কুশারিবাগান ৬
সামনে চেয়ে এই যা দেখি
-------------------------
-------------------------
দক্ষিণ-পশ্চিমদিক দিয়ে সড়কপথে শান্তিনিকেতন যাওয়ার জন্য লোকে দুর্গাপুর থেকে জিটি রোড ধরে পানাগড় যাওয়ার পথে কাঁকসা মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে যায়। এই চোদ্দো নম্বর সড়কটি সটান উত্তরপূর্বে রামনাবাগান জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অজয় নদের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে। পূর্ব বর্ধমানের এককালের বিখ্যাত দুর্গাপুরের জঙ্গল এখন এইটুকুই টিকে আছে। বাংলাদেশের যতো সাবেকি ডাকাতের কিংবদন্তি এই শাল বনের সুদীর্ঘ রেঞ্জটি আশ্রয় করে একদিন গড়ে উঠেছিলো। তিরিশ বছর আগে যখন বাইকে চড়ে এ তল্লাটে যাওয়া-আসা ছিলো তখন এই জঙ্গলটি গৌরবে ছিল বহুব্রীহি। প্রায় মিনি সারান্ডার স্টেটাস রাখতো। এখনও রয়েছে অবশ্য। কিন্তু গাছগুলি মূলত: সামাজিক বনসৃজনের ফসল। প্রাচীন বনস্পতি সব চেরাইকলে রেস্ট ইন পীস। আমরা সিংভূমের লোক শালবনের ছায়ায় সেমত সুন্দর, যেমতি ‘সিপাইরা সুন্দর জেলে’।
জঙ্গলের শেষে পথটি পেরিয়ে যায় বর্ধমানের সীমানা, অজয় নদের সেতু। তার পরেই ইলামবাজারের তেমাথা। তেমাথার মোড় থেকে উত্তর-পশ্চিমদিকে রাস্তাটা চলে গেছে শ্রীপুর হয়ে হেতম পুর, দুবরাজপুর। আর পূবদিকের রাস্তাটা গেছে চৌপাহাড়ির জঙ্গল পেরিয়ে সটান সুরুল গ্রাম। উত্তরদিক থেকে আসা সিউড়ির রাস্তা এখানে এসে মিলেছে ভুবনডাঙ্গা জংশনে। রাঢ়বঙ্গের প্রামাণ্য ল্যান্ডস্কেপ যতো ছড়িয়ে আছে এই পথের দুধারে।
চোখে আমার বীণা বাজায়
-------------------------
সত্তর দশকের ঠিক পরে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতা ও অবমূল্যায়ন নিয়ে আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে চর্চাটি হতো, সেখানে পূর্বাগ্রহগুলি ছিল মেরুপ্রমাণ দূরত্বে। কলকাতার যে সব ছেলেরা আলিপুর, বহরমপুরের জেলহাজত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে বা আমাদের গ্রামের হাজারিবাগ জেলফেরত দাগি ছেলেপুলেদের রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ নিয়ে ভাবনাচিন্তায় ছিলো তীব্র দোলাচল। আমার স্বল্প পরিচিত একটি কলকাতা থেকে আগত তরুণ (যাকে কেউ কেউ ‘মিনি মাও’ বলতো, অন্যেরা বলতো যদুপুরের পাকা) নানারকম বৈপ্লবিক তত্ত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ব্যাখ্যা করতো। আমাদের ছোটো শহরের পরিপাকের পক্ষে সে জাতীয় কথাবার্তা ছিলো বেশ দুরূহ। সেসময় আমিও বড়োজোর বছর কুড়র। একদিন একটা আড্ডায় শুনি তার তত্ত্বকথা বেশ উচ্চস্বরে প্রচার করে চলেছে। বহুকাল পরে কিছুদিন আগে এক ‘প্রথিতযশা’ বাঙালি গায়কের একটি ঘোষণা শুনেছিলুম। নিজের গাওয়া একটি অতি নিম্নরুচির মিউজিক ভিডিওর শেষে তিনি ইংরিজিতে বলে উঠলেন definitely it is filthy, because it is political. ‘পলিটিক্যাল’ হতে গেলে যে ফিলদি হতে হয় সে শিক্ষা ‘মিনি মাও’ আমাদের দিয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন জনবিনিময়ে যখন আপাদমস্তক ‘পলিটিক্যাল’ আমি, কবিকে নিয়ে কিছু বলাবলি করতুম, ‘মিনি মাও’ নিশ্চিত সেখানে যেতো। সব কিছু শুনে বলতো, ইয়োর অ্যাপ্লিকেশন অফ মার্ক্স অন টেগোর ওয়াজ পারফেক্ট, বাট অ্যাট দি এন্ড অফ দি ডে, হি ওয়াজ ডেফিনিটলি ডেকাডেন্ট।
-------------------------
সত্তর দশকের ঠিক পরে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতা ও অবমূল্যায়ন নিয়ে আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে চর্চাটি হতো, সেখানে পূর্বাগ্রহগুলি ছিল মেরুপ্রমাণ দূরত্বে। কলকাতার যে সব ছেলেরা আলিপুর, বহরমপুরের জেলহাজত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে বা আমাদের গ্রামের হাজারিবাগ জেলফেরত দাগি ছেলেপুলেদের রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ নিয়ে ভাবনাচিন্তায় ছিলো তীব্র দোলাচল। আমার স্বল্প পরিচিত একটি কলকাতা থেকে আগত তরুণ (যাকে কেউ কেউ ‘মিনি মাও’ বলতো, অন্যেরা বলতো যদুপুরের পাকা) নানারকম বৈপ্লবিক তত্ত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ব্যাখ্যা করতো। আমাদের ছোটো শহরের পরিপাকের পক্ষে সে জাতীয় কথাবার্তা ছিলো বেশ দুরূহ। সেসময় আমিও বড়োজোর বছর কুড়র। একদিন একটা আড্ডায় শুনি তার তত্ত্বকথা বেশ উচ্চস্বরে প্রচার করে চলেছে। বহুকাল পরে কিছুদিন আগে এক ‘প্রথিতযশা’ বাঙালি গায়কের একটি ঘোষণা শুনেছিলুম। নিজের গাওয়া একটি অতি নিম্নরুচির মিউজিক ভিডিওর শেষে তিনি ইংরিজিতে বলে উঠলেন definitely it is filthy, because it is political. ‘পলিটিক্যাল’ হতে গেলে যে ফিলদি হতে হয় সে শিক্ষা ‘মিনি মাও’ আমাদের দিয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন জনবিনিময়ে যখন আপাদমস্তক ‘পলিটিক্যাল’ আমি, কবিকে নিয়ে কিছু বলাবলি করতুম, ‘মিনি মাও’ নিশ্চিত সেখানে যেতো। সব কিছু শুনে বলতো, ইয়োর অ্যাপ্লিকেশন অফ মার্ক্স অন টেগোর ওয়াজ পারফেক্ট, বাট অ্যাট দি এন্ড অফ দি ডে, হি ওয়াজ ডেফিনিটলি ডেকাডেন্ট।
একদিন আমাকে খুব সিরিয়সভাবে শুধালো, “সি, শেকভ ওয়াজ ফার মোর পাওয়ারফুল স্টোরি রাইটার, সো ওয়াজ টলস্টয় অ্যাজ আ নভেলিস্ট। হি ক্যান নেভার বিট শেকস্পিয়র অ্যাজ আ ড্রামাটিস্ট অ্যান্ড হি অ্যাজ আ পোয়েট, উড লুজ হিজ ক্রাউন টু টূ মেনি পিপল। হোয়াট ইউ পিপল ফাইন্ড সো স্পেশাল 'বাউট হিম?”
এত্তো ইংরিজি বলেও সে ঢাকতে পারে না তার ডাফ লেন, মোহনবাগান রো থেকে গড়িয়ে আসা অন্ধগলির চাপ। পাতি কলকাতার পুথিপড়া বাস্তব।
এই সব মানুষকে অনেক কথাই বলা যায়, আবার নিশ্চুপে উপভোগও করা যায় তার শিকড়হীন উদ্দীপনা। দ্বিতীয়টিকেই সঠিক ভেবেছিলুম তখন। এখনও তাই ভাবি। আরও ভাবি 'শান্তিনিকেতন'ও তো অনেকের কাছে 'ডেকাডেন্সের' একটি প্রকৃষ্ট নমুনা।
এত্তো ইংরিজি বলেও সে ঢাকতে পারে না তার ডাফ লেন, মোহনবাগান রো থেকে গড়িয়ে আসা অন্ধগলির চাপ। পাতি কলকাতার পুথিপড়া বাস্তব।
এই সব মানুষকে অনেক কথাই বলা যায়, আবার নিশ্চুপে উপভোগও করা যায় তার শিকড়হীন উদ্দীপনা। দ্বিতীয়টিকেই সঠিক ভেবেছিলুম তখন। এখনও তাই ভাবি। আরও ভাবি 'শান্তিনিকেতন'ও তো অনেকের কাছে 'ডেকাডেন্সের' একটি প্রকৃষ্ট নমুনা।
দ্বারকানাথের সাহেব সেক্রেটারি মনিবের বারম্বার সিদ্ধান্ত বদলানোর অভ্যেসে বড়ো বিড়ম্বিত থাকতেন। সেই বিখ্যাত "বাবু চেঞ্জেস হিজ মাইন্ড" উক্তিটি তাঁরই করা এবং তা নিয়ে কবিরও বেশ শ্লাঘা ছিলো। ইওরোপ যাত্রার জন্য জাঁকজমকের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে ফিরে আসা ও যাত্রা সম্পূর্ণ নাকচ করে দেওয়ার ঘটনা আমরা জানি। আরও জানি এ জাতীয় ঘটনা একবার নয়, বারবার ঘটেছে। গতানুগতিক স্থিতির স্বাচ্ছন্দ্য কবির একেবারে নাপসন্দ ছিলো। আরও অনেক ব্যাপারের মতো তাঁর বাসস্থান পরিবর্তনের নেশাও ছিলো কিংবদন্তিসুলভ। সুধীর কর মশায় লিখেছেন, একসময় দেহলি বাড়ি ছিলো তাঁর প্রিয় আস্তানা। ঐ বাড়ির দোতলার বারান্দায় বসে গ্রীষ্মকালের প্রবল তপ্ত হাওয়ায় তাঁর সৃজনশক্তি স্ফূরিত হতো। পরবর্তীকালে খ্যাতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে উত্তরায়ন প্রাঙ্গনের অট্টালিকাটি, উদয়ন, নির্মিত হয়। সেখানে কবি বেশ কিছুদিন বসবাস করেন। তারপর আরেকটু কোণায় গিয়ে কোণার্কবাড়ি। তাও পুরোনো হয়ে গেলো শ্যামলীবাড়ি তৈরি হবার পর। শ্যামলীবাড়িটির প্রতি তাঁর বেশ পক্ষপাত ছিলো শুনেছি। কিন্তু সে মাটির বাড়ি বৃষ্টির ধাক্কায় বিপজ্জনক হয়ে পড়লে 'পুনশ্চ'। নামেই পরিচয় এই বাড়িটি নির্মাণের উদ্দেশ্য। সে বাড়িও 'পুরনো' হয়ে যায় অচিরাৎ এবং শেষ পর্যন্ত তার পাশে ‘উদীচী’ বাড়ি। সেখান থেকেই তিনি কলকাতার পথে শেষযাত্রায় প্রয়াত হ'ন। এই বিরাটশিশুর ছেলেখেলার নমুনা হিসেবে এই নিত্য নতুন বাড়ির নেশা একটি উল্লেখ্য বিষয় হতেই পারে। শান্তিনিকেতনের পর্যটকেরা অবশ্য ছুটতে ছুটতে বাড়িগুলির দেওয়ালে প্রলম্বিত দীর্ঘ আলোকচিত্রগুলি দেখতেই ব্যস্ত থাকেন। এইসব বাড়িরই স্থাপত্য একটু মনোঃসংযোগ করে দেখতে হয়। সিমিট্রির মামুলি ফর্মুলাকে কীভাবে বিনির্মাণ করা যেতে পারে তার কিছু নিদর্শন পাওয়া যাবে এই আবাসভবনগুলিতে। ভাগ্যিস, বাবু চেঞ্জড হিজ মাইন্ড সো অফন।
-----------------------------------------------------------------------
তার ভালো নাম শ্রয়ণ, মানে আশ্রয়। সে আরেকটু জমকালো নামের প্রত্যাশী। তাই নিজে লেখে শ্রয়ণেন্দ্রনাথ। এই বিস্তারের পিছনে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নিজের বাড়ির নামকরণ ঐতিহ্যেরও কিছু ভূমিকা রয়েছে। তবে যে নামে সে ধন্য, তা হলো, চোটুরাম।
এই শৈশব পেরিয়ে বালকত্বের দিকে প্রায় এগিয়ে যাওয়া ছেলেটিকে দেখে আমার মনে হয়, তাঁর পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুদের ঠিক যেভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা কবি ভেবেছিলেন, তার প্রত্যক্ষ ছাপ আছে।। বুদ্ধিমান, কিন্তু প্রগলভ নয়; সংবেদনশীল, কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত নয়; স্নেহাকাঙ্ক্ষী, কিন্তু আত্মসর্বস্ব নয়। সে ছবি আঁকে, গান গায়, প্রচুর পড়ে, প্রচুর খেলে, প্রচুর কথাও বলে। কল্পনাপ্রবণ, নিজস্ব ধরনের যুক্তিধারার প্রতি বিশ্বস্ত এবং অর্গলহীন ছেলেমানুষ। কিছু তার বাবার থেকে পাওয়া 'ঈশ্বরচিন্তা' নিয়ে আমার সঙ্গে বেশ প্রত্যয় পরবশ হয়ে আলোচনা করে। তার মতে ঈশ্বর নেই, কারণ তিনি থাকলে তাঁর পূজার সময় প্রাণীবলি হতে দিতেন না। অন্তত: পাঁচশো বছরের কম বয়সী কোনও মন্দির স্থাপত্য তার মতে ‘নকল মন্দির’। তার জীবনের লক্ষ্য নানারকম। কখনও সে পুরাতত্ত্ববিভাগের কর্তা হতে চায়, কখনও রকেটবিজ্ঞানী। কখনও বা তার সাধ হয় শান্তিনিকেতনের গাইড হবে। এই সাধটি পূর্ণ করার জন্য সে শান্তিনিকেতনে আমার স্বনিযুক্ত গাইডের ভূমিকা নেয়। প্রখর রোদ ও গ্রীষ্মের মধ্যে সে তার ছোট্টো সাইকেলটি টেনে টেনে আমাদের প্রতিটি বাড়িঘর, গাছপাথর, ফুলের বাগান দেখিয়ে বেড়ায়। নিপুণভাবে দ্রষ্টব্য লক্ষ্যগুলির ইতিহাস-ভূগোল বর্ণনা করে। তার একমাত্র দাবি, তার বক্তব্য যথেষ্ট সিরিয়সভাবে শুনতে হবে। তার রৌদ্রক্লান্ত মামী সফরটি সংক্ষেপ করতে চাইলে সে বেশ ক্ষুব্ধ হয়। রথীন্দ্রনাথের জাদুঘরটি আজ খুলেছে। সেটি না দেখলে যে ঘোর অবিচার হবে সে কথা সে বিশদভাবে পেশ করে। শান্তিনিকেতনের অভ্যস্ত আশ্রমিক উচ্চারণ "আমাদের সব হতে আপন" তার চূড়ান্ত বক্তব্য। আমি যখন তাকে বলি, এখানকার লোকেরা খুব ন্যাকা হয়। সে প্রধূমিত ক্ষোভের উত্তাপে জর্জর হয়ে তার মা'কে অভিযোগ জানায়, শিবাজিমামা সুবিধের লোক নয়। ভীষণ আজে বাজে কথা বলে।
আমি ভাবতে ভালোবাসি, এই রকম শিশু, বালকেরা শান্তিনিকেতনে আরও রয়েছে। কিন্তু আজকের শান্তিনিকেতন কি তাদের ছায়া দিতে পারার এলেম রাখে?
এদের উপরেই তো দায়িত্ব, ‘কবি'কে বাঁচিয়ে রাখার।
‘যেখানে
সারা বিশ্ব নিজের ঘর খুঁজে পায়’। শান্তিনিকেতনের
আদি ট্যাগলাইন।
কিন্তু 'নিজের
ঘর' নামক ধারণাটি কি এখনও
১৯২৬ সালের মতো'ই রয়েছে? অবশ্যই
নয়। গত দু'দশকে তো আমূল বদলে গেছে 'নিজের' বাড়ির
হকিকৎ। যাঁরা সারা জীবন একটাই জায়গায় থেকে যান,
তাঁদের 'নিজের' ভাবার
মতো জলমাটির একটা স্থিরতা থাকে। কিন্তু যাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ক্রমাগত
আকাশ-মাটি বদলে চলেন,
তাঁদের নিজের 'জায়গা' বলে
তো কিছু হয়না। "পরের জায়গা,
পরের জমি, ঘর
বানাইয়া আমি রই/ আমি তো এ ঘরের মানুষ
নই।" আমরা তো সেরকম লোকজন। মনে হওয়া
স্বাভাবিক, আমাদের জন্য শান্তিনিকেতন কী আর
অধিক দিতে পারে? আমাদের 'দ্যাশ' তো
জগৎ জোড়া। মনে পড়ে যায় টানা স্মৃতির মন্তাজ। রাতের রেলগাড়ির জানালা থেকে মাটিতে
ছুটে যাওয়া আলোর চতুষ্কোণের মতো ঘাসমাটি,
জলপাথর ছুঁয়ে যাওয়া ছবি সব।
বারো-তেরো বছর বয়স হবে তখন। বাবার সঙ্গে শরৎকালে যাচ্ছিলুম আমাদের ‘দ্যাশের’ বাড়ি। থার্টি ডাউন নামক ট্রেনটি, এখন যার নাম কুর্লা এক্সপ্রেস, টাটানগর থেকে হাওড়া যেতে সব স্টেশনে দাঁড়াতো। প্যাসেঞ্জারের অধম। তখনও ‘গীতাঞ্জলি’ শুরুই হয়নি। ‘জ্ঞানেশ্বরী’, ‘আজাদ হিন্দ’, ‘দুরন্ত’ সব তখন স্বপ্নে। বম্বে যেতে আসতে টোয়েন্টি নাইন আপ বা রাতে বম্বে মেল। আমরা দিনের বেলা খড়গপুর যেতে গেলে থার্টি আপ ধরতুম টাটানগর থেকে। সকালবেলা 'ভাতেভাত' খেয়ে সেই যাত্রা। খড়গপুরে নেমে ধরতে হতো গোমো প্যাসেঞ্জার। বিকেল বিকেল পৌঁছে দিতো আমাদের দ্যাশের ইশটিশন।
ঠিক পুজোর আগে যাওয়া একবার। প্রতিবারের মতো। দাদু-দিদার সঙ্গে দিনদুয়েক দেখা করে আসা। মহালয়া থেকে ষষ্ঠীর মধ্যে। হলুদ রঙের কাঠের বেঞ্চি, পাটা পাতা। রেলকামরায় গদিটদি লোকে দেখেনি তখনও। সিংভূমের শাল-কেঁদ-বহড়ার বন ফুরোলেই খোলা জানালা দিয়ে নীল আকাশ, শাদা মেঘ, সবুজ থেকে সবুজে ভেসে যাওয়া দিকচক্রবালের অনিঃশেষ ধানের কচি ছোটোবেলা, কাশবনের অনন্ত সফেদ, টেলিগ্রাফে তারে ফিঙে আর অসম্ভব হাওয়ার দাপট। আশ্বিনের চরাচর উড়ে যেতো, যেন শিমুলের তুলো। মাঝে মাঝে ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়ে আছে। অপু আর দুর্গা। ধানখেত, কাশঝোপের আড়াল থেকে রেলগাড়ির ঝমঝম তাকিয়ে রয়েছে। বাতাসে অশ্রুত ঢাকের বাদ্যি আর লুকোনো ধুনোর গন্ধ। রেলগাড়ি ঝমঝম। রাঢ়বাংলার সজল নিমন্ত্রণ। কিছু টান। মিছু কি না জানিনা। কারণ তার নামটা জানিনি তখনও।
ঝাড়গ্রাম ইশটিশনে গাড়ি দাঁড়াতেই হুড়মুড় ভিড়। অবশ্য সব ইশটিশনেই তাই। হঠাৎ একজন সুদর্শন ভদ্রলোক দেখি বাবার নাম ধরে ডাকছেন। "কেমন আছেন সত্যেনবাবু?" বাবা বলেন,
আরে আসুন,
আসুন.... কোথায় চললেন? ভদ্রলোক চারজনের বেঞ্চিতে সপ্তমজন হয়ে বসলেন। "যাচ্ছি একটু কোলকাতা।" কথাবাত্তায় বুঝতে পারলুম তিনি আমার বড়ো পিসেমশায়ের ভাই। পেশায় শিক্ষক। তিনি দেশের বাড়িতে থাকেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা কলকাতায় পড়াশোনা করে। সে সূত্রেই তাঁকে যেতে হয়। একথা-সেকথার পর তিনি বাবা'র কাছে আমাদের গন্তব্য জানতে চাইলেন। উত্তর শুনে খুব সংক্ষেপে বললেন, " ওহ, বাড়ি যাচ্ছেন।"
শুনে আমার প্রতিক্রিয়াটি একটু ধন্দে। আমাদের বাড়ি তো জামশেদপুর। কেন তিনি বললেন, আমরা বাড়ি যাচ্ছি? সেখানে প্রাসাদের মতো ভদ্রাসন আছে একটা। শুধু দাদু-দিদা থাকেন সেখানে। বাবা'রা দশ ভাইবোন কেউই তো থাকেন না সেই বাড়িতে। দাদু'র সঙ্গে গল্প শুরু হলেই তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পৌত্রকে বলেন,
এটা তোমাদের বাড়ি। তোমরা এখানে এসে থাকবে,
যখন আমরা থাকবো না। তিনি জানতেন তাঁর ছেলেরা হয়তো এই মফস্সলে এসে থাকবেন না কখনও। তাঁরা সবাই খুব শহুরে লোক। মাঝেমধ্যে বেড়াতে নিশ্চয় আসবেন। ঐ বিশাল দোমহলা প্রাসাদ । সামনে পিছনে ছড়ানো বাগান। ঘরের সিলিং ষোলো ফুট উঁচু। দোতলার বারান্দা থেকে একটু দূরে সোজা দেখা যায় রেলট্র্যাক। খড়গপুর-আসানসোল লাইনের কতো ট্রেন ধোঁয়া উড়িয়ে, সিটি বাজিয়ে, সেখানে সারাদিন। চারদিকে খড়ের দোচালা, টিনছাদের পাশাপাশি দরমার বাড়ি। বাঁশবাগান আর আমকাঁঠালের অ্যাভেন্যু। সামনের কাঁচা পথটি চলে গেছে সোজা হাটতলা। বিশাল সব্জির হাট সেখানে। কাকাজ্যাঠারা যখন আসেন, স্রেফ সেই সবুজের সমারোহ দেখার জন্য বারবার একটা থলি হাতে যান সেই হাটে। একবার বেগুন, পরেরবার করলা। ওখানে লোকে বলে কল্লা। আশেপাশের পুকুর থেকে সদ্যো ধরা ছটপটে চুনো মাছ। সারি সারি জোয়াল নামানো গাড়ির পাশে বসে বলদেরা জাবর কাটছে। পাইকার আর চাষীদের ঝুড়ি নিয়ে দরাদরি। কোনোটাই বিরল ছবি নয় মফস্সলি বাংলায়। কিন্তু আমরা এসব ছবি দেখতে পাইনা জামশেদপুর বা কলকাতায়। দাদু তো ছিলেন বনেদি কলকাত্তাই। বিডন স্ট্রিট, নতুনবাজারের লোক পুরুষানুক্রমে। জামশেদপুরে ছিলেন কোম্পানির বড়ো সাহেব। তাঁদের থেকে উপহার পেয়েছিলেন বাড়ি বানানোর একটুকরো বসতজমি, শহরের কেন্দ্রে। কিন্তু সেই জমি দিয়ে দিয়েছিলেন এক বন্ধুকে। একটাই জেদ। সারাজীবন ‘বেহারে’
থাকলুম। এবার বাড়ি ফিরে যাবো। তিনি তো ফিরে গিয়েছিলেন। শেষ বয়সে চিকিৎসার জন্য প্রায়ই আসতে হতো জামশেদপুর। কিন্তু গত হয়েছিলেন 'নিজের বাড়ি'তেই।
তাঁর বড়ো পৌত্রের টাটার চাকরি পছন্দ ছিলোনা কোনোদিন। তাকে করতেও হলোনা সেই চাকরি। সরকারি মুলাজিম হয়ে ঊনচল্লিশ বছরে মোট সতেরোটা পোস্টিং সারা দেশে। দারাকন্যা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সর্বদা। কখনও অন্য সহকর্মীদের মতো 'ফ্যামিলি'কে একজায়গায় 'স্টেশন' করে নিজে
" আমি রবো পরিত্যক্ত বঞ্চিতের দলে" হয়ে জীবন কাটায়নি। কারণ আমাদের দেশে বলে
"কল কিসনে দেখা?" অর্থাৎ, আজকের দিনটিই
আমার জীবনের শেষদিন হতে পারে। তাই নো রিস্ক। মেয়েরা পড়াশোনা করেছে। বৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাপ-মা'র সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো তাদের স্মার্ট করেছে। বাবা'র মতো সাতঘাটের জল খেয়ে মানসিকভাবে পরিণত হতে পেরেছে। বাবা'র মতো'ই তাদের কোনও একটা বাড়ি নেই। সারা দেশই বাড়ি। তার বাবার কোনো জায়গায় বড়ো জোর বছর তিনেক হয়ে গেলেই আর থাকতে ভালো লাগেনা। ততোদিনে 'নতুন' জায়গার সব
রহস্যই জানা হয়ে গেছে। ‘বোর’ লাগাটা স্বাভাবিক। যেতে হবে নতুন কোথাও। নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন নিসর্গ, নতুন ঐতিহ্য। 'সব ঠাঁই মোর ঘর আছে',
গুরু'র এই কথাটা নিজের জীবনে অজান্তেই রূপ নিয়েছে এতোদিন ধরে। অনেক রকম ঘরে
থেকেছে সে সারাজীবন। সবই তো 'নিজের' বাড়িই লেগেছিল তার।
এই লোকটিকে শান্তিনিকেতন কী
দেবে?
বস্তুবাদী, বিষয়ী
সজ্জনদের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ। তাঁরা বলবেন, 'কিস্যু দেবেনা। এক্সট্রা টাকা থাকলে এখানে একটা ডুপ্লে কিনে
রেখে দিন। শহর ভালো না লাগলে কয়েকদিন এসে থেকে যাবেন। চাইকি, পর্যটকদের ভাড়া দেবেন । একজন কেয়ারটেকার রেখে দিলেই হবে।' কিন্তু এই লোকটার রক্তের দোষ আছে। বাপ-মায়ের থেকে পাওয়া।
সেও এই লালমাটির আধা গ্রাম, আধা মফস্সল
জায়গাটিকে শ্রয়ণ মনে করে। সারাদেশে তার এতো থাকার জায়গা। কিন্তু এ জায়গাটা তার
জন্য সব থেকে আলাদা। শুধু রবীন্দ্রভবন, পৌষমেলা, ছাতিমতলা, গৌরপ্রাঙ্গণ, কলাভবন নয়। আরও কিছু আছে। সে জানেনা, এই 'কিছু'র মানে ঠিক কী?
যে মোরে ফিরাবে অনাদরে, যে মোরে ডাকিবে কাছে?
সুরুলকুঠির পাশের মাঠে ছাতিমগাছের
ছায়ায় দাঁড়ানো সেই দীঘলকিশোরীটির মতো যেন। চঞ্চলচোখে কাউকে খুঁজে যাচ্ছে এদিকওদিক।
সেই ছবি অনেক রোদছায়া পেরিয়ে এখনও অমলিন।
দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে....
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন