দুরন্ত এক ঝড়ের নাম রবীন সেনগুপ্ত
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ত্রিপুরা রাজ্যের বিশিষ্ট ‘যুদ্ধচিত্র
সাংবাদিক’ রবীন সেনগুপ্ত
চলে গেলেন। ভারতের নানা জাতীয় স্তরের পত্রিকায় সংবাদ শিরোনামে গর্বের সঙ্গে তাঁর
যাবার সংবাদ উল্লেখ করা হল আন্তর্জাতিক সংবাদে। The Hindu পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম “Veteran ‘war’ photo journalist
Rabin Sengupta dies”। সাংবাদিক সৈয়দ
সাজ্জিদ আলি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে
12.37 মিনিটে সংবাদ The Hindu - এর নিউজ রুমে প্রেরণ করলেন। ভারতের স্বল্প সংখ্যক 'ওয়ার' সাংবাদিকের
অন্যতম রবীন সেনগুপ্ত, যিনি 1971 সালের
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর সুবিস্তৃতভাবে
পরিবেশন করেছেন তাঁর চিত্র সাংবাদিকতায়। সে সংবাদ প্রেরণ করা হয় 7
ফেব্রুয়ারি, 2017 তারিখে। তাতে বলা হল
রবীন সেনগুপ্ত আগরতলায় 87 বৎসর বয়সে পরলোকগত হয়েছেন।
রবীন সেনগুপ্ত মঙ্গলবার সকালে আগরতলার জি.বি.পন্থ হাসপাতালে
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ডেইলী দেশের কথা পত্রিকায় বলা হয়েছে তাঁকে আগরতলার আই এল এস হাসপাতালে আগের দিন ভর্তি করা হয় এবং
পরদিন অর্থাৎ সাত ফেব্রুয়ারি সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি বার্ধক্যতাজনিত সমস্যায়
ভুগছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ চিত্র সাংবাদিকের মৃত্যুসংবাদ উত্তর পূর্বাঞ্চলের মিডিয়া
সার্কেলে গভীর শোক ও বেদনার সৃষ্টি করেছে বলে অনুমান করা হয়। সর্বভারতীয় অন্যান্য
পত্রিকা যেমন দি টাইমস অফ ইণ্ডিয়া, টেলিগ্রাফ প্রভৃতিতেও যেমন, তেমনি
ত্রিপুরার নানা স্থানীয় পত্রিকায়ও বিশদভাবে রবীন সেনগুপ্তের প্রয়াণের সংবাদ
শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে।
রবীন সেনগুপ্ত 1930 সালে আগরতলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন
ত্রিপুরা একটি রাজন্যশাসিত স্বাধীন রাজ্য এবং তাঁর জন্মের বহু পরে 1949
খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ত্রিপুরা স্বাধীন ভারতের সঙ্গে যোগদান করে। রবীন
সেনগুপ্তের পূর্বপুরুষেরা ঢাকার বৈদ্যবংশীয় ছিলেন। পাহাড় লুঙ্গা অরণ্যানী আর ছোট
ছোট নদী ছড়া নিয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যটি মনোরম। এই ত্রিপুরা রাজ্যে
1840 খ্রিস্টাব্দে রবীন সেনগুপ্তের পূর্বপুরুষ সূর্যমণি সেনগুপ্ত ঢাকার বিক্রমপুর
থেকে তখনকার ত্রিপুরার রাজার আমন্ত্রণে এই রাজ্যে বসবাস করতে আসেন। তিনি ছিলেন
একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক তথা বৈদ্য। তখন ত্রিপুরার রাজা ছিলেন কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য।
ত্রিপুরায় নানারকম ভেষজ লতাপাতা, জড়িবুটির
প্রাচুর্য দেখে সূর্যমণি মুগ্ধ হয়ে এখানে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর পরবর্তী
প্রজন্মের বংশধরগণও ত্রিপুরাকে মানিয়ে নিয়ে ভালবেসে ফেলেন। পূর্বজ সূর্যমণির
সুবাদে রাজপরিবারের অন্দরমহলে প্রবেশ করার অধিকার পরবর্তীতে তাঁরা পান এবং
সেখানকার জাঁকজমক জৌলুস আর সুন্দরী রাণী রাজকন্যাদের দেখে অল্পবয়েসী রবীন
সেনগুপ্তের চোখ যেন ঝলসে যায়। রবীন সেনগুপ্তের পিতা প্রফুল্লচন্দ্র সেনগুপ্ত পি.সি.সেন নামে অধিক খ্যাত ছিলেন। তিনি সু্দক্ষ
ফটোগ্রাফার ছিলেন। ফটোগ্রাফি বিদ্যায় তাঁর পারদর্শিতা ছিলো। পিতার কাছেই এই
বিদ্যায় রবীন সেন শিক্ষা পেলেন। পি.সি.সেন মহাশয় আধুনিক জাদুবিদ্যায় শখের জাদুকর
ছিলেন। তাঁকে ত্রিপুরার আধুনিক জাদুর আদি পুরুষ বলা হয়। যাইহোক ফটোগ্রাফিতে তাঁর
দক্ষতা প্রবাদতুল্য ছিলো। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা রমেশকে নিয়ে 1910 সালে 'সেন এণ্ড সেন' নামে স্টুডিও স্থাপন করেন। এদিকে রমেশের ফটোগ্রাফিতে গভীর ঔৎসুক্য ছিলো আর
তাঁর উৎসাহ রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের পুত্র সম্বরণচন্দ্র দেববর্মার
অনুপ্রেরণায় দিনদিন বাড়তে লাগলো। মহরাজ বীরচন্দ্র দক্ষ চিত্রশিল্পী ছিলেন। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির
প্রতি তাঁর অনুরাগ সর্বজন বিদিত।
পড়াশশোনা শেষ করে রবীন সেন স্টুডিও পরিচালনার দায়িত্ব নেন।
স্টুডিওটির তখন তিনটি শাখা। কিন্তু এতে
তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাঁর
অন্তরাত্মা কী চায় তা তাঁর অজানা ছিলো না।
তাই তাঁর প্রিয় রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে যেতেন এবং ছবির পর ছবি
তুলতেন। 1952 সাল থেকে তাঁর ফটোগ্রাফ আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার, যুগান্তর, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড এসব পত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগলো।
স্মৃতি থেকে রবীন সেনগুপ্ত জানিয়েছিলেন তাঁর প্রথম প্রকাশিত ফটোগ্রাফটি ছিলো
ভূট্টা খেতে কর্মরতা এক আদিবাসী বালিকার। ছবিটিতে মানব চরিত্রের মাহাত্ম্য ও
শ্রমের মর্যাদার যৌথ বন্ধন সূচিত হয়েছে। তিনি জীবন জোড়া কঠোরতর সত্যের মুখোমুখি
রুখে দাঁড়িয়ে গেছেন। 1971 সালে সমগ্র বাংলাদশে ব্যাপকভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
শত্রুপক্ষের ভয়ঙ্কর পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা ও
নিষ্পেষণের মধ্যে একটা জাতি প্রাণপণে সংগ্রাম করে কীভাবে গড়ে উঠছিল তা তিনি দেখেছেন।
তিনি আরো দেখেছেন কি দুর্গতির চরমে মুক্তিবাহিনীকে যেতে হয়েছে, সহায়ক ভারতীয় বাহিনী কতখানি বিপর্যস্ত হয়েছে। অবশেষে মুক্তিবাহিনীর বিজয় হলো, রক্তে রাঙা সূর্যের মত উদিত হলো একটা দেশ — বাংলাদেশ! একটি অরণ্য অঞ্চলে বিশালাকার ও ফ্রেমে আবদ্ধ একটি বক্তব্যরত
প্রতিকৃতিকে ট্রেণিং ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর ক্যাডাররা স্যালুট জানাচ্ছে, এমন একটি
ফটোগ্রাফ রবীন সেনগুপ্ত তুলেছিলেন। যুব
সেনানীদের মুখমণ্ডল ইস্পাতদৃঢ় ও ভাবাবেগরহিত, এ যেন যুবশক্তির ক্ষতবিক্ষত মুখাবয়বের প্রতীকী রূপায়ন যাতে সহজ সারল্যের
লেশমাত্র নেই।
রবীন সেনগুপ্ত রাতদিন এক করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়
যুদ্ধক্ষেত্রে চরকির মত ঘুরে বেড়িয়েছেন, তথ্যপূর্ণ ফটোগ্রাফ তুলেছেন। বর্তমানে যে 'embedded photojournalism' অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে চিত্র সাংবাদিককে পাঠানো আর
তাদের কর্তৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে ছবি তোলার রীতি প্রচলিত হয়েছে, সেনগুপ্ত তার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর মতে এতে চিত্র
সাংবাদিককে প্রকৃত সত্য থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপরে তাঁর
লেখা বই 'চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরায় মুক্তিযোদ্ধা' বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মান
প্রদর্শন করেন এবং পুরস্কৃত করেন। এছাড়াও তাঁর অন্য একটি বই ঢাকা থেকে প্রকাশিত
হয়েছিল।
ফটোগ্রাফি সেনগুপ্তকে বহু স্থানে নিয়ে গেছে। সেসব স্থানের
প্রকৃতি,
বৃক্ষলতা, অরণ্যানীর আর
মানুষ অকপটে তাঁর ক্যামেরাবন্দি হয়েছে। মানুষের ভালবাসা তাঁকে ধন্য করেছে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন
ও ব্রাজিলে গেছেন তিনি। 1959 সালে ব্রাজিলের একটি ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় তিনি
স্টিল ফটোগ্রাফিতে প্রথম স্থান পেয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি ও স্বীকৃতি আদায়
করে নিলেন। মস্কো থেকে এই প্রতিযোগিতার পুরস্কার নেন তিনি। সারাদেশের পত্রিকায়
সেদিন কী উল্লাস, কী আনন্দ! তিন
বছর পর গ্রেট ব্রিটেনের 'রয়্যাল
ফটোগ্রাফি সোসাইটি'- এর সদস্যপদ
লাভ করেন।
একজন সমর্পিতপ্রাণ মার্কসবাদী হলেও জওহরলাল নেহেরু ও
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচিতি ও হৃদ্যতা ছিলো। জ্যোতি বসু এবং ই
এম এস নাম্বুদ্রিপাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা
ও ভালবাসা ছিলো। চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এতো ঘনিষ্ঠতা ছিলো যে তাঁর
অনেক ছবি তাঁর আর্কাইভে ছিলো।
রবীন সেনগুপ্তকে একটা পরিচিতির
ফ্রেমে এভাবে বাঁধা যায়' যুদ্ধচিত্র
সাংবাদিক,
চলচ্চিত্র নির্মাতা, বিশেষ করে ডকুমেন্টারী ফিল্ম নির্মাতা, সুলেখক, প্রাবন্ধিক, সংবাদপত্রে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে
ধারাবাহিক লেখক, চিত্র সংগ্রাহক, বামপন্থী রাজনীতি বিশেষজ্ঞ, দরদী বার্তালাপকারী এবং সর্বোপরি মানবদরদী ও অগাধ মানবপ্রীতি সম্পন্ন মানুষ
তিনি। রাজ্যের উমাকান্ত একাডেমি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিনি।
মৃত্যুকালে স্ত্রী, এক পুত্র ও এক
কন্যা রেখে গেছেন তিনি। 1949 সালের 27 জানুয়ারি সরকারের খাদ্যনীতির বিরুদ্ধে
ছাত্ররা যে ভুখা মিছিল করে, তাতে পুলিশ
নির্দয়ভাবে লাঠিচার্জ ও গুলি চালায়। একমাত্র সেনগুপ্তের দেহে দুটি গুলি লাগে।
নির্ভীক মানুষ ছিলেন তিনি। 1956 সাল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। আদিবাসীদের
নিয়ে তাঁর রঙীন ছবি 'দি টেলস অব
ট্রাইবেল লাইফ অব ত্রিপুরা' দেশবিদেশে
প্রশংসা পায়। তিনি লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী, গ্রিমসেস অব
ত্রিপুরা ছবিগুলিও করেন। তাঁর বহু বিচিত্র জীবন কথা সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রকাশ
অসম্ভব। এই 'গ্রেট' মানুটির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে শেষ কথা বলবো, তাঁর
ফটোগ্রাফ,
ফিল্ম, ডকুমেন্টারী
সহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী সরকারি উদ্যোগে আগরতলা মিউজিয়ামে সংরক্ষণের ব্যবস্থা
করা প্রয়োজন। অনেক কিছু নাকি এখনই নষ্ট হয়ে গেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন