মণিপুরী নৃত্যগুরু ও গবেষক বিপিন সিংহ
ভারতের
উত্তর পূর্বাঞ্চলের একমাত্র ক্ল্যাসিকাল নৃত্য বলা চলে মণিপুরী নৃত্য। আর গুরু
বিপিন সিংহ কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী, গুরু ও গবেষক।
নিঃসন্দেহে বিপিন সিংহের সমতুল্য গুরু, গবেষক তথা সংগঠক
মণিপুরী নৃত্যের জগতে আর জন্মগ্রহণ করেছেন বলে মনে হয় না।
বিপিন
সিংহের পিতা ছিলেন একজন ট্রাডিশনাল বৈদ্য ও গায়ক। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে
অর্থাৎ ১৯১৮ সালের ২৩ শে আগষ্ট বিপিন সিংহের
জন্ম হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যখন সিলেটে এসে প্রথমবারের মতো মণিপুরী নৃত্য দেখে যান তার ঠিক পনেরো মাস
পর গুরু বিপিন সিংহ জন্মগ্রহণ করেন, পুণ্য মাতৃভূমি
সিঙ্গারী গ্রামে,পুণ্য লেইখমসেনা সিংহ ও পুণ্যবতী গর্ভধারিনী
মাতা ইন্দুবালা দেবীর কোলে। শৈশবাবস্থায়ই তিনি মণিপুরী নৃত্য এবং সঙ্গীত বিষয়ে
শিক্ষা নিতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি
মণিপুরী নৃত্যের জন্যই সঙ্গীত ও নৃত্য সম্পর্কে গভীর পড়াশোনা করতে লাগলেন। তিনি
গুরু আমোদন শর্মার নিকট শিক্ষা নিতে লাগলেন।মণিপুরের রাজাও বিপিন সিংহকে যথেষ্ট
সাহায্য করতে লাগলেন। পরে মণিপুরী নৃত্যের
জন্য মণিপুুরের ইম্ফলে মণিপুরী নর্তনালয় স্থাপন করেন। ১৯৭২ সালে কলকাতায় তিনি মণিপুরী
নর্তনালয় নামে নৃত্য শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তিনি বহু ছাত্রীকে উপযুক্ত
নৃত্য ও সঙ্গীতে পারদর্শী করে তুলেন। যেমন জাভেরী
ভগ্নীদের মত (দর্শনা জাভেরী), বিনোদিনী দেবী, গুণেশ্বরী দেবী, প্রীতি প্যাটেল, শ্রুতি ব্যানার্জি, লতাসনা দেবী, লায়লী বসু, ইন্দ্রানী দেবী, মনোরমা
দেবী, পৌষালী চাটার্জি, সোহিনী রায়,
বিম্বাবতী দেবী, রঞ্জিনী বসুদের মত ছাত্রী
তাঁর কাছে শিক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি কোরিওগ্রাফি
করতেন। তিনি অনেক নৃত্যনাট্যের কোরিওগ্রাফী করেন এবং একক নৃত্যের জন্যও।
কোরিওগ্রাফি, নির্দেশনা এবং গবেষণা তিনি প্রভূত পরিশ্রম করে
একই সঙ্গে সুদক্ষভাবে করে গেছেন।
নৃত্যগুরু
বিপিন সিংহ বিগত ৬০ বছর ধরে মণিপুরী গীত-নৃত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে
গেছেন। পাশাপাশি তিনি বৈষ্ণব পদাবলীরও চর্চা করে গেছেন। তিনি বহু প্রচলিত এবং
বিখ্যাত গীত-নৃত্যের সংগ্রহ করে এগুলোকে বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করেছিলেন। গুরু বিপিন
সিংহ ধ্রুপদী ভারতীয় গীত-নৃত্যের সাথে জড়িত বিভিন্ন লিরিক তাঁর কলকাতা এবং
মণিপুরের ঘরে ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করে রেখেছেন। গুরু বিপিন সিংহ খুবই সাফল্যের
সহিত মন্দির এবং সমাজের গণ্ডীর ভিতরে আবদ্ধ হয়ে থাকা মণিপুরী নৃত্যকে তার ঐতিহ্য
এবং বিশুদ্ধতা রক্ষা করে বিশ্বমঞ্চে উপস্হাপিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মণিপুরী
নৃত্যে নিজের সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বলে এর অন্য নাম গুরু বিপিন সিংহ।
ঋষিতুল্য এই পুরুষ ধ্রুপদী পরম্পরা রক্ষা করে মণিপুরী নৃত্যকে জনপ্রিয় করে
উপস্থাপন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। গুরুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে
ছিল- আট/দশ ঘণ্টা দীর্ঘ রাসনৃত্যকে মাত্র ঘণ্টা-দেড়ঘণ্টার ভিতরে সংক্ষেপ করা
সত্ত্বেও এর ভিতরে প্রভূত উপকরণ এবং নাটকীয়তা বজায় রেখে নতুনরূপ দিয়ে
মঞ্চোপযোগী করেছিলেন। শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যে যে মাধুর্য আছে তা গুরু নতুন
দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করেছিলেন। বৈষ্ণব পদাবলী এবং পুরাণ নিয়ে গুরুর রচনাসমগ্র
আত্মিক অনুধাবন করে এগুলোর উপর নতুন ধরণের গীত রচনা করেছিলেন। যে গীতের ভিতর
শাস্ত্রীয় মণিপুরী গীতের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য প্রকটভাবে ফুটে উঠার পাশাপাশি
বর্তমান যুগের সাংস্কৃতিক চেতনারও উন্মেষ ঘটে।
গুরু বিপিন সিংহ যে কত সুদক্ষ পরিচালক ছিলেন তা Bengal
Music Festival -এর পরিচালনায় অনুভব করা যায়।
‘নৃত্য চিরন্তন : মণিপুরী, ভরতনাট্যম, কত্থক নৃত্যার্ঘ’ শীর্ষক দুই পর্বের নৃত্য পরিবেশনার
মধ্য দিয়ে শুরু হয় চতুর্থ দিনের আয়োজন। এ পরিবেশনার নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন গুরু
বিপিন সিংহ, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, শিবলী
মহম্মদ; এবং নৃত্য ভাবনা, সার্বিক
নৃত্য পরিচালনা ও সমন্বয়কারী হিসেবে ছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। মণিপুরী নৃত্যে
তাল-তানচেপ-৪ মাত্রায় রাধা রূপ বর্ণন করেন সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা; নৃত্য ও সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন গুরু বিপিন সিংহ, কণ্ঠে
গুরু কলাবতী দেবী। এরপর তাল-সপ্ততাল ২০ মাত্রায় কালীয় দমন পরিবেশন করেন সুইটি দাস;
নৃত্য ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন বিপিন সিংহ, কণ্ঠে
ছিলেন দ্রৌপদী দেবী। মণিপুরী নৃত্যের সর্বশেষ অংশের পরিবেশনায় ছিলেন শিব স্তুতি।
নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন বিম্বাবতী দেবী, সঙ্গীত পরিচালনায়
গুরু লাকপতি সিং এবং কণ্ঠে দ্রৌপদী দেবী।
এখানে
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় কলাবতী দেবী গুরু বিপিন সিংহের দ্বিতীয়া পত্নী এবং
পূর্বে ছাত্রী ছিলেন। তাঁদের দুজনের কন্যা এবং ছাত্রী বিম্বাবতী দেবী। মণিপুরী
নৃত্যে যেমন সুদক্ষা ছিলেন বিম্বাবতী দেবী ,তেমনি ছিল তাঁর সুগভীর
পাণ্ডিত্য। বিপিন সিংহের প্রথমা পত্নীর ছয় সন্তান। তাঁরা বিপিন সিংহের পৈতৃক
বাড়িতে থাকেন। এঁরা সবাই আর্য বিষ্ণুপুরী ভাষায় কথা বলেন। বিপিন সিংহরা
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, তাঁদের সংস্কৃতি মেইতেই মণিপুরীদের
থেকে আলাদা। প্রথম পত্নী এবং তাঁর সন্তানেরা কোনদিন সরকারি সম্মান পাননি। বিপিন
নর্তনালয়ের উত্তরসূরীর খ্যাতিও ভোগ করেননি। পিতা জীবিত থাকতে তাঁরা গ্রামের মণ্ডপে
মাঝে মাঝে নৃত্যের অনুষ্ঠান করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এখন ক্লাসিক্যাল মণিপুরী নৃত্যের
লাগাম বিষ্ণুপ্রিয়াদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। মেইথেইরা এর উপর কর্তৃত্ব করছে।
মণিপুরী
নৃত্যের একজন লিজেণ্ড ও ন়ৃত্যবিশারদ গুরু বিপিন সিংহ তাঁর প্রতিভা ও কৃতিত্বের
স্বীকৃতি হিসেবে জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। সেগুলির একটি তালিকা উপস্থাপন
করা হচ্ছে।
সম্মান
এবং পুরস্কার
তিনি
জীবনে বহু সম্মান এবং পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য কিছু–
১.
নর্তনাচার্য (১৯৫৯ ইংরেজিতে)
২.
হাঞ্জাবা (১৯৬১ ইং)
৩.
জাতীয় সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার
(১৯৬৫ ইং)
৪.
শ্রীহট্ট সম্মেলন পুরস্কার (১৯৮১ ইং)
৫.
বিশ্ব উন্নয়ন সংসদ পুরস্কার (১৯৮২ ইং)
৬.
কলাভারতী (১৯৮৩ ইং)
৭.
প্রতিশ্রুতি পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৪ ইং)
৮.
সারঙ্গদেব ফেলোশিপ (১৯৮৪ ইং)
৯.
উদয়শঙ্কর পুরস্কার (১৯৮৬ ইং)
১০.
ওজা রত্ন (১৯৮৮ ইং)
১১.
সঙ্গীত শ্যামলা পুরস্কার (১৯৮৮ ইং)
১২.
এমিরেটাস ফেলোশিপ (১৯৮৯ ইং)
১৩.
কালিদাস সম্মান (১৯৯০ ইং)
১৪.
বহুলকা পুরঙ্কার (১৯৯১ ইং)
১৫.
অনামিকা কলা সঙ্গম -পুরস্কার (১৯৯২ ইং)
১৬.
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য একাডেমি এওয়ার্ড (১৯৯২ ইংরেজিতে)
সম্মান
জানানো সংস্হা এবং সাল যথাক্রমে —
১.
রূপকার ডান্স একাডেমি (১৯৯৪ ইং)
২.
নূপুর ডান্স একাডেমি (১৯৯৫ ইং)
৩.
সুরনন্দন ভারতী (১৯৯৫ ইং)
৪.
শিরোমণি পুরস্কার (১৯৯৬ ইং)
৫.
নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী পুরস্কার (১৯৯৭ ইং)
৬.
অঙ্গাহার ডান্স একাডেমী (১৯৯৮ ইং)
গুরু বিপিন সিংহ প্রয়াত। গতবছর তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী
কলকাতায় এবং বর্তমান আসামের কাছাড় জেলার শিলচরের কাছে তাঁর জন্ম ভিটেতে উদযাপন
করা হয়। গুরু বিপিন সিংহ নৃত্যবিশারদের জন্য ভারতবাসী গর্ব অনুভব করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন