ঘুড়ি
ধারণা
করা হয় যে, প্রায় ২৮০০ বছর পূর্বে চীন দেশে সর্বপ্রথম ঘুড়ির উৎপত্তি ঘটেছে। পরবর্তীকালে এটি এশিয়ার অন্যান্য দেশ - বাংলাদেশ, ভারত, জাপান এবং কোরিয়ায়
ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও, ইউরোপে ঘুড়ি খেলাটির প্রচলন ঘটে প্রায় ১৬০০ বছর পূর্বে। প্রথমদিকে ঘুড়ি কাগজ হাল্কা অথবা তন্তুজাতীয় সিল্কের
কাপড় দিয়ে ওড়ানো হত। ব্যবহৃত
অন্যান্য উপাদানের অংশ হিসেবে ঘুড়িতে বাঁশের কঞ্চি কিংবা অন্যান্য শক্ত অথচ নমনীয়
কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয়। এছাড়াও
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সুতো কিংবা পাতলা দড়ি ব্যবহৃত হত। ঘুড়িকে
উড়ন্ত জাহাজ বলা যায়৷ লাল, নীল, হলুদ
বাহারি রঙে ভেসে ওঠে মনের ক্যানভাস৷ অতীতে জমিদার বাড়ির নারী, পুরুষরাও ঘুড়ি ওড়াতেন৷ ঘুড়ি প্রতিযোগিতা ছিল সে সময়ে বিনোদনের এক উল্লেখযোগ্য
মাধ্যম। ঘুড়ি বানানোতে মেয়েরা হাত দিতেন৷
ঘুড়ি ও লাটাই দুটির মধ্যে চলত অসম প্রতিযোগিতা।
ঘুড়ির
প্রধান উপকরণ মাঞ্জা। ঘুড়ি
ওড়াবার জন্য যে সুতো ব্যবহার করা হয় তাকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী করানো হয়। আর এই মাঞ্জা দেওয়ার মধ্যে লুকিয়ে
থাকে শৈশব, যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের উন্মাদনা। এক ঘুড়ি অন্য ঘুড়ির সুতো কাটার উদ্দেশ্যে
কাচের গুঁড়ো, আঠা ইত্যাদি মিশ্রিত বিশেষ মশলা যা সুতায় মাখিয়ে
রোদে শুকানো হয়। সেই
শুকনো সুতোকে মাঞ্জা বলা হয়৷ ঘুড়ির কাগজ সাধারণত বেশ পাতলা হয়৷ যাতে ঘুড়ি হয় হালকা
এবং বাতাসে ভাসার উপযোগী। অনেক
দেশেই ঘুড়ি বানানোর জন্য সাদা কাগজের পাশাপাশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রঙিন কাগজ ব্যবহারের
রীতি দেখা যায়, এবং এর মূল কারণ মনোরঞ্জন ও সৌন্দর্য্যবৃদ্ধি। ঘুড়িকে আকর্ষণীয় করে তোলাই মুখ্য উদ্দেশ্য ৷ ঘুড়ির
মধ্যে হরেক রকমের কাগজ জড়িয়ে বিভিন্ন আকৃতিতে বানানো হয় পেটকাটি, চাঁদিয়াল ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ বিভিন্ন দেশে ঘুড়ির বিভিন্ন রকম নামকরণ করা হয়ে
থাকে। যেমন বাংলাদেশের
ঘুড়ির নাম চারকোণা আকৃতির বাংলা ঘুড়ি, ড্রাগন, বক্স, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন, অক্টোপাস, সাপ, ব্যাঙ, মৌচাক, কামরাঙা,
আগুন পাখি, প্যাঁচা, ফিনিক্স, জেমিনি,
চরকি লেজ, পালতোলা জাহাজ, জাতীয় পতাকা প্রমুখ। আধুনিককালের
ঘুড়িগুলোয় সিনথেটিকজাতীয় পদার্থের হয়ে থাকে । বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি বিশ্বের
বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। কোনটি
আকারে খুব বড় ও কোনটি মাঝারি আবার কোনটি আকারে খুবই ছোট যা দ্রুত উড়তে কিংবা প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত ব্রিষ্টল ঘুড়ি উৎসব শেষে সবচেয়ে
বড় ঘুড়িটি প্রায় ২০ মিনিট আকাশে উড়তে দেখা যায় । এটি ভূমির প্রায় ১০৯৭১ বর্গফুট জায়গা
দখল করেছিল।
ঘুড়িকে
বিভিন্ন বর্ণের মানুষরা শুভ বলে মনে করে ৷ পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি
সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। বাংলা
পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই
দিন বাঙালিরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন
করে খাকে। তার মধ্যে পিঠে
খাওয়া,
ঘুড়ি ওড়ানো অন্যতম। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানোর পরে সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে ফানুস
উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি করে। বীরভূমের
কেন্দুলী গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা হয় । এছাড়া কার্ত্তিক পুজোতে ঘুড়ি ওড়ানোর একটা প্রচলন আছে
। নবীন প্রজন্ম ওই দিন ঘুড়ি উড়িয়ে আসন্ন শারদৎসবের সূচনা
করে বলে মনে করা হয়৷ ঘুড়িকে কেন্দ্র করে রাজস্থানীদের মধ্যে উন্ম্মাদনা দেখা যায়। Kite
festival বা ঘুড়িউৎসব পালন করে রাজস্থানের মানুষ। বহু মানুষ বিভিন্ন রঙের ঘুড়ি বানিয়ে
এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকে৷
"The
scene which the light brings before our eyes is inexpressively great, but our
seeing has not been as great as the scene presented to us; we have not fully
seen! We have seen mere happenings, but not the deeper truth which is
measureless joy”—Rabindranath
আমাদের
দৃষ্টি সত্যিই হারিয়ে যাচ্ছে ৷ তেমনই হারিয়ে
যাচ্ছে সংস্কৃতি ৷ আমরা দেখতে ভুলে যাচ্ছি। কেন! একটি বিষয়কে
ভিন্নরূপে দেখার জন্য চোখের দরকার পরে না, যেটা লাগে সেটা ‘দৃষ্টি’ ৷ আমাদের দেখার
অনুভূতিগুলো যেন হারিয়ে যাচ্ছে ৷ প্রেম,
বিরহ , বিচ্ছেদ, অবসন্নতা
সব বিষয়গুলো আমাদের যাপনের সাথে ভীষণ ভাবে বর্তমান । কিন্তু তাকে দেখার আঙ্গিকটা বদলে গেছে
৷ বদলে যাচ্ছে ঋতু ৷ বদলাচ্ছে বন্ধন । এখন
তেমন ভাবে নীল আকাশে আর ঘুড়ির আনাগোনা দেখা যায় না ৷
আমাদের
দু’চোখে এখন রক্তের দাগ কিংবা হলদে ইতিহাসের দাগ। সবুজ বা সতেজতা দেখতে আমরা ভুলে গেছি। বিষণ্ণতার রঙ কী? কিংবা অনুভূতিকে কেমন দেখতে এই নিয়ে আমরা আদৌ ভাবি কি? রূপকথার গল্পের চরিত্রগুলো
কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে ৷ যেমন একটা বীজ থেকে
গাছ বড় হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু কখনও সেটা বড় হয় আমাদের দৃষ্টি'র গোচরে, কখনও দৃষ্টির অগোচরে ৷ যে গাছটি আমাদের বাগানে সংরক্ষিত তাতে, পোকার সংক্রমণ
লাগলে কিংবা গাছটিতে সারের প্রয়োজন হলে আমরা বুঝতে পারি ৷ কিন্তু এমন অনেক গাছ আছে
যেগুলো রেললাইনের আশেপাশে বা বাড়ির আবর্জনায় বেড়ে ওঠে, তাদের দিকে আমরা ফিরে তাকাই
না ৷ কিন্তু কেন? যেন অদ্ভুত ভাবে অনাদরে বেড়ে ওঠাটাই ওদের নিয়তি
৷ আলোচনার শেষে এই বিষয়বস্তুর অবতারণা এই কারণে যে আজকের প্রজন্ম ঘুড়ি ওড়াতে জানে
না ৷ তারা যেন শিকড়ছাড়া হয়ে পড়ছে ৷ কিন্তু রাস্তায় আজও ফেরিওয়ালার দল হেঁটে যায়
খেলনার হাট নিয়ে, ঘুড়ি নিয়ে৷ তাই এখনও ঘুড়ির সুতো কেটে গেলে আমরা ছুটে
বেড়াই ঘুড়ি ধরতে ৷ আরও স্বপ্ন'র জাল বুনে লাল নীল ঘুড়ি উড়ুক
আমাদের জীবনে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন