সমকামিতার
চতুষ্কোণ
দেশ ও কালভেদে সমকামিতার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন স্তর পরিলক্ষিত হয়েছে। সমকামী সম্পর্ককে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক বলে মনে করা, এর প্রতি সামাজিক উদাসীনতা, সাধারণ সহনশীলতা বা তীব্র অসহনশীলতা, একে একপ্রকার লঘু পাপ হিসেবে গণ্য করা থেকে শুরু করে আইন প্রণয়ন ও বিচারব্যবস্থার সাহায্যে এর অবদমন এবং মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজ সমকামিতাকে গ্রহণ বা বর্জন করেছে।
প্রাক্-শিল্পায়ন সংস্কৃতিসমূহের ঐতিহাসিক ও জাতিতত্ত্বগত নমুনার একটি সুপরিকল্পিত সংকলনে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী সমীক্ষাধীন ৪২টি সংস্কৃতির ৪১ শতাংশে সমকামিতার প্রবল বিরোধিতার নমুনা পাওয়া গেছে; ২১%এর পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, আর ১২%
জানিয়েছে, তারা এমন কোনো ধারণার সঙ্গে পরিচিত নয়। সমীক্ষাধীন ৭০টি জাতির মধ্যে ৫৯%
জানিয়েছে, সমকামিতা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত বা বিরল। এবং অবশিষ্ট ৪১%এর মতে তা উপস্থিত বা
'বিরল নয়'। সমকামিতা শব্দটিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। অনেকেই স্বীকার করতে চান না ৷ আমার ধারণা, এই যে শতাংশ মানুষ সমকামিতার বিপক্ষে কিংবা তারা আদৌ পরিচিত নন, এটার একটি কারণ সমাজতত্ত্ব ও মনোসত্ত্ব ৷
চীনে সমকামিতাকে ‘কাটা পীচের প্রণয়’ এবং আরও বিভিন্ন উপমার মধ্য দিয়ে কমবেশি খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকেই ইতিহাসে স্থান দেওয়া হয়েছে। চীনা সাহিত্যের বহু বিখ্যাত কাজকর্মে সমকামিতার উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান পর্যালোচকদের কাছে ধ্রুপদী উপন্যাস ‘লাল ঘরের স্বপ্ন’-তে বর্ণিত সমসাময়িক সমকামী ও বিপরীতকামী প্রেমের বর্ণনা সমান স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয়। কনফুসীয় ধর্ম মূলত একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন হওয়ার ফলে এতে সম বা বিপরীত কোনো রকম কাম সংক্রান্ত বিস্তৃত বিধিনিষেধ নেই। বিয়ান এর চাই প্রভৃতি মিং সাহিত্যকীর্তিতে সমকামী প্রণয়কে বিপরীতকামী প্রণয় অপেক্ষা অধিক উপভোগ্য ও অধিক ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। লিউ সুং রাজবংশের আমলের লেখক ওয়াং শুনু দাবি করেছেন যে, তৃতীয় শতাব্দীর শেষভাগে সমকামিতা বিপরীতকামিতার মতই বহুপ্রচলিত ছিল।
মধ্যযুগে তাং বংশের শাসনকালে চীনে সমকামিতার প্রতি বিরূপতার সূচনা হয়। এর মূলে ছিল খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের আবির্ভাব। তবে এই বিরূপতা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পায় মাঞ্চু আমলে পাশ্চাত্যকরণ ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
সাম্প্রতিক কালে নবলব্ধ সামাজিক সহনশীলতা এবং টোকিও, ওসাকা প্রভৃতি মহানগরে বিকল্প যৌনতার মানুষদের তথাকথিত ‘মুক্তাঞ্চল’ জাপানে বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও জাপানে সমকামীরা প্রায়ই তাঁদের যৌন পরিচয় গোপন রাখতেন; অনেকে বিপরীত লিঙ্গের সাথে বিবাহবন্ধনে সম্মতি দিতেন। সমলৈঙ্গিক বিবাহ জাপানে আইনসম্মত নয়। জাপান টাইম্স-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এই বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিতর্কও হয় না।
সমকামিতা এমন এক বিষয় যার ব্যাখা প্রাচীনকাল থেকে এখনও অবধি খোঁজার চেষ্টা চলে আসছে ৷ নারী, পুরুষ সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সমকামিতা বর্তমান ৷ তবুও এ নিয়ে বিচার, বিশ্নেষণ আলোচনা চলে আসবে ৷ পরিসংখ্যান দিয়ে ঢাকা হবে, কিন্তু নির্মূল হবে না ৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন