কুশারিবাগান ৪
কে সে মোর, কেই বা জানে...
---------------------------
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী গিয়েছিলেন যশোরের নরেন্দ্রপুরে । তাঁর বাপের বাড়ির দেশ । সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিদাদা, নতুন বৌঠান, সুরেন-বিবি এবং তাঁর ছোটো দেবর। দেবরটির বয়স তখন বাইশ । বিলেতফেরত এবং বেশ খ্যাতিমান লেখকের স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। কিন্তু তাঁর পিতৃদেব বিশেষ শংকিত তার নানা বিষয়বুদ্ধিরহিত কার্যকলাপে । মেজবৌঠানকে তিনি আদেশ করেছিলেন যতো শীঘ্র সম্ভব দেবরটিকে বিবাহ দিয়ে বিষয়সংসারে লিপ্ত করার প্রয়াস করতে। পিতৃদেবের আর কী দোষ? অতো বিশালমাপের ভূসম্পত্তি দেখাশোনা করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না । বড়ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রতিভা ও পাগলামির সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকেন । এলেমদার মেজোছেলে সরকারি চাকরি নিয়ে সুদূরবাসী । সেজোপুত্র হেমেন্দ্রনাথের ব্যাপারটি একটু গোলমেলে । মহর্ষি যেন তাঁকে ঠিক ভরসা করেন না । বীরেন্দ্রনাথ আর সোমেন্দ্রনাথ বদ্ধ উন্মাদ । আর জ্যোতিদাদা পিতামহের মতো ব্যবসায় বিশ্বাস করেন, জমিদারিতে নয় । অথচ গান-বাজনা-নাটক-কবিতা ইত্যাদির ফাঁকে যে সময়টুকু বাঁচে সেটুকু দিয়ে ব্যবসা চালানোর মতো বিষয়বুদ্ধি তাঁর নেই । শেষ পর্যন্ত ভরসা রবীন্দ্র । কিন্তু তিনিও নির্ঝরের স্বপ্নে মশগুল । এমতাবস্থায় তাঁকে বিয়ে দিয়ে সংসারী না করলে জমিদারি তো প্রায় গোল্লায় যায় । অতএব সব পাতি বাঙালি বাপ-মায়ের মতো মহর্ষিও রবি'র আশু বিবাহ দিতে অগ্রণী হলেন । কিন্তু সেই চিরকেলে বল্লালি বালাই। একে বেম্ম তায় পিরিলি । সারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কুলগৌরবের শ্রেষ্ঠতমা কন্যাটি যাঁকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে তাঁর জন্য মেজোবৌঠান হন্নে হয়ে গন্ডগ্রামের আট বছরের একটি শিশুকন্যাকে খুঁজে যাচ্ছেন । কিচ্ছু চাই না, শুধু মেয়ে হলেই হলো । দু'চারটি দেখেছেনও, কিন্তু এতো নীরেস । রবি তো দূরের কথা, তাঁর নিজের পক্ষেও একেবারে নৈরাশ্যজনক । এদিকে কলকাতায় ফেরার সময় এগিয়ে আসছে । এই সময় তাঁদের দর্শন করতে আসেন জোড়াসাঁকোর সেরেস্তার একজন কনিষ্ঠ কেরানি বেণীমাধব রায় । তিনি তাঁর বয়স্থা কন্যাটিকে (বয়স নয় বছর)পাত্রস্থ না করতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে লম্বা ছুটি নিয়েছেন । একটা হেস্তনেস্ত করেই ফিরবেন এবার । করজোড়ে, বিগলিত বিনয়ে তিনি কর্তাদের আমন্ত্রণ করলেন তাঁর গৃহে একবার পদধূলি দিতে । জানেন না কর্তারা আদৌ রাজি হবেন কি না । জ্যোতিদাদা বললেন, বেশ যাবো একবার । পরদিন সবাই মিলে গেলেন বেণীমাধবের গৃহে । বেণীমাধব কীভাবে আপ্যায়ন করবেন ভেবে পান না । কন্যা ভবীর উপর ভার দিয়েছেন অতিথিদের মিষ্টান্ন পরিবেশন করতে । সেই শ্যামলী নয় বছরের বালিকাটির অবস্থাও তথৈবচ । এতোজন রাজাগজাকে কীভাবে আদর করতে হবে সে কিছুই জানে না । যাইহোক মেজোবৌঠান ভবীকে দেখে তাঁর স্কন্ধলগ্ন ভারটি থেকে মুক্ত হবার একটা উপায় খুঁজে পেলেন । জ্যোতিদাদা একটু আপত্তি করেছিলেন । কারণ তাঁর স্ত্রীও ঠাকুরবাড়ির মিষ্টান্নপরীক্ষকের (কিঞ্চিৎ সম্মানিত পরিচারকই বলা যায়) পৌত্রী ।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী গিয়েছিলেন যশোরের নরেন্দ্রপুরে । তাঁর বাপের বাড়ির দেশ । সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিদাদা, নতুন বৌঠান, সুরেন-বিবি এবং তাঁর ছোটো দেবর। দেবরটির বয়স তখন বাইশ । বিলেতফেরত এবং বেশ খ্যাতিমান লেখকের স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। কিন্তু তাঁর পিতৃদেব বিশেষ শংকিত তার নানা বিষয়বুদ্ধিরহিত কার্যকলাপে । মেজবৌঠানকে তিনি আদেশ করেছিলেন যতো শীঘ্র সম্ভব দেবরটিকে বিবাহ দিয়ে বিষয়সংসারে লিপ্ত করার প্রয়াস করতে। পিতৃদেবের আর কী দোষ? অতো বিশালমাপের ভূসম্পত্তি দেখাশোনা করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না । বড়ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রতিভা ও পাগলামির সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকেন । এলেমদার মেজোছেলে সরকারি চাকরি নিয়ে সুদূরবাসী । সেজোপুত্র হেমেন্দ্রনাথের ব্যাপারটি একটু গোলমেলে । মহর্ষি যেন তাঁকে ঠিক ভরসা করেন না । বীরেন্দ্রনাথ আর সোমেন্দ্রনাথ বদ্ধ উন্মাদ । আর জ্যোতিদাদা পিতামহের মতো ব্যবসায় বিশ্বাস করেন, জমিদারিতে নয় । অথচ গান-বাজনা-নাটক-কবিতা ইত্যাদির ফাঁকে যে সময়টুকু বাঁচে সেটুকু দিয়ে ব্যবসা চালানোর মতো বিষয়বুদ্ধি তাঁর নেই । শেষ পর্যন্ত ভরসা রবীন্দ্র । কিন্তু তিনিও নির্ঝরের স্বপ্নে মশগুল । এমতাবস্থায় তাঁকে বিয়ে দিয়ে সংসারী না করলে জমিদারি তো প্রায় গোল্লায় যায় । অতএব সব পাতি বাঙালি বাপ-মায়ের মতো মহর্ষিও রবি'র আশু বিবাহ দিতে অগ্রণী হলেন । কিন্তু সেই চিরকেলে বল্লালি বালাই। একে বেম্ম তায় পিরিলি । সারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কুলগৌরবের শ্রেষ্ঠতমা কন্যাটি যাঁকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে তাঁর জন্য মেজোবৌঠান হন্নে হয়ে গন্ডগ্রামের আট বছরের একটি শিশুকন্যাকে খুঁজে যাচ্ছেন । কিচ্ছু চাই না, শুধু মেয়ে হলেই হলো । দু'চারটি দেখেছেনও, কিন্তু এতো নীরেস । রবি তো দূরের কথা, তাঁর নিজের পক্ষেও একেবারে নৈরাশ্যজনক । এদিকে কলকাতায় ফেরার সময় এগিয়ে আসছে । এই সময় তাঁদের দর্শন করতে আসেন জোড়াসাঁকোর সেরেস্তার একজন কনিষ্ঠ কেরানি বেণীমাধব রায় । তিনি তাঁর বয়স্থা কন্যাটিকে (বয়স নয় বছর)পাত্রস্থ না করতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে লম্বা ছুটি নিয়েছেন । একটা হেস্তনেস্ত করেই ফিরবেন এবার । করজোড়ে, বিগলিত বিনয়ে তিনি কর্তাদের আমন্ত্রণ করলেন তাঁর গৃহে একবার পদধূলি দিতে । জানেন না কর্তারা আদৌ রাজি হবেন কি না । জ্যোতিদাদা বললেন, বেশ যাবো একবার । পরদিন সবাই মিলে গেলেন বেণীমাধবের গৃহে । বেণীমাধব কীভাবে আপ্যায়ন করবেন ভেবে পান না । কন্যা ভবীর উপর ভার দিয়েছেন অতিথিদের মিষ্টান্ন পরিবেশন করতে । সেই শ্যামলী নয় বছরের বালিকাটির অবস্থাও তথৈবচ । এতোজন রাজাগজাকে কীভাবে আদর করতে হবে সে কিছুই জানে না । যাইহোক মেজোবৌঠান ভবীকে দেখে তাঁর স্কন্ধলগ্ন ভারটি থেকে মুক্ত হবার একটা উপায় খুঁজে পেলেন । জ্যোতিদাদা একটু আপত্তি করেছিলেন । কারণ তাঁর স্ত্রীও ঠাকুরবাড়ির মিষ্টান্নপরীক্ষকের (কিঞ্চিৎ সম্মানিত পরিচারকই বলা যায়) পৌত্রী ।
আন্না তরখড়, স্কটবোনেদের সঙ্গ করে আসা রবি কিছুতেই রাজি নয় । শেষে মহর্ষি তাঁকে মুসৌরিতে ডেকে পাঠালেন । সোজা ভেটো, তোমাকে ঐ মেয়েকেই বিবাহ করে বিষয়কর্মে মনোসংযোগ করতে হবে । ওসব গানবাজনা, গদ্যপদ্য অনেক হয়েছে । কত্তাবাবার ইচ্ছাই আইন । সেই ভবী ওরফে ভবতারিণী একটি 'কাপড়ের পুঁটলি'র রূপ নিয়ে বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী হয়ে জোড়াসাঁকোতে পদার্পণ করলেন । আসলে বেণীমাধবের ঘরভাড়া করে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সঙ্গতিও ছিলো না । তাই বিবাহটিও ঠাকুরবাড়িতেই সম্পন্ন হয়েছিলো । সেখান থেকে 'ভাই ছুটি' একটি ইতিহাস ।
----------------------------------------------------------------
'নতুন বাড়ি' বলে তিনটি খড়ছাওয়া কুঁড়েঘরের যে আশ্রয়টি রয়েছে, সেখানে আমরা দু'জন দাঁড়িয়ে এই সব সাতপাঁচই ভাবছিলুম । ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সব ছাত্র, শিক্ষক আর অন্যসব আশ্রমিকদের জন্য সারা দিনরাত কাঠের উনুনে তিনি রান্না করে যেতেন । পাচক রাখার সঙ্গতি ছিলো না তখন । ছেলে রথী লিখেছেন, মায়ের সম্ভবত কালাজ্বর হয়েছিলো। সারাদিন গরমে, ধোঁয়ায় পাকশাল সামলাতে সামলাতে তাঁর অত্যন্ত স্বাস্থ্যহানি হয়েছিলো। রোগের ধকল আর সামলাতে পারেননি । এই নতুনবাড়িটি (বস্তুত নিতান্ত মাটির কুঁড়েঘর) তৈরি করা হয়েছিলো তাঁর জন্যই । রোগমুক্তির পর যখন তিনি শান্তিনিকেতনে ফিরে আসবেন, তখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাতে একটু শান্তিতে থাকতে পারেন । সেই ফিরে আসা আর হয়নি । ছোটোবৌয়ের 'নতুন'বাড়ি তাঁর জন্য নতুনই থেকে গেছে । দু’দিকে এককামরার দু'টি ঘর আর মাঝখানের একচিলতে উঠোনের পিছনে আরেকটি মাটির ঘর । প্রিন্স দ্বারকানাথের পৌত্রবধূর না-দেখা আশ্রয় । ঠিক তার পাশেই বেশ বড়ো দেহলি বাড়ি । কবি সেখানে থেকেছেন বহুদিন । ঐ দেহলি বাড়ির সামনেই তো মুজতবা আলিসাহেবের মরাঠি বন্ধু ভান্ডারে, কবিকে দরবেশ ভেবে জোর করে পুরো অঠন্নি বকশিস দিয়ে এসেছিলো । দেহলি বাড়িতে এখন একেবারে ছোটোদের জন্য চলে আনন্দ পাঠশালা, সুন্দর বাগান দিয়ে ঘেরা।
--------------------------------------------------------
খড়ে ছাওয়া আরেকটি বড়ো মাটির বাড়ি রয়েছে চৈতীর সামনে, পাঠভবনের দিকে যেতে । নাম বেণুকুঞ্জ । বিয়ের পর রথীন্দ্রনাথ সেখানে কিছুদিন প্রতিমাদেবীর সঙ্গে বাস করেছিলেন । পরবর্তীকালে পন্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী, দীনবন্ধু এন্ড্রুজও থেকেছেন সেই বাড়িতে। তার ঠিক পাশেই রয়েছে, যে মানুষটির দৌলতে আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে পেয়েছি, সেই দিনেন্দ্রনাথের দোতলা বাড়ি 'দিনান্তিকা' । এই বাড়িটির স্থাপত্য ষড়ভুজ দেওয়ালের কাজ । দিনের শেষে শান্তিনিকেতনের সব অধ্যাপকদের চা-চক্র বসতো এই বাড়িটির বারান্দায় । কে আসতেন না সেখানে ? সেখান থেকে দক্ষিণে পাঠভবনের দিকে একটু এগোলেই ডানদিকে একটি খোলা জায়গা । সেটিই বিখ্যাত গৌরপ্রাঙ্গন । আশ্রমের আদিযুগের শিক্ষক গৌরগোপাল ঘোষ মশায়ের নামে । এখানেই আশ্রমের ছেলেরা খেলাধুলো করতো প্রথম যুগে । মাঠের পাশেই জমকালো রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিংহসদন । কবির বন্ধু রায়পুরের জমিদার লর্ড শ্রীনাথ সিংহের অর্থানুকূল্যে তৈরি হওয়া একটি প্রাসাদ । সেখানের সভাগৃহটিতে মহাজনসম্মিলন হয়েছে অসংখ্যবার । ১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন এই বাড়িটিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেই উপলক্ষ্যে তাঁরা সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ডি লিট উপাধি দিয়েছিলেন কবিকে। তাঁদের পক্ষ থেকে এসেছিলেন সার মরিস গয়্যার এবং সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন । এই ভবনটির দু’দিকে আছে পূর্বতোরণ আর পশ্চিমতোরণ । তিনটি হর্ম্যের সামগ্রিক স্থাপত্য নতুনধরনের ইন্দো-ইস্লামিক পদ্ধতির । শান্তিনিকেতনে ভারতীয় স্থাপত্যের নানা রূপ নিয়ে যেসব পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছিলো, সিংহসদন চত্বরেই তার সূচনা । সিংহসদনের ঘন্টাঘর থেকেই শান্তিনিকেতনের সময় বাঁধা হয় ।
ঘন্টা বাজে দূরে ...
---------------------------
ঘন্টা বাজে দূরে ...
---------------------------
যারা বিহান-বেলায় গান এনেছিলো...
----------------------------------------------------
----------------------------------------------------
পরে শুনলুম ঐ মেয়েটিকে নিত্য তার নেশাড়ু স্বামী মারধোর করে । আবার ইভনিং শো'তে বাইকে করে সিনিমা দেখাতেও নিয়ে যায় ।
------------------------------------------------------------
যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে
-------------------------------------------------------------
বহুদিন আগে একটা পদ্য লিখেছিলুম, তার প্রথম লাইনটা, "কোনোদিন নদী বয়েছিলো, আজও তার টায়ারের দাগ রয়ে গেছে ।" উপলক্ষ্যটি ছিলো প্রথম খোয়াই দেখার অভিজ্ঞতা । সুরুল থেকে সিউড়ির রাস্তায় একটু এগিয়েই বাঁদিকে মোচড় মেরে বিনুরিয়া খালের পাশে পাশে যে লালমাটির রাস্তাটি এগিয়ে গেছে সোজা পশ্চিমে, সোনাঝুরি নামের প্রান্তরটি তার ডানদিকে অবিন্যস্ত শুয়ে থাকে । মৃদু লাল, মধ্য লাল, মেদুর লাল, লালিম আভায় ঘোর ধুলোট মৃত্তিকা, জ্বরতপ্ত প্রেমিকের মতো শুয়ে । প্রেয়সী জলধারা এখন শীর্ণ আকালষোড়শী , কোনও শুশ্রূষা এনে দেয় না আর । মেঘের কাছে অনিবার্য ফিরে গেছে সে, অন্তরীক্ষের কাছে । শুধু দুজনের নখর আশ্লেষের দাগ আঁকাবাঁকা খোয়াই জন্ম নিয়ে অপেক্ষা করে আছে । হে মেঘমদির শবরী, এই সব ক্ষতচিহ্নে ভিজে আঙুল বুলিয়ে দিও একদিন, তার বেশি কোনও প্রত্যাশা নেই তার ।
সোনাঝুরির খোয়াই পর্যটকদের অবশ্য দর্শনীয় । আদি সোনাঝুরি গাছগুলি সংখ্যালঘু এখন । সামাজিক বনায়নের দৌলতে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে ইউক্যালিপ্টাস বৃক্ষ । মাঝখানের সমতল ধুলোর আঙিনায় প্রতি শনিবার বসে খোয়াইয়ের হাট । 'শান্তিনিকেতনী' ব্র্যান্ডের হাতের কাজের ভালো নিদর্শন লভ্য এখানে । বাণিজ্যও মনে হয় আশানুরূপ । বিশেষত বছরের যেসময়টায় শীত-রুখু বাতাস বয়ে যায় চরাচরে।
বাঙালির দেশভ্রমণের খোঁয়ারি মিটতে চায় না। বাউলব্র্যান্ড রঙচঙে সাজানো মোটিফসেলাই জোব্বাও পাওয়া যায় এখানে । একতারা, দোতারা হাতে দাড়ির আড়ালে উৎসুক ওষ্ঠের গানও শোনা যায় । কেউ কেউ ভালো-ই গা'ন, কিন্তু আসল বাউল-ফকিরদের দেখিনি এখানে । যে পথটি বেয়ে এইখানে পৌঁছোতে হয়, সেই পথটিই আমার কাছে মনে হয় কবির কাছে নিয়ে যাবে আমায় । চোখজুড়োনো দৃশ্যছবি আমাদের রাঢ় বাংলার আনাচেকানাচে দেখতে পাওয়া যায় । কিন্তু, এই পথটি এক অন্য জন্মের ঝরনাতলার নির্জন মনে হয় । মুখবইতে ছবি দেখে সামরান লিখেছিলেন, এ এক অসম্ভব পথ । সত্যিই, ঐ পথে হেঁটে , ধুলো মেখে, স্বেদসিক্ত হয়ে ফিরে আসার পরেও মনে হয় পথটি নিখুঁত জাদুবাস্তবের পরিভাষা । প্রবলভাবে আছে, কিন্তু নেই হয়ে ।
---------------------------------------------------------------
---------------------------------------------------------------
সেই ধুলোডাঙ্গাটির একপাশে খোয়াইয়ের হারিয়ে যাওয়া জলধারার খাদ, জলের মতো-ই এঁকেবেঁকে কোথাও চলেছে । যাঁরা কলোরাডো দেখেছেন, এই আয়োজন তাঁদের জন্য নয় । আমার দেখা বাংলায় আর একটি জায়গাতেই এই দৃশ্যের জন্ম দেখা যায়, অনেক ব্যাপক, বিস্তৃত নির্মাণ তা । গড়বেতার কাছে গনগনির মাঠে দীর্ঘ ঘোর সবুজ কাজুবনের আঁচল সরিয়ে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় লালপাড় নদীর সীমন্তরেখা । শিলাবতী নদীর শুকনো সোঁতা, লালমাটির শিরা-উপশিরা ছিন্নভিন্ন করে, শিহর জাগিয়ে নিশ্চল অপেক্ষায় রয়েছে সেখানে । নিচের দিকে উঁকি দিলে একটু শিরশির করে ওঠে অনুভূতিগুলি।
আমাদের গ্র্যান্ড নয়, পাতি ক্যানিয়ন । বাঙালি মেয়েদের মতো কৃশা, লঘুত্তমা, কিন্তু অমোঘ আর্তি জড়িয়ে থাকে তাদের সারা গা'য় । কচি সবুজ আঁচল জড়ানো শিশিরচিকন কলাগাছের মতো মসৃণ, সর্বতো নারীর মতো ।
সোনাঝুরির খোয়াই সেই বন্যতাকে ধরতে পারে না । সে মেঘদেবতার হেলায় রিক্তা অম্বালিকার দোসর ।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন