উত্তরকথা
(৪০)
সাঁতার কাটা বা না কাটাটা বড় কথা নয়। সন্তরণশীল এক যাপন নিয়েই তো মানুষের জন্মের পর জন্ম কেটে যায়। ভাবনাস্রোতের বাঁধনহীনতায় টুংটাং দোতারার সুর জটপাকানো স্বপ্নের ভিতর অনেকানেক পাখির ডানাঝাপটের আশ্চর্য দৃশ্যপট হয়ে চোখে ভাসে। তখন আলোহীন সাঁতারহীন এক জীবনযাপনের নেশার টানে ইয়াসীন মাতব্বর উঠে দাঁড়ায়। দীর্ঘ হাই তোলে। শরীরের পেশীসমুহের ভিতর একসময় স্থিতাবস্থা এলে মাতব্বর দীর্ঘ এক হাঁটার জন্য পরিক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কোথা থেকে যেন দোতারার আওয়াজ উঠে আসে। কে বাজাচ্ছে কে জানে! মাতব্বর হাঁটা শুরু করে জোতদারটারির জঙ্গলের দিকে। জঙ্গল অতিক্রম করে তাকে দ্রুত পৌঁছতে হবে একুশ ঘোড়ার ধনকান্ত জোতদারের বাড়ির খোলানে।
সে কবেকার কথা মাতব্বর জানে না। মাতব্বরের প্রবীণ চোখের তারায় তারায় এখনো কী জীবন্ত সব দৃশ্যপট। তখন চারধারে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। চা-বাগান। রাজবংশী,
আদিবাসীদের বসত। গুটিকয় মুসলিম টাড়ি। বাগানবাবু ফরেস্টবাবু। ধনকান্তের বাপ তখন জোতদার। আধিদৈবিক জীবনের বর্ণময় যৌথতা। আর খুব মনে পনে জার্মান সাহেবের কথা। মাতব্বর তখন ছোট। বাবা-দাদার সঙ্গে হাটগঞ্জে ঘুরে বেড়াত। কত কত মানুষ। হাটের পথে ধুলোর ঘুর্ণী। সন্ধে পেরিয়ে অনেক রাতে কতবার বাড়ি ফেরা। গরুর গাড়ির ক্যাঁচর কোঁচর শব্দ। গাড়ির ধুরায় কালিপড়া লণ্ঠনের দুলুনি। ছইয়ের ভিতর থেকে লণ্ঠন আলোর কম্পনরেখায় ভৌতিকতা দেখা যেত। যেন নদীর জলে ধরাছোঁয়ার
খেলা। একবার শালকুমারের জঙ্গল থেকে বাঘ বেরিয়ে এসেছিল। গোটা দিন সেই বাঘ দাপিয়ে বেড়িয়েছিল ফালাকাটা শহর। শেষেকোচবিহারের রাজার এক শিকারী ভাই এসে সেই পাগলা বাঘকে মেরে ফেলেছিল। মাতব্বরের এক নানুভাই ইয়াসিনউদ্দিনকে এক চাঁদনীতে শিঙের গুতোয় শুইয়ে ফেলেছিল বাইসন। এত এত স্মৃতির জটে আটকে যেতে যেতে চার কুড়ির মাতব্বর যেন ফের ধাক্কা খায়। পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে কোন এক কুহকের দেশে যেন বারংবার ফিরে আসতে থাকে জার্মান সাহেবের ঘোড়া, বন্দুক ও বাজখাই চুপি। কত কত বাজার হাট নদীর ঘাট ঘাটোয়াল রাখাল বন্ধু মইষাল একোয়া হাতির মাহুত বুধুরাম,হাসতে হাসতে নেমে আসছে মথুরা হাটের খুব ভিতরে। প্রবেশপ্রস্থানের নিয়তিতাড়িত সম্ভাবনায় পাতলাখাওয়া শুটিং ক্যাম্পের হরিণেরা একযোগে নাচের একটা ঘোর তৈরি করতেই একধরনের নতুনতর নাচই যেন বা বিনির্মিত করে তুলতে থাকে। মাতব্বরের হাঁটাটা জারি থাকলেও এক পর্বে দোতারা আর বাজে না।
কালজানি নদীর কাছাড়ে আটকে পড়লে কে তাকে উদ্ধার করবে? নদীর পাড়ের জঙ্গলে ময়ূর ঘুরে বেড়ায়। ডাকে। অথচ ঘাটোয়াল আসে না। বাউদিয়া ঘাটোয়াল ঘাটবাসর ছেড়ে কোন পালার আসরে গেছে বাঁশিয়ালের শাকরেদ সেজে। ঘাটের শূন্যতায় চরাচরবাহী ব্যপ্ততায় লীন হবার সমাধানসূত্র নিয়ে মাতব্বর নেমে পড়ে প্রাক শীতের আশ্বিনা নদীর জলে। পাহাড়ি নদীর শীতলবরফগলা জল তার পায়ের পাতা গোড়ালি উরু ও কোমর স্পর্শ করলেও শরীরময় একাগ্রতায় সে হাটফেরত মানুষের ঘরে ফিরবার শৈশবস্মৃতির ভিতর কেমনধারা ডুবেই যায় যেন আর বাঘের নদী পেরিয়ে এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গল পারাপারের সফলতার মতো নদীটা ঠিক সে পেরিয়েই আসে, তারপর শরীরময় হাসির তাড়সে কাঁপতে কাঁপতে নাভির তলদেশ থেকে গান তুলে আনতে থাকে— ‘হালুয়া রে হালুয়া/পাতলাখোয়ার হালুয়া/হালুয়া রে হালুয়া ডোবোরহাটের হালুয়া...’ গানের মত্ততায় গানের উজানস্রোতে টেনে সাজানো ছড়ানো আকাশময় মেঘরোদের পৃথিবী মায়াবন্দর দিয়ে সে যথারীতি পৌঁছেই যায় ঘোড়া জোতদারের বাড়ির অন্দরে। অবশ্য জোতদারী নেই এখন আর। রাজা নেই। জার্মান সাহেব মরে ভূত। কিন্তু জোতদারটাড়ি আছে। রাজারহাট রাজারদিঘী সাহেবপোতা এসকল রয়ে গেছে স্মৃতির শস্যবরণ নকসাদার শাড়ির পাড়ের চিক্কনতার মতো।
(৪১)
মাতব্বর জোতদারবাড়ির জোড়শিমূলের গাছের গোড়ে বসে পড়ে। ক্লান্তি না থাকলেও সে ঘুমিয়ে পড়ে। নিন্দের আলিসায় টোপ পাড়ে। ঘুম ও জাগরণ নিয়ে তার দীর্ঘ দীর্ঘ জীবন কেমনধারা কেটে গেল। পর্ব পর্বান্তরে স্মৃতিচিহ্নিত যাপনবিন্দু দিয়েই সে উজান ভাটির স্বপ্নকাতর জীবন কাটিয়ে দিল। বাইচের নাও বেয়ে তবে কি চলে যাওয়া যায় আর কান্দাকান্দির মেলায়। বাওকুমটা বাতাসের ঘুর্ণীতে আঁতকে উঠে ভয়ার্ত শেয়ালের কান্নায় সচকিত হলেও নতুন নতুন সুর স্বপ্নের ধারাবাহিকে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে চোরাবালিছোঁয়া হাওয়া, ফালাকাটা শহরের আতঙ্কিত বাঘ্য।স্মৃতির দীর্ঘ অভিশাপের ভার বহনের ক্লান্তি শোকের দিনগুলিতে ফিরে যাবার উদগ্র বাসনার মতো কখনো হামলে পড়লেও জীবন চোরকাটা বাবলাবনঝাড়ের আবহমানতায় বহুধাব্যাপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। ইয়াসীন মাতব্বরের চারকুড়ি বৎসর অতিক্রান্ত শরীর সচেতন ভাবেই আরো আরো ঘুমের ভিতর ডুবে যেতে থাকে। ভূগোল ইতিহাসের বহুস্বরের মধ্যে তার ঘুমজড়ানো অস্তিত্ব একসময় মুছে যায়। ঘুম না ভাঙাটাই তখন চিরসত্য। মরণঘোরের মতো স্পষ্টতর ক্রমে। বৃত্তান্তের আরো আরো ক্রমবর্ধমানতায় মাতব্বর স্বয়ং নবীকৃত চিরনতুন বৃত্তান্তের রূপকথা হয়ে বৃত্তান্তকে মান্যতা দিতে গিয়েও বৃত্তান্তের চিরবিষন্নতায় লীন হয়ে যেতে যেতে তীব্র এক ঘুমের বৃত্তের অত্যাশ্চর্যে চিরায়ত কোন বৃত্তান্তই বুঝি তীব্র বাজনার মতো ঢের বাজতে থাকে আর বৃত্তান্তের দিকে তুমুল বৃত্তান্ত হয়ে হেঁটে যেতে থাকে শুভ্র হাঁসের দল।
তবু তো পেরিয়ে আসতে হয় অসংখ্য ঝাড়-জঙ্গল-বাবলাবন-কলার বাগান। গহিন ছমছমে বৃহৎ কোনও অরণ্যভূমিতে প্রবেশ করবার আগে যেমন আট-দশটা সংক্ষিপ্ত সাঁকোহীন নদী। জীবন ছন্দময় প্রবাহিত হয়।বাইসন হানা দেয়। হাতি মানুষ মারে। অথচ জীবন থেমে থাকে না। শোকপালনের অবকাশই দেয় না। মাঠ প্রান্তরের ভিতর বছরের পর বছর সাহেবদের কবর শুয়ে থাকে। আরও জীর্ণ ও পুরাতন হয় ক্রমে ক্রমে। মকবুল বয়াতির দোতারার ডাং কোন কোন শীত রাতে ওম ও উষ্ণতা ছড়ায়। উষ্ণতর হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় শামিল হয় পাখি ডাক, মনশিক্ষার গীত-
‘কচুপাতের পানি যেমন রে/ও জীবন/টলমল টলমল করে...’ বিধ্বস্ত পুরুষ উঠে দাঁড়ায়। তার সর্ব অঙ্গে দৃঢ়তা জমে। আর অন্ধকারেই রাস্তা খুঁজে পায় সে। তখন আঙিনায় নাচগানের আসর। ঢোল-সানাই। আর নজরুল ইসলামের মরমিয়া গান-‘আইসো মোর কালাচান/যাও খায়া যাও বাটার পান...'
(৪২)
জোতদারের ধানের গোলায় আগুন। অথচ উদ্বেগহীন জোতদারের মুখে তখন তেভাগার গল্প। লাল পতাকা, কৃষকজনতা ও বারুদ বন্দুকের গাথাগল্প। গল্পপথে রক্তের দানা ফন্দিফিকির ও সমূহ চক্রান্তকথা। আগুন প্রায় নিভে আসে অথচ গল্প শেষ হতে চায় না। আদতে এক গল্প কিছুদূর গিয়েই নানা প্রশাখায় বিভক্ত। তাই এমন ধারাবাহিকতার মজাদার ফানুষ। এইসব গল্প খুঁটে খাই আমি। আমোদিত হই। আর বাড়ি ফিরবার পথে সন্ধে ও রাত্রির মধ্যপর্বে প্রায়শই বাঁশবাগান পড়ে। বাঁশবনের ভিতর অগণন জোনাকি। মন্দ আলোর নদী। সামন্তরক্তের মতো। লোককথার ঝোলা কাঁধে অপরূপ সব কথোয়াল হেঁটে যান। তাঁরা হেঁটে যেতেই থাকেন। আর ভালোবাসার পাশে সন্ত্রাস-রক্ত-লালসার আগুন। জন্ম ও মরণ লেখে বাজপাখি। শীত আসে। উত্তর বাংলার মাঠে মাঠে কুয়াশা। সাদা বকের দল আসর বসায়। কুয়াশার ভিতর তারা উড়েও যায়। কুয়াশা পাতলা হতে থাকে। রোদ ভাসিয়ে নিয়ে যায় শীতসকাল। রোদ,
মানে শীতের রোদ সর্বদাই সংক্রামক। কিঞ্চিত উদাসও করে হয়তো বা। মিনিটে মিনিটে আবার পাল্টে যায় রোদের রঙ ও রেখা। রোদ প্রায়শ টেনে নিয়ে যায় আমাকে নদীর কাছে। নদী কখনো প্রবীণ হয় না জানি। এও জানি নদী থাকলেই নদীচর থাকবে। আর নদীচর মানেই বালির নকশাকাটা সুবিশাল সামিয়ানা। নদীর সাথে মাঝি মাল্লা ডিঙি নৌকো আর সারিগান এসবের আশ্চর্য যোগাযোগ। আবার শীতের নদী অন্যরকম। সে হাওয়া বাতাসের। সরষেখেতের আর তরমুজবাগানের। নদী আমাকে টানে। উসকে দেয়। ঝাউগাছের পৃথিবীতে একা থাকবার কোন কষ্ট থাকে না। চাঁদওভীষণমাত্রায় ডাকে আমাকে। নদীপথে কাহিনী তৈরী হয় কতশত। আর কাহিনী সমূহে মিশে যেতে থাকে লোকগান। লোকবাজনা। নদীকে উপাস্য ভেবে আমাদের উত্তরবাংলায় গান বাঁধা
হয়। পুজোর ফুলে ভরে ওঠে নদীগর্ভ। উত্তরবাংলার রাজবংশী মহিলারা দলবদ্ধ হয়ে নাচে। তিস্তা বুড়ির পুজো হয়। বাজে ঢাক আর ঢোল। এই ভাবে অন্ধকার ও আলোয় পূর্ণ হয়ে উঠতে থাকি আমি। আবেগ টেনে আনে চোখের জল। আবার চোখের জল দিয়ে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক এঁকে রাখি বিকেল। বিকেল প্রসঙ্গে খুব,
খুব চলে আসে পুকুরঘাট। নৈঃশব্দ খানিকটা। পুকুরঘাটে কেউ কেউ হারিয়ে ফেলে নাকছাবি। রুপোর বিছে। লণ্ঠনের মৃদুআলোয় শুরু হয় অনুসন্ধান পরব। আবার কুয়াশা নামে। কুয়াশা জড়ানো হাসপাতালের বারান্দায় এলোমেলো আর একা আমি হাঁটি কিঞ্চিত আলগোছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন