্ষক স্মার্টফোন, আর তার থেকে পাওয়া খেলা, ‘তবনল’ ইত্যাদির বদৌলতে ইংরিজিরও কিছু কিছু শিখে নিয়েছে আমজনতা। বাংলাও শিখেছে আগে উত্তম-সুচিত্রা-দেবদুলাল, পরে টেলিসিরিয়াল দেখেশুনে, তার অন্তহীন ভাবসম্প্রসারণ বাংলা শিখিয়েই ছাড়ে!

সংস্কৃতির ধারণাও পাল্টে গিয়ে আয়ত্তসাধ্য হয়ে উঠেছে। কেমন পাল্টেছে, তার একটা উদাহরণ দিই! এই যুগের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বোধহয় সব চেয়ে ভালো ব্যাখ্যাতাদের একজন টি. এস. এলিয়ট তাঁরNotes Towards the Definition of Culture (1948) বইতে সংস্কৃতির  সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বললেন, ‘a whole way of life’, যেটি ‘includes all the characteristic activities and interests of a people’এর উদাহরণ দিতে গিয়ে বললেন: ‘Derby Day, Henley Regatta, the twelfth of August, a cup final, the dog races, the pin table, the dart board, Wensleydale cheese, boiled cabbage cut into sections, beetroot in vinegar, nineteenth century Gothic churches and the music of Elgar’

কী মুশ্‌কিল! এতো সব্বাই দেখে জানে শোনে, পায়, খায়! তবে কি সবাই সংস্কৃত? তা হলে শেক্সপিয়ারের ‘twas caviar to the general’ (Hamlet) কথাটাই ভাষা থেকে উঠে যাবে? না, এলিয়ট সঙ্গে জুড়ে দিলেন—   
 
‘What is important is … to remember that we should not consider the upper levels as possessing more culture than the lower levels, but as representing a more conscious culture and a greater specialization of culture.

এটা না হলে নাকি গণতন্ত্রই বাঁচবে না! এলিয়ট বললেন, ‘I incline to believe that no true democracy can maintain itself unless it contains these levels of culture’ যাক্, তবু রক্ষে! নইলে এলিয়ট সাহেব যে Criterion নামের জার্নাল বার করলেন, যাকে ১৯৩৫ সালে জর্জ অরওয়েল বললেন ‘for pure snootiness it beats anything I have ever seen’, তার ব্যাখ্যা কী হবে! আমাদের একসময়ের এক্ষণ, পরিচয়, পরে বারোমাস, যোগসূত্র ইত্যাদির পাতা ওল্টালে এই Criterion-এর ধাঁচ কিছুটা বোঝা যাবে, সবটুকু নয়!





কিন্তু এতে করেই কি উচ্চসংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য আর তার মহৎ ধারকদের রক্ষা করা যাবে? এই উচ্চ মানবদের তো বাজারে যেতে হবে! এই বাজার অবশ্যি কোলে মার্কেট বা মানিকতলা বাজার, মানে মূর্তনির্দিষ্ট জিনিসের বেচাকেনার বাজার  নয়। এটা সেই প্রতীকী স্থান, যেখানে সব কিছু ‘cash nexus’-এ এক হয়ে গেছে, দাঁওতে চাপানো আছে তার কথা সুন্দর বলা আছে মহান্ প্রেমেন্দ্র মিত্রর গল্পে, সুকুমার দাশগুপ্তর পরিচালনায়, ১৯৬০ সালের ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ ছবিতে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায়, নচিকেতা ঘোষ-এর সুরে, ‘শহরে সবই বিকায়,/ এই লজ্জা, শরম, ইমান, ধরম/ বেচলে তারও দাম পাওয়া যায়,/ শহরে সবই বিকায়’ গানে। সেখানে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষও দ্রব্যমূল্যে বিচারিত। এই বাজার নিয়ে পরে কখনও কথা হবে। আপাততঃ গানের লিঙ্ক দিলাম, সৌজন্যে ইউটিউব — (https://youtu.be/sTJU9nsdskk)

কিন্তু কোলে মার্কেট নয়ই বা কেন? একসময় হাওড়ায় থাকার সূত্রে কদমতলা বাজারে, কালীপদ পাঠকের সঙ্গে পাশাপাশি বসে’, কানা পুলিবেগুনের মধ্যে থেকে ভালো বেগুন বাছতে গিয়ে, সেই সময়কার গুণ্ডা-কাম-রাজনৈতিকনেতা-কাম-ধনী ব্যক্তিকে দেখেছি কালীপদ পাঠককে ব্যঙ্গ তাচ্ছিল্য করতে। শরি মিয়াঁর টপ্পা থেকে নিধুবাবুর টপ্পা এক সময়ে বাংলার সাঙ্গীতিক সংস্কৃতি আচ্ছন্ন করা টপ্পার সেই প্রবাদপ্রতিম গায়ক কালী পাঠক, যাঁকে হেটা দিচ্ছে এক ভুঁইফোড় যে কালী পাঠকের নাম পর্যন্ত জানে না, জানে না যে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে ওঠার আগে ‘রবিবাবুর গান’-এর যুগে কালীপদ পাঠক টপ্পাঙ্গের রবিবাবুর গান তাঁকে নিজের গায়কীতে শুনিয়ে এসেছিলেন নিধুবাবুর তথা রামনিধি গুপ্তর কথায় ও সুরে পাঠকের একটি  গানের লিঙ্ক দিলাম, সৌজন্যে চঞ্চলের গানের বাগান!

কেউ বলতেই পারেন যে লেখা চলছিল উচ্চসংস্কৃতির মহৎ ধারকদের নিয়ে, সেখানে আমি Criterion থেকে কালী পাঠকে নেমে কী বলতে চাইছি! আসলে কথাটা অসংবেদী পাবলিক কালচারের স্থূল হস্তাবলেপে উচ্চতার হেনস্থা নিয়ে। কালী পাঠকও তো স্বক্ষেত্রে উচ্চ! আচ্ছা, পণ্ডিতিতেই ফিরে আসি!

এর জন্যে হয়তো রাসেল যাকে বলতেন বৌদ্ধিক ক্ষমতা, তার ধারকদের দোষ আছে। তাঁরা প্রগতিশীল বলেই— আর  পুরোহিত, পাদ্রী,  শ্রমণ, মৌলবি, ওঝা, ভুডু ডাক্তারদের মতো জ্ঞানের চারদিকে কুসংস্কার ও মোহ জড়িয়ে রাখতে চান নি বলেই— সাধারণ মানুষের সঙ্গে আহারে/বিহারে মিলেমিশে গিয়েছিলেনকিন্তু এই ‘disenchantment’ ছড়ানোর ফল হয়েছিল উল্টো। বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মণীষীরা ট্রামে বাসে ট্রেনে স্টিমারে সাধারণ মানুষের সঙ্গে চলাফেরায় সাধারণ মানুষের সব্বার তাঁদের সম্বন্ধে আলটপকা মন্তব্য করার অধিকার জন্মে গেল। আর গোপাল ভাঁড়ের গল্পে গোপালের তরফে খাটের পায়ার চারদিকে লাল শালু জড়িয়ে তাকে খট্টাঙ্গপুরাণ বলে চালানোর মতো, পুঁথিবাজ ভণ্ডরা বৌদ্ধিক ক্ষমতার ধারক হয়ে গেল। ভারতে স্বভাবতঃই অবস্থাটা অনেক বেশি খারাপ, কারণ এখানে ট্রাডিশন-এর আয়ত্ত অনেক বেশি। ব্যাপারটা রাসেল ধরেছিলেন ভালো। তাঁর Power: A New Social Analysis (1938,London; New York: Routledge Classics, 1996) নামের বিখ্যাত বইয়ে রাসেল লিখছেন

‘Thus it has come about that, while men of science are the fundamental cause of the features which distinguish our time from former ages, and have through their discoveries and influence an immeasurable influence upon the course of events, they have not, as individuals, as great a reputation for wisdom as may be enjoyed in India by a naked fakir or in Melanesia by a medicine man. The intellectuals, finding their prestige slipping from them as a result of their activities, become dissatisfied with the modern world. Those in whom the dissatisfaction is least take to communism; those in whom it is deeper shut themselves up in their ivory tower’ (p.31)





মানছি, আপনি উদাহরণের জন্যে ব্যাকুল হয়েছেন! আচ্ছা, ভাবুন তো, আমরা যে অমর্ত্য  সেনকে শ্রদ্ধা করি তা কি তিনি অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন বলে? হ্যাঁ বললেও আম জনতা বুঝবে কোথায়, কীভাবে তিনি কেনেথ অ্যারোকে  ঠিক/ভুল প্রমাণ করেছেন? সেও কি সম্ভব! রবীন্দ্রনাথ যে মহান সে কি তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন বলে? তাঁর ঠিক তেরো বছর পরে গ্রাৎসিয়া দেলেদ্দা (Grazia Deledda) সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন জানে সারা পৃথিবী? অমর্ত্য সেন বেঁচে আছেন দর্শনে, ইতিহাসে, রাষ্ট্রনীতিতে তাঁর অজস্র মৌলিক ধারণার জন্যে! ওরিয়েন্টালিজমের ত্রিস্বর নিয়ে তাঁর অশেষ ধারণার সাহায্যেই এই অধমও রুশ প্রাচ্যবাদ নিয়ে একটি আস্ত, যদিও বাজে বই লিখেছে! তাঁকে, সেই অমর্ত্য সেনকে গালাগাল দিচ্ছেন বহু সঙ্ঘী আর দিলীপ ঘোষ, যাঁর ‘transcendental individualism’-এর ধারণার সাহায্য নিয়ে ভারতে সিপিএম আর ভাজপার দলসর্বস্বতাকে অন্য লেন্সে ধরা যায়! বাঙালির সাংস্কৃতিক অভিভাবক শঙ্খ ঘোষ, তাঁকে গালাগাল দিচ্ছেন অনুব্রত মণ্ডল! এঁরা কে কোন দলের কী আসে গেল? এঁদের সাহস কীভাবে হয়? মানি, কবীর সুমন  গান বেঁধে বলেছেন, ‘অনুব্রত আপনি কেবল গাঁয়ের মানুষ, কিছুই নন’! তাতেই বা কী আসে গেল? ভাঙা বামিয়ান বুদ্ধ ফিরে এলো, বাঙালি আইসিস-এর ধ্বংসের পর? রাষ্ট্র খবর নিলো শঙ্খর মন, যা আমাদের সম্পদ, পুরোপুরি কবিতা লেখার মতো আছে কি না! না হলে তো জাতীয় ক্ষতি! 

বৌদ্ধিক মানুষরা কি তবে হয় সাম্যবাদে, নয় গজদন্তমিনারের নিঃসঙ্গতায় আশ্রয় নেবেন? ফেসবুক দূরস্থান, পাব্লিক প্লেস মাত্রই বর্জন করবেন? বুদ্ধদেব বসুর প্রথম যুগের কবিতার মতো বলবেন-

‘কহিবো হালকা কথা ---, বাজে কথা, তুমি বা বুঝিবে,
(নেহাৎ কহিতে হবে যদি)
সেদিনের থিয়েটার --- আমাদের পাড়ার খবর,
সব চেয়ে রূপসী কে আধুনিক সিনেমা-জগতে,
বব্‌ড চুল ভালো কিনা? আফ্রিকার জন্তু, আর ব্যাধি।’
                                             (বুব, ‘কোনো মেয়ের প্রতি’)

কিম্বা বুদ্ধদেব বসুর প্রথম ও শেষ উপন্যাসের হাইপার-রোম্যান্টিক নায়ক বিদ্যাপতি সিংহর মতো বলবে সামন্ততন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ছাড়া শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির হীনদশা ফেরার সম্ভাবনা নেই? নাকি, দেশের অবক্ষয়ে হতাশ বিষ্ণু দের মতো বলবে-

‘আমরা সম্রাট নই, বিলাতের বনেদী দুর্গতি
স্বপ্নেও কপালে নেই, এমনকি ফরাসীস মান্দারিন-মন্য সুখ ... ...
আলজীরিয় অবসাদে অস্তিত্বের কাকবিষ্ঠা খোঁজা,
তাও নিতান্ত অসার পাপপুণ্যহীন এই দেশে ...
           (‘স্মৃতি, সত্তা, ভবিষ্যৎ’, স্মৃতি, সত্তা, ভবিষ্যৎ)  

নাকি, এর একটু অন্য সমাধানও আছে? এলিয়ট দেখিয়ে গিয়েছেন যে গণতন্ত্রেও খেয়াল রাখতে হয় যে সংস্কৃতি পাবলিক বা সার্বজনিক হলেও তার ‘more conscious ... and … greater specialization’ উপরের স্তরের লোকদের হাতেই থাকে। তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কী হবে তা নির্দেশ করতে ইংলণ্ডীয় গণতন্ত্রের রক্ষণশীলতাবাদী অভিভাবক এডমান্ড বার্ক বলেছিলেন ‘deference’, আর বঙ্কিম বলেছিলেন ‘subordination’ বা বিনয়। সেখানে সংস্কৃতির প্রবীণ ধারকদের ‘গুহ্যপক্ক বৃদ্ধ’ বলা যায় না, যেরকম আমার বন্ধু, প্রাজ্ঞ সংস্কৃতিধারককে বলা হয়েছিল! ওনারাই যুগন্ধর, ছোট বড় মিলে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন