হোলি হ্যায়!
শাকুর মজিদ তখন শ্রীকল্যাণ মজুমদার হয়ে যাচ্ছে। আর আফসানা আলপনা মন্ডল। দ্রুত। খুব
দ্রুত। পলকও কখনও পড়তে
দেরী হয় যে। ভোরের আজান
আজ আর শুনিনি। অথচ তা শুনে
ঘুম ভাঙার পর বিরক্তই লাগতো। সারারাত
জুড়ে আমার মতই কতগুলো ত্রস্ত চোখ ঘর অন্ধকার করে, জানলার বাইরে
তাকিয়ে ছিল। মিলিটারি নামেনি। নামার প্রয়োজন নেই। কেবল পাশের বস্তিটা দাউদাউ করে জ্বলছিলো
যখন,
কেউ এগিয়ে আসেনি। আসার
কথাও না। সংবাদমাধ্যমের
প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়, গতকাল সন্ধ্যের কিছু পর পরই। তখনও বুঝিনি। কী ও কেন? রাজ্যসভায় ওরা বিলটা কোনক্রমে পাশ
করিয়েছে। শুনেছি মাত্র
এক ভোট!
তাতে কী, সংখ্যা গরিষ্ঠ তো! সে
এক হোক আর একশো। গেরুয়া আবীর
উড়ছিলো বিকেল থেকেই। যেন ভোটে জিতে সরকারের ক্ষমতায় আসা...
এখন সকাল আপাতত! নেড়ি কুকুর এ তল্লাটে
প্রচুর। আজ একটাও নেই। দোকান বন্ধ। বন্ধ অঘোষিত। পুড়ে যাওয়া বস্তিটায় প্রায় সাড়ে ছয়শো
লোক থাকত। হাঁটছিলাম। একাই। বাবা প্যারালাইজড। মা আমায় জাপ্টে ধরে রেখেছিলো সারারাত। কেন, অবশ্য জানি না। আর পাঁচজন ডাল ভাত খাওয়া বাঙালীর মতই
আমিও ভীতু। কিছুই করতাম না। এ সময়ে কিছু করা যায় কি'না আদৌ জানি
না।
কোন সময়?
সঠিক বা বেঠিক, সময় আসলেই সময়!
বাবা মার মুখে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার কথা শুনেছিলাম। আমি তখন নিতান্তই ছোট। সেটা রেডিও থেকে ট্রানজিস্টারে শিফট
করার সময়। সারারাত দেখেছিলাম
বাবা কানে ছোট ট্রানজিস্টার লাগিয়ে বসে। বাবা
তো গালি দিতেন না। কেবল বিড় বিড়
করে যাচ্ছিলেন, ফ্যাসিজম যত দ্রুত ছড়ায়, বিদায়
নেয় তার থেকেও দ্রুত। এখন
সকাল। আমার এই সকালের
ফাঁকা রাস্তার পায়চারীর মতই আত্মবিশ্বাসহীন এই পাড়াটা। কেবল দু’ চারটে পাকা বাড়ির বারান্দায়
কারা যেন আসছে, ফের মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। থামলাম কর্পোরেশনের জলের কলটার কাছে। ট্যাপ লাগানো নেই। কতজল যে নষ্ট হয়! না আদতেই হয় না। অন্যদিন
রীতিমত মারামারি করেই জল নেয়, আজ বেবাক, শুনসান। পোড়া
নাইটি,
গামছা, আর ছাই চাপা গন্ধ। এক পাটি হাওয়াই চপ্পলে তখন রক্তটা শুকিয়ে
যাচ্ছে।
মুখ ফেরাতেই দেখি ভুলুকে। কুকুর নিতান্তই। ও কি হিন্দু কুকুর? জানি না। ভুলু তো ভুলুই। শাকুরের পোষা নেড়ি, এটাই জানতাম। এতদিন
জানার প্রয়োজন ও পড়েনি। দেখলাম একটা কাঠের দরজার গায়ে আঁচড় কাটছে, ভেতরে ঢুকতে চাইছে। থামলাম। বিস্কিট যেটা খেতে খেতে বেরিয়েছিলাম, ছুঁড়ে দিলাম। তাকালো
ভুলু। এগিয়ে এলো না। অবিশ্বাস? জানি না। আবার
ওই ভাঙা দরজাটা ঠেলছে, এই পোড়ো বাড়িটায় তো লোক জন থাকে না ভূতের
ভয়ে। আজ কি?
ভুলুর সুবিধা করতে এগিয়ে গেলাম, দরজাটা ঠেলতে। না, খুলছে না'তো! অনেকগুলো নিশ্বাস
এক সাথে পড়ার সমবেত শব্দ পেলাম। কেমন
একটা ভয় পেলাম। গা গুলিয়ে উঠলো। দেখি পুলিশের গাড়ি আসছে। সাথে কোনো মন্ত্রী হয়ত। গাড়ির মাথায় গেরুয়া পতাকা। আমি পেছন ফিরলাম। ফিরে চললাম। দূর থেকে মিছিলের শব্দ কানে আসছে... কারা যেন স্লোগান দিচ্ছে, হিন্দুস্থান কি জয় হো!
ভয় পেলাম আমিও। পালাচ্ছি
কী মনে করে। এরা এখন আমার
প্যান্ট খুলতে বলবে না'তো? দাদুর কাছে শুনেছিলাম ছেচল্লিশের সেই সব গল্প। কেন এত ভয় লাগছে? কেন?
শ্মশান বাড়ির কাছেই। দেখলাম, কারা যেন ‘রাম নাম সত্যা হ্যায়’ বলতে
বলতে মরা নিয়ে ঢুকছে...
সত্য না মিথ্যে এসব প্রশ্ন করার জন্যও অবকাশ লাগে। সেসব ভাবার আগেই দেখলাম আমার দু’পা দৌড় লাগিয়েছে...
আর পেছনে দৌড়ে আসছে কাদের যেন গাড়ি...
এটা ২০২১। গতকাল
লুভ্যর মিউজিয়ামে আত্মঘাতী হামলায় পুড়ে ঝলসে মারা গেছেন শতাধিক পর্যটক। ভ্যাটিকানে আজ পোপের বিশেষ শান্তি প্রার্থনা! ইথিওপিয়ায় আবার জাতিদাঙ্গা ও সামরিক শাসন। খেতে না পাওয়ারা না'কি তেমনই আছেন। ঢাকায় চাপাতি চালিয়ে খুন করা হয়েছে দুই
প্রকাশক ও চার লেখককে। হোয়াইট
হাউস থেকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি সন্ত্রাসবাদকে চিরতরে মুছে দেবার জন্য মিশন ব্লু মুন
সূচনা করলেন।
আজ ৫ মার্চ। দোল। সারা রাস্তা জুড়ে এত লালের আধিক্য, অথচ এতক্ষণ খেয়ালই পড়েনি। জিভ
কাটলাম। দোল কেন হবে! হোলি। হোলি হ্যায়... দৌড়তে দৌড়তেই বলতে লাগলাম হোলি হ্যায়... বাঁচার একমাত্র
পথ…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন