কুশারিবাগান – ২
যে পথে গাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছিলো, সেই সব রাস্তা মনে করাবে কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ির অনুষঙ্গ। মোটরগাড়ি সেখানে এখনও বহিরাগত। সিমেন্টবাঁধানো পথের ভুলভুলাইয়া,
সীমান্তপল্লী, মাঝিপাড়া, বাগানপাড়া,
শেষতক পৌঁছে গেলো আমার গন্তব্য, 'খাপছাড়া'। বাড়ির পথটি শেষে গিয়ে ঘা দিচ্ছে একটি পাঁচিলের গায়ে। নজর করে দেখি পাঁচিলের ওপারে এই তো সেই বিনয়ভবনের পিছুটানা অনন্ত মাঠ, কিন্তু তা আজ যেন বার্লিন দেওয়ালের অন্য পার। তাকে পেরিয়ে পায়ে পায়ে শ্রীনিকেতনের পুরনো রাস্তায় পৌঁছোনো যাবে না আর।
আমি চা খাই না। এতোটা পথ সফর করে এসেও কেমিতি বঙ্গসন্তান চা না খেয়েই এক্ষুনি বেরোতে চায় কোপাইয়ে কেমন সূর্য ডোবে এখনও, তা দেখার জন্য। রসিকরা তাড়াহুড়ো করে তাদের চায়ের পেয়ালা শেষ করে ফেলে। গাড়িতে কতোটুকু আর পথ? একসময় হেঁটে যেন ফুরোতেই চাইতো না। ব্রিজ অন রিভার কোপাইয়ের কাছে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। নদীর ধার দিয়ে মোরম বাঁধানো রাস্তা। কিন্তু নদীটা কোথায় গেলো? এতো শীর্ণা, দীনা একটি জলধারা কতোদিন ধরে কতো শব্দকথা, শিল্পকথার টানা বিষয় হয়ে থেকে গেছে, তাকে তো আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। হয়তো সেই আফশোসেই শেষসূর্যও ডুব দিলো শালবন, বাঁশবাগানের আড়ালে। বাতাসে কোনও শীতলতা নেই, কিন্তু বহু নতুনদা-নতুনদি'দের ঘুরে বেড়াতে দেখলুম চাদর-টুপি-মাফলার গায়ে দুয়োরাণী কোপাইয়ের এপার ওপার। দু'য়েকজন সব্জিটব্জি নিয়ে বসেছেন রাস্তার ওপারে। বাউলের মতো কয়েকজন লোকশিল্পী ইধরউধর গুবগুবি, দোতারা নিয়ে গান গাইছেন। ভালোই গাইছিলেন তাঁরা, তবে গানগুলি কলকাত্তাই শ্রোতাদের সঙ্গে মেলানো বাউলগান। এখন আর টানে না। হয়তো শুনতে চাইলে এক-আধটা অসলি চিজ বেরোতেও পারতো, কিন্তু তখন আর সময় নেই। নিমীল সন্ধ্যা নামিছে মন্দমন্থরে...
প্রথম সাঁঝের ঝুঁঝকো সায়ন্তন, চেনা রাস্তা,
চেনা ছায়া, চেনা চেনা ধুলোট লালিমা...
ফিরে আসে কুশারিবাগানের স্মৃতি...
রাতে শুতে যাবার সময় জানা ছিলো কাল সক্কালে পাঠভবনের বসন্ত-আবাহন অনুষ্ঠান আছে। এই অনুষ্ঠানটি সচরাচর শ্রীপঞ্চমীর সকালে পালন করা হয়, কিন্তু এবার কোনও কারণে হতে পারেনি। তাই একটু পিছিয়ে।
যাঁরা শান্তিনিকেতন বলতে জানেন পৌষমেলা আর বসন্ত-উৎসব, তাঁরা বেশ বঞ্চিত প্রজাতি। দুটো'ই বহুদিন হলো স্থূল বাণিজ্যিক বিড়ম্বনায় পর্যবসিত হয়েছে। যাঁরা সামান্য হলেও পুরনো স্মৃতি বা বহুচর্চিত শান্তিনিকেতনী রুচিবোধকে এখনও প্রাসঙ্গিক মনে করেন,
তাঁদের উচিত শ্রীনিকেতন কুঠিবাড়ির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত মাঘমেলা আর পাঠভবনের ছোটদের উপস্থাপনায় এই বসন্ত-আবাহনকে এসে একবার দেখা। মোটামুটি পাঁচ থেকে দশ কেলাসের ছেলেমেয়েরা উজ্জ্বল বর্ণময় সাজ-পোষাক, সঙ্গীত-নৃত্যে ভরিয়ে রাখলো পাঠভবনের বৃক্ষময় অঙ্গনটিকে। বসন্ত পর্যায়ের অতিশ্রুত গানগুলি বালকবালিকাগুলি যে সরল দক্ষতায় শোনালো আমাদের, সঙ্গে নয়নমোহন বর্ণোজ্জ্বল নৃত্যভঙ্গ, আমি সারাদেশে কোথাও তা পাইনি। হ্যাঁ, কলকাতাতেও তার জুড়ি পাওয়া যায় না।
শান্তিনিকেতনের খেলার মাঠটিকে একসময় মনে হতো অনন্তপ্রান্তর। মাঠের উত্তরপ্রান্ত থেকে ঐপারের মরূদ্যান, অর্থাৎ সারি সারি তিনটি ছাত্রী-আবাস, শ্রীসদন,
বিড়লা আর গোয়েঙ্কা যেন ভবসাগরের অন্যপারের এক দৈবীস্বপ্ন। স্বপ্নই তো! বহুদিন আগে একদিন মাঠ পেরিয়ে একটা রোগা ফর্সা ধারালো মেয়ে নিজের হাতে বাঁধা বিছানা আর তোরঙ্গ নিয়ে থাকতে এসেছিলো শ্রীসদনের একটা ঘরে। দূরে কোথাও তার বাবা জেলশয্যায় আর মা রোগশয্যায় কাতর, বিচ্ছিন্ন। বহুদিন পরে মেয়েটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলো। একটা ঘর তার নামে এখনও রাখা আছে সেখানে। উর্দুতে বলতে গেলে ঐ চৌহদ্দির
"গর্দিশ মেঁ হ্যাঁয়, চাঁদতারোঁ কা নিজাম"। তখন মাঠের বেড়াবাঁধা কোনও সীমা সংক্ষেপ ছিলো না একেবারে। উত্তরপাশের রাস্তাটি টানা পশ্চিমদিকে চলে গেছে চীনাভবন হয়ে হিন্দিভবন। পাঠভবন যেতে গেলে গাড়ি রাখতে হবে ঐ মাঠের পাশে, বৃক্ষরাজির ছায়ায়।
সেখান থেকে পায়ে পায়ে শ্রীসদনের রাস্তা পার করে (শোনা গেলো ঐ রাস্তাটির এখন নাম হয়েছে
'দুঃখহরণ রোড'। যদিও দুঃখবরণ করার জন্যও ঐ রাস্তাটিকে আশ্রয় করা যেতে পারে) শ্রীসদন ও বিড়লা ছাত্রী আবাসের আঙ্গিনায় রামকিংকরের যে মহিষ-আনন মকরপুচ্ছ মূল ভাস্কর্যটি এবং নৃত্যপরা নারীমূর্তিটি রয়েছে,
দু'টিই শান্তিনিকেতন ঘরানার প্রতিনিধিমূলক নিদর্শন। এড়িয়ে গেলে চলবে না। এই পথটিতে সাইকেল আরোহিণীদের অন্তহীন আসা যাওয়া থেকেই বোধ হয় লেখা হয়েছিলো, "...শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া,/ শুধু দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া, / শুধু নব দুরাশায় আগে চলে যায়-/ পিছে ফেলে যায় মিছে আশা।" রসিক কবি কিন্তু এই গানটিকে গ্রন্থিত করেছিলেন 'বিচিত্র'
পর্যায়ে।
ভাবি, কতো কিছু শেখার বাকি থেকে গেছে...
গত বছর কুড়ি-পঁচিশ শান্তিনিকেতনে গেলে একটা অবশ্যগন্তব্য ছিলো ইন্দ্রনাথ মজুমদারের বইবিপণী 'সুবর্ণরেখা'। ইন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর এই দোকানটি শুধু কেনাবেচার ঠেক ছিলো না, সেখানে শান্তিনিকেতনের বনেদি আড্ডাধারিরা একত্র হতেন ছুটির দিনে বা অলস সন্ধেবেলা। চারদিকে অভিজাত স্বভাবময় বইয়ের সাজঘর, একপাশে আড্ডা চলতো পৃথিবীর সব বিষয় নিয়ে। বাঙালির সব পেয়েছির আসর। মনে পড়ছে বহুদিন আগে আমি তখন পাটনাতে থাকি। সাঁওতাল পরগণার সীমান্তে একটা ব্রাঞ্চ অডিট করতে গিয়ে রয়েছি সিউড়ির একটি সরাইখানায়। মাঝখানে একটা রোববার। সক্কালবেলায় বাস ধরে পৌঁছে গেলুম বোলপুর। ঘুরতে ঘুরতে নন্দন ভবনে, হঠাৎ দেখি মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী বেরিয়ে আসছেন সেখান থেকে, পিছনে অনেক বরকন্দাজ। আমার সামনে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন, কখন এলে? আমি নিতান্ত অপ্রস্তুত। বলি, এই এলুম। বেশ, বেশ, আমার একটু তাড়া আছে, আজ আসি, হ্যাঁ। বলতে বলতে তিনি নিষ্ক্রান্ত। তাঁর সঙ্গীর দল আমাকে এলেমদার কিছু ভাবলেন বোধহয়। আমি নিতান্ত ভ্যাবাচ্যাকা। ভাবতে বসি, তাঁর কোন পরিচিতের সঙ্গে আমাকে তিনি গুলিয়ে ফেললেন কে জানে? ভিতরে তখন শ্রদ্ধেয়া অমিতা সেন'কে আশ্রমিকরা সম্বর্ধনা দিচ্ছেন। সেই তাঁকে শেষ দেখা। তার পরে তাঁকে দেখার আর সুযোগ হয়নি।
বেশ তাও খেয়ে পৌঁছে যাই 'সুবর্ণরেখা'য়। ঢুকতে গিয়ে দেখি আড্ডা বসে গিয়েছে ততোক্ষণে। আবার একজন হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। দেখি আমাদের সুজিতদা, জামশেদপুরের সুজিত চট্টোপাধ্যায়। আমাদের শহরের আদি শান্তিনিকেতনী আশ্রমিক ছিলেন তিনি ছাত্রজীবনে। তারপর ফিরে আসেন নিজের গাঁয়ে। উচ্চপদস্থ অধিকারী হয়ে কর্মরত ছিলেন একটি নামকরা সংস্থায় বহুদিন। আদ্যন্ত রুচিমান, বিদগ্ধ একটি শিল্পী মানুষ, অবসর নিয়ে শান্তিনিকেতনে স্থিতু হয়েছেন। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন ইন্দ্রনাথবাবুর সঙ্গে, 'আমাদের' জামশেদপুরের ছেলে। এই 'আমাদের' শব্দটির উচ্চারণ জামশেদপুরের সঙ্গে যেভাবে মানিয়ে যায়, 'আমাদের শান্তিনিকেতনে'র থেকে তার অভিঘাত অনেক সুদূরস্পর্শী। গাঁয়ের লোক হবার এই প্রিভিলেজটি বুঝেছিলেন বলেই মোহনদাসের আহ্বান, ব্যাক টু ভিলেজ। আমাদের এই লেজটি থাকেই, বেশ মোটাও বলা যায় তাকে। কখনও তো কাউকে বলতে শুনি না, এইটি 'আমাদের' কলকাতার ছোঁড়া।
জামশেদপুরের লোকের শরীরে তো গঙ্গা থাকে না, থাকে শুধু সুবর্ণরেখা। জন্মের পর প্রথম গণ্ডূষ জল থেকে সব খেলা শেষ করে অস্থি বিসর্জন, সবই সুবর্ণরেখার বিগলিত করুণায়। সেই জন্য সেদিনও সুবর্ণরেখায় অনেক আড্ডা, বই নেওয়া, যথারীতি কোঁচড়ে দু'চার মুদ্রার বাসভাড়া মাত্র বাঁচিয়ে।
সেই সুবর্ণরেখায় এবার গিয়ে দেখি আমার জানা শ্রাবণদিনের সেই উদ্বেল নারীর মতো স্রোতস্বিনী, চৈত্রের মরা সোঁতা যেন। ইন্দ্রনাথ গত হতেই কর্তৃপক্ষ দোকান খালি করার লুটিস ধরিয়ে দিয়েছেন। বিজলি কেটে দিয়েছেন। ভিতরে দেখি ইন্দ্রনাথের এক পুত্র অর্ধঘুমন্ত অবস্থায় ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন। আলো নেই, হাওয়া নেই। বই সংগ্রহের অতি ক্ষীণদশা। সব চেয়ে আফশোস পুরনো, মূল্যবান বাংলা আকর গ্রন্থের প্রাপ্তিস্থান হিসেবে সুবর্ণরেখার সেই গৌরব অস্তমিত। ভিতরের গুদামে অনেক বই হয়তো আছে, কিন্তু আলো নেই, অন্ধকার, ধূলিধূসর। কোথায় পাবো তারে! চাইলেও নিজের বইটি খুঁজে নেওয়া যাবে না।
কষ্ট হলো, বেশ কষ্ট। সম্প্রতি শুনলুম দোকানে বিজলি বাতি জ্বলছে। কিন্তু ঐ সংগ্রহের ধুলোভরা তাকে বইগুলি দেখলেই বুকের ভিতরে যে সাঁঝবাতি জ্বলে উঠতো, তার আর হদিশ নেই।
সুবর্ণরেখায় দেখি একজন প্রবীণ মানুষ প্রশ্ন করছেন, চন্দ্রনাথ বসু'র কোনও বই আছে? নিজের বই খুঁজতে খুঁজতে আড়চোখে তাঁকে দেখি। নাতিদীর্ঘ, এই নিদাঘে শীতবস্ত্রে ভারাক্রান্ত নিরীহ গৌড়জন, উল্লেখ্য শুধু ঐ 'চন্দ্রনাথের বই'। দোকানমালিকের উত্তর ছিলো নেতিবাচক। তিনি আবার প্রশ্ন করেন, কোথায় পাওয়া যাবে একটু বলতে পারেন? সে প্রশ্নেরও কোনও উত্তর নেই। আমি আমার বইয়ের সওদা নিয়ে বেরিয়ে আসি। তিনিও আসেন। মুখটি বিষণ্ণ। আমি তাঁকে বলি, চন্দ্রনাথের একক বই তো পাবেন না, তবে অন্য লেখকের সঙ্গে সংকলিত 'দুষ্প্রাপ্য সাহিত্য সংগ্রহ' নামের একটি গ্রন্থ রিফ্লেক্টের আছে, সেখানে তাঁর একটি লেখা 'পশুপতিসম্বাদ' পাওয়া যায়। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকাগারের সাইটে তাঁর 'হিন্দুত্ব' নামের বিতর্কিত লেখাটি পাবেন। আপনি যদি কলকাতায় থাকেন তবে কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে খোঁজ করবেন, পেয়েও যেতে পারেন। তিনি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রবীণা সহধর্মিণীকে বলতে থাকেন, তোমায় বলেছিলাম না, শান্তিনিকেতনে অনেক পণ্ডিতেরা থাকেন, একটা খোঁজ পেয়েই যাবো (পণ্ডিত?? কী সাংঘাতিক!!)। দ্যাখো, পেয়েই গেলাম। আমি কিঞ্চিৎ প্রমাদ গণি, এতো উৎসাহের কারণ কী হতে পারে? চন্দ্রনাথ বসু সম্বন্ধে কবিমুগ্ধ বাঙালির মনে একরাশ ক্ষোভ ছাড়া কিছু নেই। নিতান্ত পার্সোনা নন গ্রাটা। আমি আবার বলি, কিছু মনে করবেন না, আপনি চন্দ্রনাথ বসু সম্বন্ধে এতো আগ্রহী কেন, জানতে পারি কি? তিনি একটু থামেন। তারপর বলেন, ছোটবেলা থেকে শুনছি তাঁর লেখার কথা, কিন্তু এতো বয়স হলো, কখনও পড়িনি। তা বেশ, কিন্তু এতো লেখক থাকতে তাঁর লেখা খোঁজার ইচ্ছে কেন হলো? ইয়ে মানে, চন্দ্রনাথ বসু হলেন আমার ঠাকুরদার বাবা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, বহুদিন ধরে খুঁজছি, আপনি একটা খোঁজ দিলেন।
ভাবি, শিকড়ের সন্ধানে একটি চরিত্র...
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন