বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮

ময়ূরিকা মুখোপাধ্যায়



টি-স্পুন


পান্তা ফোরানোর আগে নুনের খোঁজটা বেড়েই চলেছে। এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছি। টিউশনের পথে, ফর্মুলা-র সাথে, আলু পেঁয়াজের বাজারদর মুখস্ত চলছে, জোর কদমে।

“ও কলকাতায় যাচ্ছে না কেন? ওখানে তো কাজের সুযোগ অনেক”;
ওমনি, আমার বুকপকেট আমার কানে কানে এসে বলে যেত;
“যাব তো, যাদবপুর-প্রেসিডেন্সি, যে আমায় টানে...”
জোরে বলতে পারে না। ভয় পায়।
স্বপ্নে মাঝে মাঝে বাবা আসে, মা’কে কাছে ডাকে, মটরমালা হারটা যেই পড়াতে  যায়, ওমনি আমার ছায়া এসে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পুঁতিগুলো।
বাবার বিয়ের বোতামটাও বন্ধক রাখার আগে, লাগেজ ব্যাগটার ধুলো ঝেড়ে নিলাম।

ট্রাম টপকে, চলে এলাম...

“প্রেসিডেন্সির উল্টোদিকের গলিটা দিয়ে চলে যান”,
আমি কিন্তু... প্রেসিডেন্সির সামনেই থামতে চেয়েছিলাম।
মান্না দে খুব বাজত, আমাদের বাড়িতে। নিখিলেশ, প্যারিসে, মৈদুল ঢাকাতে...
এইরকম ভাবে, বোধহয় সাত জনের মত নাম আসত। কারণ, তার পরেই, সাতটা পেয়ালা বলে কিছু একটা লাইন থাকত।

স্কুলে বোধহয় আজ টাইট্রেশান-এর প্র্যাকটিকাল হবে। অরগ্যানিক কেমিস্ট্রির  চ্যাপটারও বোধহয় শুরু হওয়ার কথা...

“চা-কফি... কিছু বানাতে পারো?”
“না সেরকম...
“বুঝেছি। জামার মাপঝোপগুলো দিয়ে যেও। সোমবার থেকে  লেগে পড়ো”।

মাথায় পাগড়ীর মত জিনিসটা পড়ে বেশ মজাই লাগছিল। আর মা-এর কথা খুব মনে পড়ছিল।

“এই যে ভাইপো!”
“ওই টেবিলটার পাশে যাও। খালি হবে মনে হচ্ছে”।

দুটো ইনফিউশন্, একটা কোল্ডকফি উইথ ক্রিম, আর দুটো চিকেন গ্রেভি চাউমিন।
প্লেটের ওপর প্লেট চাপিয়ে, রোজকারের আড্ডা ডিঙিয়ে দিব্যি চলছে ব্যালেন্সের খেলা।
সুযোগ পেলেই, এককোণে দাঁড়িয়ে থাকাটা, কেমন নেশার মত চেপে বসছে।

পুরনো বন্ধু, হয়তো প্রথম লেখা গান, পুরনো কবিতা, হারিয়ে যাওয়া অ্যালবাম, সব সবকিছু এখানে মেলে। সব...
চোখটার আমার হাতেখড়ি, হচ্ছে, নতুন ভাবে।
কোনটা, প্রথমবার হাতের ওপর হাত রাখা। কোনটা শেষবারের মত কফি খাওয়া। পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোন শিবির দখলে রাখবে, এইসব রঙ ছিটকে লাগছে আমার সবুজ বর্ডারওলা সাদা জামার ওপর।
একদিন এক টেবিলের কাছে গিয়ে জানতে ইচ্ছে হল-
“আচ্ছা দাদা, তোমরা প্রেসিডেন্সিতে পড়ো?”
হ্যাঁ ভাই, এই তোরা, সিগারেট নিয়ে এত নাটকবাজি করিস না। বেচারা ভেবেছে, স্কুল-ফুলে পড়ি!”

“আরে বাবু, টিপস্‌টা নিয়ে যা”।
“না, না, এটা তো আপনাদেরই ফেরত...”

প্রিয় রং বদলে যেতে থাকে ক্রমশ। দুধ-সাদা বাদামীর মাঝে, ভুল প্রমাণিত হতে থাকে, ছোটবেলার ব্যাকরণ।
ক্লীব লিঙ্গ : পুরুষবাচকও নয়, স্ত্রীবাচকও নয়, এমন লিঙ্গ, স্ত্রী-পুরুষভিন্ন লিঙ্গ। সাধরণত জড়বস্তু অর্থাৎ যাদের প্রাণ নেই। উদাঃ টেবিল, চেয়ার।
মিথ্যে, সব মিথ্যে।
শুধু এইটা যদি একবার সত্যি হত
একটা টেবিলে চারটে চেয়ার টেনে এনে আমি-মা-বাবা-দাদা বসতাম! বিয়ের  সোনার বোতামটা পড়ে, মা-এর মটরমালা হারটার দিকে তাকিয়, প্লেটে ঢেলে বাবা কফি খেত।
আমি দেখতাম। শুধু দেখতাম।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন