সমকামিতার চতুষ্কোণ
(দুই)
‘কাম’ শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে বৈধতা। বৈধতা এই কারণে বললাম,
আমাদের ছোটবেলায় অনেককেই দেখেছি বাবা-মা 'র সামনে বসে সিনেমা দেখার অনুমতি অবধি ছিল না। আলোচনা তো অনেক দূর। লুকিয়ে দেখতে হতো সিনেমা। মহাভারত কিংবা রামায়ণ টিভিতে দেখার সময়
বিজ্ঞাপনে যদি যৌনতার উস্কানিমূলক কিছু অংশ থাকত, তবে চ্যানেল পরির্বতন করে দেওয়া
হতো। আসলে যৌনতা জীবনের একটা অঙ্গ এটা ভাবতে
শেখানো হয়নি, তা স্কুল থেকেই হোক কিংবা সমাজ থেকে। আজকাল ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে
জীবনশৈলী পড়ান হয়। শেখানো হয় জীবনের সময়ের প্রবাহমানতকে। ছেলেমেয়ে বড় হবার সাথে
সাথে তাদের মানসিক গঠন যে দরকার, তা বোঝেন
আজকের মা-বাবা’রা। এ
প্রসঙ্গে আমার বাড়ির উল্টোদিকে এক
পরিবারের ঘটনা বলি, যার জন্য আমার এই বিষয় নিয়ে লেখা। এই পরিবারে একটি মাত্র
মেয়ে, নাম তমসা। ছোট থেকেই ভীষণ ভালো সে পড়াশোনায়। কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজম ও মাসকমিউনিকেশন
নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে দিল্লীতে। বাবা-মা’র আদরের মেয়ে একদিন ঘোষণা করে, বিয়ে সে করবে না। কলকাতার বহু বন্ধুবান্ধব তার সাথে যোগাযোগও করে কারণ জানার জন্য। প্রত্যেককে সে
একই কথা বলে, বিয়ে করার জন্য মানসিক ভাবে সে প্রস্তুত নয়। তমসার মা-বাবা তাকে না
জানিয়ে একদিন তমসার দিল্লীর ফ্ল্যাটে
গিয়ে দেখেন, সে একটি মেয়ের সাথে থাকতে শুরু করেছে। এবং সে জানায়, তারা
একসাথেই থাকবে। বাবা-মা’র
প্রবল চাপে তমসা সুইসাইড করতে অবধি যায়। শেষে অসহায় মা-বাবা ফিরে আসেন।
আমাদের দেশে যদিও এখনও সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেয়নি সে অর্থে, তবুও সচেতনতা বাড়ছে। পাশ্চাত্য দেশে ব্যস্ততম জীবনযাত্রায়
সমকামিতার প্রকোপ বেড়ে চলছে ক্রমাগত। আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের আগে দ্বৈত
সত্তাবিশিষ্ট মানুষদের কেন্দ্র করে সমকামিতার বিশেষ একটি প্রকারের আকর্ষণ লাভ
করেছিল। সাধারণত এই ধরনের মানুষদের ছোটবেলাতেই শনাক্ত
করা হতো। তার মা-বাবা তাকে উক্ত স্বীকৃত
পথে জীবন কাটানোর প্রস্তাব দিতেন, আর সন্তান
সম্মত হলে তাকে সঠিক পদ্ধতিতে পালন করে তার নির্বাচিত লিঙ্গের জন্য নির্দিষ্ট
আচারের শিক্ষা দেওয়া হতো। দ্বৈত সত্তার মানুষেরা সাধারণত শামানের স্থান লাভ করত এবং সাধারণ শামানদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাশালী বলে গণ্য
হতো। তাদের
যৌনসঙ্গী হতো গোষ্ঠীর অন্যান্য সমলিঙ্গের সদস্যেরা। এইভাবে চলত জীবন। আসলে সমমনোভাবাপন্ন
মানুষরা যখন এই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠল, গড়ে উঠল গোষ্ঠী অর্থাৎ সমষ্টি। এক সমষ্টি থেকে আর এক সমষ্টি নির্বাচনের ভিত্তিতে সঙ্গী নির্বাচন, এমনকি বিবাহ অবধি হয়ে থাকত।
লাতিন আমেরিকার প্রাক্-ঔপনিবেশিক বিভিন্ন সভ্যতা, যথা আজটেক, মায়া, কেচুয়া, মোচে, জাপোটেক এবং ব্রাজিলের টুপিনাম্বা জনজাতির মধ্যে প্রকাশ্যে সমকামী ও রূপান্তরকামী ব্যক্তিবর্গের বসবাস ছিল।
স্পেনীয় বিজেতারা স্থানীয় সমাজে অবাধ ‘সডোমি’ উদ্যাপন দেখে ভীত হয়ে তা নির্মূল
করার বিশেষ চেষ্টা করে। এই চেষ্টার মধ্যে
ছিল জনসমাগমে মৃত্যুদণ্ড, পুড়িয়ে মারা
এবং অভিযুক্তকে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো। সুতরাং যতই পাশ্চাত্য মহাদেশে সমকামিতাকে স্বীকৃতি দিক না
কেন, একে নিয়ে বর্বরতা শেষ নেই। এবং এই বর্বরতার পরিণতি মৃত্যু অবধি ছিল।
তবে অতীত কিন্তু অন্য কথা বলে। আব্রাহামীয়
ধর্মসমূহের দ্বারা প্রভাবিত সংস্কৃতিসমূহে আইন ও গির্জা কতৃক সডোমিকে ঐশ্বরিক
বিধানের পরিপন্থী তথা প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পুরুষদের মধ্যে পায়ুসঙ্গমের নিন্দা
অবশ্য খ্রিস্টধর্মের চেয়েও প্রাচীন। প্লেটোর
কাজকর্মেও অপ্রাকৃতিক-এর ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায়। বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, যেমন সক্রেটিস, লর্ড বায়রন, দ্বিতীয়
এডওয়ার্ড, হাদ্রিয়ান-এর ক্ষেত্রেও
সমকামী বা উভকামীর মতো পরিভাষাগুলো মাঝে মধ্যে প্রয়োগ করা হয়। মিশেল ফুকোর
ন্যায় কিছু দার্শনিকের মতে এই অভ্যাস ভুল, কারণ প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সমাজে যৌনতার উক্ত ধারণাগুলির অস্তিত্ব ছিল না। তাই আধুনিক
যুগে নির্ণীত শব্দ দিয়ে তৎকালীন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গেলে কালবিভ্রাটজনিত
দোষের আশঙ্কা তৈরি হয়। অবশ্য অন্যান্য দার্শনিক এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ
জানিয়েছেন।
( ক্রমশঃ )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন