রবিবার, ১ জুলাই, ২০১৮

সুবীর সরকার




উত্তরকথা




(৪৬)


এত এত হাট। চারপাশে ছড়ানো। যেন হাটের ভুগোল পরিধিতে হাটগঞ্জ হয়েই মিশে যাওয়া। উত্তরের অনাবিল সব ধুলোমাখা মানুষের যাপনের কী যেন মাদকভরা এক গন্ধ আছে, যার টান চুম্বকের মতন! নাসিরুদ্দিন ব্যাপারী গজেন বর্মণ বান্ধে ওরাও হীরামতি নার্জিনারী আব্রাহাম রাভা সব কেমন মিলেমিশে এক মহাসম্মেলনের ধরতাইটা পোক্ত করে ফেলে। আর ভাঙ্গা হাটের ভিতর আপনমনে চলতে থাকে বুঝি আত্মপরিচয়ের শেকড় খোঁজার আপ্রাণ প্রয়াস! আর তপ্ত দুপুরে, হাটের জামাত থেকে কারা যেন গুনগুন গাইতে থাকে গান –

 ‘ওরে হাটের মধ্যে শামুকতলা
 হালুয়া গরুর নাগছে মেলা
 ছেউটি গরুর ওরে নেখায় জোকায় নাই
 মেচ গারো সাঁওতাল
 নাগেয়া দিল কাউটাল
 এগিলা কথা মোটেও বোঝে না’

এভাবেই তো কালখন্ডগুলিকে কালানুক্রমের ভেতরে কেবল ঢুকে পড়তে হয়। অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে কি? নদী টপকে চলে যাওয়া থাকে কি?





(৪৭)


উত্তরকথা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আসলে শেষ বলে কিছু হয় না। গল্প কখনো ফুরোয় না। সমাপ্তি থেকে আবার জেগে ওঠে। এটাই আবহমানের ইতিহাস। তো আমরা দেখি, রাধাকান্ত ও কইকান্ত হন্তদন্ত মরিচহাটির দিকে হেটে যাচ্ছে। আকাশের মেঘ থরে থরে সাজানো এক বিভ্রম মেলে দিয়ে তাদের বুঝি গোপন এক ভুলভুলাইয়ার ফাঁদে ফেলে দিতে চাইছে। কোথাও হরিবাড়ী থাকে। কীর্তনের আসরে মনোশিক্ষার গানে গানে জীবন ভরিয়ে নেয়ার অবকাশ থাকে। জীবনের ফাঁকে ফাঁকে জীবনকেই জীবন যাপনের ব্যাপ্ততায় লীন করে দেয়াই বুঝি বা। এখানেই তো মানুষের জয়! মানুষ তো বুঝতে পারে, শেষাবোধি –

 ‘একবার হরি বল মন রসনা
 মানব দেহাটার গইরব কৈর না
 মানব দেহা ভাই মাটির ভান্ড
 পড়িলে হবে রে খন্ড খন্ড
 ভাঙ্গিলে দেহা আর জোড়া নেবে না’

রাধাকান্ত আর কইকান্তর চোখে জলের ধারা। কোথায় পড়ে থাকে টাকাপয়সা! ধান-পাট-তামাকের হিসাবকিতাব। তার পরস্পরকে আমূল জড়িয়ে ধরে আর কান্নার দমকে দমকে কাঁপতে থাকে। আর গানবাড়ির থেকে রাতের কালোর দিকে ছুটে চলে গান –

‘দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙ্গিলা দালানের মাটি
 ও গোসাইজি, কোন রঙ্গে’...

দিনের পিঠে দিন যায়। শীতের জেগে ওঠা নদীর বিশাল সব চরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ময়নামতী কত রকমের পাখি দেখে। ফড়িংএর পিছে পিছে, প্রজাপতির পাখনায় চলকে যাওয়া সোনা রোদের বাহার দ্যাখে। ময়নার জীবন জুড়ে চারপাশের এই ব্যাপ্ততা এক ধরনের শূন্যতা এনে দেয়। সে বুঝি বিষাদময়য় মেঘরোদের এক বহতা জীবনকে নিজের সমস্তটুকুর ভেতর তীব্র ভাবে প্রবেশ করাতে থাকে। আর তার শরীরের খুব গোপন থেকে জেগে উঠতে থাকে কেমন এক বুক খালি করে দেওয়া গান –

‘তোমরা যাইবেন অংপুর মইষাল ও
ও মইষাল কিনিয়া রে আনিবেন কি
ও কি বাচ্চা বাপইর নাল বটুয়া
মোরও দাঁতের মিশি মইষাল ও’

গানের ভিতর রংপুর। কোথায় পড়ে থাকছে সেই রংপুর। এত এত দূরে থেকেও ময়নামতি তো গাইতে পারে, নাচতে পারে সেই রংপুরের গানের দোলায় দোলায় ভেসেও যেতে পারে হয়তো বা! সে কি তবে তার মাও সোমেশ্বরীর আন্ধনঘরের দিকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে গেয়েই ফেলে –

‘ও রে অংপুরত হামার বাড়ি
যুবা বয়সের মুই চেংড়ী
কি দেখেন মোর
মুখের ভিতি চায়া’

এতসব ঘটে।ঘটতে থাকে। আর ময়নার চোখের সামনে ভাসতে থাকে রঙ্গরসে ভরা সেই এক মস্ত শহর রংপুর।




(৪৮)


জীবন অনন্ত। জীবন বহমান। নদী-মেঘ-হাওয়া-গান-নাচের বহুস্বরিক ক্যানভাসে সব আঁকা থাকে। সোমেশ্বরীর পাকঘর থেকে মুসুরির ডালের গন্ধ আর প্রাচীনা আবোর মজা গুয়ার মিশ্রণে উত্তরের বিলপুকুরের হাঁসগুলি তাদের চলাচলের ভেতর দিয়ে আবহমানের সব গল্প-কথকথতাগুলিকেই হাহাকারের মতন সাজিয়ে দিতে থাকে, সাজিয়ে দিতে থাকে এক ধরনের বাধ্যতাই হয়তো উত্তরকথার খুব খুব ভেতরেই। তখন খুব মনে পড়ে যায়, জলে গা ডোবানো সারি সারি মহিষদের কথা, মইষাল বন্ধুর গানের কথা –

‘মইষ চড়ান মোর মইষাল বন্ধুরে
কোন বা চরের মাঝে
এল্যা কেনে তোর ঘান্টির বাইজন
না শোনং মুই কানে’

তখন উত্তরের হাওয়ায় হাওয়ায় নুতন করেই বুঝি উত্তরকথা রচিত হতে থাকে।













কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন