চোখাচোখি
কামিনী
ফুলের গাছটাকে বৃষ্টিফুল নাম দিয়েছেন অসীমবাবু। যত ঝরন তত ভরন। তবে কী অসীমবাবু
ঝরছেন কিন্তু ভরছেন না। বৃদ্ধ বয়সের আরাম কাকে বলে তা একমাত্র তিনিই জানেন। সৎ সুশীল এক নাগরিকের আপাদমস্তক
সম্মানিত জীবনযাপন করার শেষে মৃত্যুন্মুখ দিনগুলো যেন শেষ হচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অংকের শিক্ষক ছিলেন।
সম্প্রতি মূত্রগ্ৰন্থির বাড়বৃদ্ধিতে খুবই কাতর অবস্থা। অ্যাজমাজনিত শ্বাসকষ্ট।
বয়স কিছু না কিছু না করে নব্বইয়ের দিকে চলেছে। অনুরাগী ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই
এখনও খবরাখবর নেন। অনেক ছাত্রের অকালপ্রয়াণও তিনি দেখলেন। বাবা মা মারা যাওয়ার
পর দুঃখ বলতে নিজের দু’ একজন ভাইবোনের বিদায়ব্যথা ছাড়া আর কিছু পান নি। স্ত্রী
পুত্র কন্যা জামাই নাতি পুতি সম্বলিত চন্দ্রহট্টের মধ্যমণি তিনি। দোর্দণ্ডপ্রতাপে
সন্তান মানুষ করেছেন। আত্মীয়স্বজন পোষন
করেছেন। আর আছে ভগবৎ চিন্তা।
ডাক্তার
বদ্যি হাতের মুঠোয়। অনেক বছর ধরে আয়াসেবিকা বর্তমান। আহা উহু করলেই ছেলেমেয়েরা একটার জায়গায় দশটা ডাক্তার
নিয়ে আসে। কলকাতার সুপার ডুপার হসপিটাল ডাক্তার সব চষা আছে তাদের। কার ওষুধ আগে
খেতে হবে,
কোন ডাক্তার কত বেশি রোগবিদ্যাগত (প্যাথোলোজিক্যাল) পরীক্ষা করতে দিয়েছে
এসব নিয়ে ছুটির দিন ছাড়াও অন্যান্য দিনে সবাই ব্যস্ত থাকে। ফোনে সারাক্ষণ
পুত্রকন্যাদের কনফারেন্স চলতে থাকে। ছোটবৌমা এবারের বসন্তোৎসব যাওয়া বাতিল করে দিল শ্বশুরমশাইয়ের শরীর খারাপের
কারণে। বড়ছেলে আন্দামান যাবে সব ঠিকঠাক। অবস্থার অবনতি হওয়ায় এখন ভ্রমণ বাতিল
করবে কিনা ভাবছে।
মাস
দুয়েক আগেই অসীমবাবু নার্সিংহোম গিয়েছিলেন এক সপ্তাহের জন্য। এখন খাওয়া বন্ধ আর
প্রচুর বাহ্য প্রস্রাব হচ্ছে। এমনকি নাপিতের ক্ষুর করাও বন্ধ। নিয়মিত গীতা পড়তেন। পরের দিকে শুনতেন। তাও বন্ধ।
মাঝে মাঝে বলতেন, এই ঘরে তোমরা আমাকে ঘিরে থাকবে চলে যাবার সময়ে। ওই আসল সুখ।
পাশের
ঘরে স্ত্রী বাতে পঙ্গু। শয্যাশায়ী। মধ্যিখানের দরজার মধ্য দিয়ে দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা
হয়। তবে নার্সিংহোমে যেতে অসীমবাবু আর রাজি নন। ইদানিং কালে বাড়িতে নিজের খাটে শুয়ে
শান্তিতে মৃত্যু কমে গেছে। আরে বাবা স্বাভাবিক মৃত্যুকাল সহ্য করতে শেখো! তা নয়!
অবস্থার একটু এদিক ওদিক হলেই সন্ত্রস্ত হয়ে
স্ট্রেচার অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ছোটাছুটি করে সবাই। ডাক্তার নার্স অচেনা পরিবেশ
নল মুখের মধ্যে ঢোকানো অসহ্য একেবারে! এই তো পাশের বাড়ির পরেশবাবুকে নিয়ে
রাস্তার মোড়ে পৌঁছানোর আগেই উনি নিভে গেলেন। হসপিটাল তো ফিরিয়ে দেবেই! আর দুয়েক
দিন বেশি বেঁচে বা কী হবে! ঘুম ভেঙে চোখ মেলে দেখেছেন কেউ না কেউ উদ্বিগ্ন, তাকিয়ে আছে। ঈশ্বরের সঙ্গে তিনি কথা বলে রেখেছেন।
আজ
সকাল থেকেই দৃষ্টি ঘোলাটে। চোখের মণি উল্টোপাল্টা নড়ছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট। তবে ডাকলে সাড়া দিচ্ছেন। ডাক্তার এলেন দেখলেন
বলে গেলেন অবস্থা খারাপ। অসীমবাবু সব
শুনতে পারলেন। বুঝতে পারলেন। এমন কী হাত তুলে বললেন, সব ঠিক আছে। এভাবেই যেতে দাও!
ঘরময় ফোঁপানির আওয়াজ শুনতে পেলেন।
হঠাৎ
বুঝতে পারলেন লোকের হাতে হাতে তিনি শূন্যে উঠে গেছেন। স্থানান্তরিত হচ্ছেন। প্রচুর কলরব ধাক্কাধাক্কি। চিরকালের
অপছন্দ এক ব্যথাময় ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে দিয়ে তিনি সেই নার্সিংহোমেই যাচ্ছেন
সামাজিক মান রক্ষা করার জন্য।
কামিনী
ফুলের গাছটা তাকে বলল, যাস না! ফিরে আয় কথা আছে।
অসীমবাবু
কামিনী ফুলগাছের দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে একটু হাসার চেষ্টা করলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন