সজনেফুল
আমার ঠাকুরদা ছিলেন জামশেদপুরের একটা কোম্পানির মোটামুটি বড়
সাহেবদের একজন। থাকার জন্য যে বাড়িটা তিনি পেয়েছিলেন সেটা ছিলো বেশ প্রশস্ত। হতেই
হবে। বাবা'রা দশ ভাইবোন।
বেশ কিছু কাজের লোক। নিয়মিত অতিথিদের আসা যাওয়া। ওয়ার্ধা রোডের সেই বাড়িতেই আমার
জন্ম। ছিলুম বছর চারেক বয়স পর্যন্ত। স্মৃতি বলতে কিছু ছবির কোলাজ। তবে সরগরম সেই
বাড়িটা আমাদের পরিবার, যার নাম ছিলো 'দেবায়তন', তার বিপুল বৃত্তের সব সদস্যদের চৈতন্যে আলোছায়ার মতো এখনও আসা যাওয়া করে।
সেসব দিনে সামনের সদর দরজা দিয়ে আসতেন পুরুষেরা। প্রতিবেশী,
আগন্তুক বা অতিথি, যেই হোন। পিছনের দরজা, যার নাম ছিলো খিড়কি দুয়ার, সেখান থেকে বাড়িতে আসতেন মহিলারা বা ফিরিওয়ালা অথবা কাজের লোকজন। সেই
পিছদুয়ারের দুদিকে ছিলো দুটো সজনে গাছ। ফলন্ত। ফুল, ডাঁটা, শুঁয়োপোকা, সব কিছু নিয়েই
দ্বারপালের মতো তাদের সবুজপাতাগুলি হাওয়ায় ওড়াউড়ি করতো। উঠোনের এককোণে দাঁড়িয়ে
থাকা রাজসিক কাঁঠাল গাছটির মতো গরিমা
তাদের ছিলো না ঠিকই। কিন্তু তাদের গর্ব ছিলো শীতের শেষে রুখু হাওয়ায় ভরে যাওয়া
শাদাফুলের গয়নাগাঁটি।
পাশের বাড়ি থাকতেন ঘোষবাবু। দাদুর সহকর্মী। পদ্মাপারের
মানুষ। স্বদেশচ্যুত হয়েছিলেন অল্পদিন আগেই। তাঁর মা কিছুতেই ভুলতে পারতেন না
দ্যাশবাড়িতে ফেলে আসা ফলন্ত সজনেগাছগুলিকে। তাঁর নাতিদের নাম ছিলো বীরেন,
নরেন। তাঁরা ডাকতেন বিরেইন্যা, নরেইন্যা। আমাদের চোদ্দোপুরুষের নৈকষ্য,
মার্জিত ঘটি জিভে অমন ঘাতপ্রবল উচ্চারণ ধরার ধক ছিলো না।
বাবা-কাকাদের সহপাঠী সেই সব বন্ধুদের তাঁরা ডাকতেন বিরেনিয়া,
নরেনিয়া বলে। শুনেছি বাঙালবাড়ির মেয়ে আমার মা বিয়ে হয়ে আসার
পর অমন 'উশ্চারণ'
শুনে হেসেই খুন। তা সে ঘোষবাবুর মা, প্রায় আশি ছুঁইছুঁই মানুষটা মাঝেমাঝেই আসতেন সজনেগাছে কত
ফুল ধরেছে দেখতে। আমাদের গোবর্ধনঠাকুরকে জিগ্যেস করবেন একটাই প্রশ্ন। "অ ঠাকুর, তোমাদের এই গাছটা সজনা না নাজনা গো?" মেজাজ ভালো থাকলে বাঁকুড়া জেলার শ্যামসুন্দরপুর গ্রাম থেকে
আসা আমাদের সাবেক গোবর্ধনঠাকুর কিছু ফুল পেড়ে দিতেন সেই বৃদ্ধার জন্য। নয়তো
বাঁকুড়ার ভাষায় অসন্তোষ প্রকাশ করতেন নিত্যদিন একই প্রশ্ন করার জন্যে। তখনও
জামশেদপুরের সবজিবাজারে সজনে ফুল বিক্রি হতো না। যদিও সিংভূমের মাটিতে চিরকাল সজনে
সাম্রাজ্যের রমরমা।
বাবার সঙ্গে যখনই আমাদের 'বাড়ি' যেতুম ছোটোবেলায় খড়্গপুর থেকে ঝিকঝিক ইস্টিম গাড়ি, গোমো প্যাসেঞ্জার। জানালা থেকে কয়লার গুঁড়ো চোখে,
মুখে, চুলে, জামায়।
টেলিগ্র্যাফের অনন্ত টানা তার। ফিঙে দুলছে। গ্রাম এলে ঘুঘু-শালিক-চড়াই। আর যতদূর
চোখ যায় রাঢ়বাংলার হলুদ-ধূসর প্রান্তর জুড়ে বেঁটে বেঁটে খেজুরগাছ আর সজনেগাছের
ভাসাভাসি। বাড়ি পৌঁছোলে দিদা কাজের মেয়েকে ডেকে বলবেন, "ও দেবীর মা। কাল সজনেফুল পেড়ে এনো। ঘন্ট হবে।" তিনি
জানতেন তাঁর মেজোছেলে সজনেফুলের পাগল। দেবায়তনে কেউ মাছ ভালোবাসে না। কিন্তু শাকসবজি
মাশাল্লাহ। আর পোস্ত। যতভাবে হতে পারে। সজনেফুল মানে রাজভোগ।
বাল্যকালে আমাদের এগ্রিকো কলোনির বাড়ির উঠোনে ছিলো ফলন্ত
একটা সজনে গাছ। তার প্রতিবেশী ছিলো ফলহীন একটি কলাগাছ। মাঝে মাঝে তার পাতা কেটে
গরমভাতে ঘি দিয়ে খেতুম আমরা। কিন্তু চৌষট্টি সালের দুর্ভিক্ষে আট আনা সেরের চাল
হয়ে গেলো চার টাকা। ভাত আর কোথায়? মানুষ আটা, মাইলো,
বাজরা খেতে শিখলো। শিখলো কর্ডনিং, চালপাচার, দেশি পুলিশের বেটনবাজি। শিখলো কী আর? তিন বছর পরেই তো নকশাললবাড়ি। সজনেগাছে বসন্তের শুঁয়োপোকা ডিঙি মেরে ওঠানামা
করে।
প্রথম যখন জাদুগোড়ায় থাকতে যাই, ইউসিল কলোনির প্রতিটা বাড়িতে দেখি চার-পাঁচটা সজনে গাছ।
কিন্তু দু’চারটে গাছ ছাড়া ফুল আর দেখা যায় না। বৃষ্টির মতো শুঁয়োপোকা। মানুষ সজনের
ডালপালা কেটে দিয়ে গোবর লেপে দেয়। নয়তো পোকা এসে ঘরে ঢুকে যাবে। বুধবারের সবজিহাটে
কখনও সখনও চাণ্ডিল-সুইসা থেকে কোনও রসিক পাইকার সজনেফুল নিয়ে আসে। পড়তে পায় না।
পলকে শেষ হয়ে যায়। আমার প্রথম সংসার করতে আসা নতুন বৌ ছ’মাসের শিশুকে সামলে
হাসিমুখে সজনেফুলের ঘন্ট বানায়।
অনেকদিন পর যখন পাটনায় যাই আবার সজনের অরণ্য দেখি গঙ্গার
ঈর্ষণীয় পলিমাটির টানা খেতখামারে। মাঝেমাঝে মিঠাপুরের গুমটিবাজারে কেউ কেউ নিয়ে
বসে সজনেফুল। ইয়ারপুর-গরদানিবাগের বঙ্গালি দাদারা সজনেফুল পেলে লুটে নিয়ে যায়।
বিহারিরা সজনেফুল খায় না। তাই দাম কখনও আকাশ ছোঁয় না। পাড়াতেই তো অনেক গাছ। ফুলের
ভারে নুয়ে থাকে। কিন্তু সে কী আর 'চুরি' করা যায়?
কিন্তু একদিন দেখি বাড়িতে প্রায় একটা পুরো সজনেগাছ। ফুলে
ফুলে ভরা। শুনি মেয়েকে ইশকুল থেকে আনতে গিয়ে দেখা গেলো কেউ একটা গাছ কেটে পথে ফেলে
দিয়েছে। আমার ডানপিটে ছ'বছরের ছোট মেয়ে আর তার মা টানতে টানতে সব ফুলন্ত ডালগুলোকে বাড়ি নিয়ে এসেছে।
তবে একটু ভয়ে ভয়ে আছে। হয়তো গাঁইয়াপনা দেখে আমি বকবো। কী আর বলি?
আমার অগ্রজ সহকর্মী তখন রিজিওন্যাল ম্যানেজার। মাসে কয়েকবার
ব্রাঞ্চ ভিজিটে যেতে হয়। কখ্নও বিক্রম, কখনও পালি, কখনও বা মসৌড়ি
হয়ে গয়ার পথে। জাহানাবাদ বা নবিনগরও তো রয়েছে। গঙ্গা থেকে
দক্ষিণে বয়ে যাওয়া পুনপুন নদীর অববাহিকায় এই সব বদনাম বস্তি। যে সব জায়গায় বিকেল
পাঁচটার পর রাস্তায় কুকুরও বেরোতে ভয় পায়। কিন্তু ব্রাঞ্চ ম্যানেজারেরা জানে 'সাহব দিল কা সচ্চা হ্যাঁয়।' বকুনিটকুনি খাবার পর শুধু বলতে হবে “সর,
ডিকিমেঁ রখ দিয়ে”। “ক্যা রখ দিয়া ভই?” “ওহি সর, সহজন কা
ফুল...”
অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, মরাঠাওয়াড়া,
তামিলনাড়ু'র পথে পথে গাড়ি নিয়ে ঘুরেছি অন্তহীন। প্রান্তরময় ভরে আছে বসন্তের সজনেফুলে, ঝিলমিল নীলদিগন্ত।
ব্রাহ্মণী শুধু বলেন, "ইশ,
এতো ফুল, এত্তো ফুল!! এক্কেবারে ফ্রেশ। একটু দাঁড়াও না। নিয়ে আসি।" কে বোঝাবে
কোথায় তাঁর রান্নাঘর, কোথায় এই
পলাশির প্রান্তর। যুক্তিই যদি মানবে তবে আর ভালোবাসা কোথায় রইলো?
আমি আর আমার বস মিটিং করতে গিয়েছি পারাদ্বীপ। আমরা তো
সক্কাল সক্কাল দেশোদ্ধার করতে বেরিয়ে
গিয়েছি। আমাদের ব্রাহ্মণীদ্বয় বেরিয়েছেন দেশ দেখতে। চোখে পড়ে গেছে গ্রামের প্রতিটি
বাড়িতে ফুলের ভারে রাশি রাশি সজনেগাছ ঝুঁকে পড়েছে। দুজনেই পুলকিত। বেশ কিছুদিনের
রসদ জোগাড় হয়ে গেছে। ড্রাইভারকে বলেন, যাও খোঁজ নাও। কত দাম? ড্রাইভার অনেক ঘুরেফিরে এসে জানায় সব গাছ জমা দেওয়া আছে। সজনেডাঁটার পাইকারদের
কাছে। ফুল দিতে চাইছে না। তাঁরা রণে ভঙ্গ দেন। ভাগ্যিস আমাদের বলেননি,
ব্রাঞ্চ ম্যানেজারদের বলে একটা ব্যবস্থা করে দাও।
এই তো সেদিন ব্রাহ্মণীর এক বাল্যবান্ধবী এলেন। দীর্ঘদিন ধরে
বম্বের তেলেজলে ডুবে আছেন। আসার আগেই ফরমান, সজনেফুল খাওয়াতে হবে। কিন্তু তখনও সরস্বতীপুজো হয়নি। অনেক খুঁজেও কোথাও পাওয়া
গেলো না। আমি তাঁকে শুধো'ই মহারাষ্ট্রের সর্বত্র এত সজনেগাছ দেখেছি। কেন বম্বেতে ফুল পাওয়া যায় না?
তিনি বললেন এটা একটা রিসার্চের বিষয় হতে পারে। কিন্তু ঘটনা
এরকমই। যেমন সারা উত্তর অন্ধ্রে কাঁঠালের অরণ্য মাইলের পর মাইল। কিন্তু ওখানে
কোথাও এঁচড় পাওয়া যায় না। শুধু পাকা কাঁঠালের দৌরাত্ম্য। সব এঁচড় রফতানি হয়ে যায়
কলকাতায়, ভুবনেশ্বরে।
রাঁচি গিয়েছিলুম একটা বিয়েবাড়িতে। ঘোর বসন্তকাল। কিন্তু
রাঁচিতে এইসময় শীতের রেশ কাটে না। রোদ মিঠে, হাওয়া রুখু, লোকের গায়ে গরমজামা। কিন্তু ফাগুন মাস। দুপুরের ট্রেনে ফিরবো ভুবনেশ্বর।
সক্কালবেলা চলে যাই টেগোরহিল। ফেরার পথে আপারবাজার থেকে হাটিয়া স্টেশন যাবো। পথে
কাছারি আর আমাদের জোনাল অফিস। একসময় ঐ অফিসে আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বসতেন।
ভয়ে ভয়ে ঢুকতুম ঐসব থমথমে অফিসঘরে। যখন থেকে নিজেই সেই সব ঘরে বসতে শুরু করেছি,
একটা পরাবাস্তব অনুভূতি হয়। এইসব টেবিলের উল্টোদিকে
দুরুদুরু বুকে বসে হুজুরদের মুড বুঝতে কত মুহূর্ত চলে গেছে। কিন্তু নিজেই যে কখন
হেড'অফিসের বড়বাবু হয়ে গেছি, মনেও থাকে না। অনুভূতিটা তবু
ঘুমিয়ে আছে কোথাও।
তা সেই অফিসের সামনে বেলা একটায় সারা রাঁচির ট্র্যাফিক
দৌড়োদৌড়ি করছে। অটো করে যেতে যেতে দেখি রাস্তার ধারে বস্তা পেতে বিক্রি হচ্ছে,
হ্যাঁ সজনেফুল। ভাবতে ভাবতে অটো ছুটে এগিয়ে গেছে অনেকটা।
কিন্তু তাকে থামাই। দৌড়ে যাই ফুলের কাছে। কিন্তু তাজা নয়। একটু শুকনো লাগছে তাদের।
হয়তো কালকের তোলা। ডালপালাও বেশি। পরিষ্কার করেনি ভালো করে। তবু নিয়েই নিই
সেরখানেক। অনেকটাই তো ফেলা যাবে। বাড়ি ফিরে খেতে খেতে আরো অন্তত দু'দিন। কিন্তু ছাড়া গেলো না।
কয়েকদিন হলো বাজারে সজনেফুল উঠেছে। কলকাতায় দেখি একশো
গ্রাম-দুশো গ্রামের হিসেবে সব কিছুই পাওয়া যায়। পাটনায় আন্টাঘাট সবজিবাজার আমার
দেখা বৃহত্তম তরিতরকারির বাজারের মধ্যে একটা। সেখানে কোনও সবজি এক পসেরি'র কমে পাওয়া যায় না। পসেরি মানে পাঁচসেরি। দয়াপরবশ হয়ে কেউ
কেউ আধা'পসেরি,
অর্থাৎ আড়াইসের পর্যন্ত দিতে রাজি হয়। তার কমে নয়। তাই সই।
গঙ্গার নদীদ্বীপ, যার নাম
দিয়ারা, মাটি নয়তো
পুরো সোনা। সেসব সব্জি,কী চেহারা, কী স্বাদ! আধা পসেরি হি সহি। হায়দরাবাদে গুড়িমালকাপুরের বিশাল সবজিআড়তে কখনও কখনও কাঁচালংকা
বিশ টাকা সের। তার অবশ্য 'লংকাত্ব' বিশেষ নেই।
লোকে মির্চি কা সালন বানাতে কিনে নিয়ে যায়। আমাদের পাড়ায় একশো-দুশো গ্রামের
হিসেবেও সব্জি উপলব্ধ হ্যাঁয়। সজনেফুল ছিলো পঁচিশ টংকা শ'গ্রাম। কমে পনেরো হয়েছে।
ব্রাহ্মণী বেড়ে দেন। আর কী নেবে?
বলি, দাঁড়াও এটা শেষ করি আগে। এখানকার সজনেফুলের গন্ধ চমৎকার।
তিনি উদাস হয়ে বলেন, ভাবো বাবা
পেলে কত খুশি হতেন!
বলি, কেন? মা'ও তো শুধু সজনেফুল দিয়েই ভাত শেষ করে দিতেন। তোমরা দেখোনি
সেসব দিন। আমাদের রোজ মাছ খাবার সঙ্গতি ছিলো না। ডিমও দু'ভাগ, চারভাগ... কিন্তু আমাদের খুশি তো কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনি। কত আনন্দের বীজ
শিমুলতুলোর মতো আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াতো। ধরতে পারলেই হলো...
মনে পড়ে তোমার? সজনেফুল?