কবির কথা
ট্রুথ ইজ লার্জার দ্যান ফিকশন। বারেবারে জীবনের অভিজ্ঞতা তা প্রমাণ করে। বিস্ময় আমাকে পেড়ে ফেলে, শ্রদ্ধায় মাথা
নত হয়। আজ এক কবির কথা বলব। যে কবিকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে
চিনি না, তাঁর লেখার সঙ্গে পত্রপত্রিকা সূত্রে কিছুটা
পরিচয় হয়েছে, এই পর্যন্ত। এই কবির কবি হয়ে ওঠা খুব সহজে বা স্বাভাবিক ভাবে হয় নি। তাঁর সংগ্রাম আমাকে ভীষণ ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, আবারও মনে হয়েছে সেই কথা- ট্রুথ ইজ লার্জার দ্যান লাইফ। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখি, এই কবির পরিচিতি
বা পাত্র-মিত্র, স্থান-কাল আমি কিছুই উল্লেখ করছি না, তাঁকে আমি বিব্রত করতে
চাই না বলেই।
ছোটবেলায় গ্রামের স্কুলে মাধ্যমিক পাশ করার পর ছেলের বাবা, যিনি তালের রস সংগ্রহ করে সংসার চালান, জানিয়ে
দিলেন, এবার আর পড়াশোনার খরচ তিনি চালাতে পারবেন না। কাজকর্মের চেষ্টায় ছেলে যেন এবার মন দেয়। মনে হাজার আশা চেপে রেখে, বুকে পাথর
ভরে, কাজের জন্য ছেলেটি এবার চলে গেল ভিন রাজ্যে, গ্রামতুতো এক মজদুর ঠিকাদার কাকার কাছে। সেই অচেনা, ভিন্নভাষী রাজ্যের শহরে গ্রামের
ছেলেটি গিয়ে যেন অকূল সমুদ্রে পড়ল! এরপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার
মত হয়ে এল আরেকটি দুঃসংবাদ। সেই কাকার আপাতত মজদুর বিনিয়োগ
করার উপায় আর নেই। তবে ছেলেটিকে তিনি ফেরালেন না, কুলি লাইনে যোগ করিয়ে দিলেন।
সেই কিশোর এবার সারাদিন মাল বয়, রাতে ফুটপাথে পলিথিন পেতে শোয়, আর সেই ক্লান্ত
শরীরে ঘুম জড়িয়ে আসা চোখে কাঁপা হাতে কাগজ পেনে লিখে রাখে কয়েক ছত্র। নয়ত দিনের অবসরে হাতে তুলে নেয় প্রিয় কবির কোনো বই। এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন আর রাত, ক্ষুধা তৃষ্ণার জন্য যেটুকু নাহলে নয়, সেটুকুই
খরচা করে বাকিটা তিলতিল করে জমাচ্ছিল ছেলে। লক্ষ্য এটাই, টাকা জমিয়ে উচ্চ
মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়া। এরই মধ্যে একদিন ওরই
কাছাকাছি ফুটে বাস করা এক মহিলা এসে ওকে বলল, ‘এই তুই তো লিখাপড়া জানিস। আমার
মরদকে একটা চিঠি লিখে দে তো।‘ ছেলে বলল, ‘হ্যাঁ লিখে দিচ্ছি। তা, কী লিখতে হবে বল’। মেয়েটি জানাল,
‘ওকে লিখে দে, আমি এখানে মরদ খুঁজে নিয়েছি, ও যেন ওর ইচ্ছে মত কাউকে দেখে নেয়’। এটুকু বলেই মেয়েটি থেমে গেল। যেন এরপর
আর কিছু বলার থাকতে পারে না। কী সহজ এই বিচ্ছেদ! কোথাও কোনো দুঃখের রেশ নেই, কোথাও
পিছুটান নেই। যাকে লেখা হবে তারও কোনো হেলদোল যে হবে না, মেয়েটির বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে
তাই মনে হচ্ছে। এই খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন এভাবেই বুঝি ছুটে ছুটে চলে। থমকে
দাঁড়ায় না কোথাও। তবুও ওর যে কেন লিখতে গিয়ে পেন সরছে না! ওকে থমকে বসে থাকতে দেখে
মেয়েটা এবার তাড়া দিল। কী রে লিখে দিবি না? না পারিস তো বল, অন্য কাউকে দিয়ে
লিখিয়ে নেব। আর তোকে কী এমনি এমনি লেখাব? এক টাকা দেব। দে, দে, জলদি লিখে দে। ছেলে
এবার লিখতে বসল। বাড়তি এক টাকার অফার তার কাছে টনিকের মত কাজ করল। সে যদিও,
মেয়েটার ভাষায় লিখতে পারল না। লিখল, সুধী, আমি অত্যন্ত মনোবেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি
যে, আমাদের বিচ্ছেদকাল আসন্ন হয়েছে। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে, এ কথা তোমায় জানাতে, তবু উপায়হীনা আমি। তোমাকে ছেড়ে এই
বিদেশে একা থাকতে আমার ভাল লাগত না, শরীর ও মন উতলা হয়ে উঠত। তাই এখানে আমি একজনকে
বিয়ে করেছি। তুমিও আর একা একা থেকো না। কাউকে বিয়ে করে নিও। ভাল থেকো, সুখে থেকো। আমি আর তোমার
ওখানে ফিরে যাচ্ছি না। ইতি- তোমার বিগত বউ।
এই ভাবে একটি চিঠি লেখার মজুরী হিসেবে তার একটাকা পাওনা হল।
এরপর সেখানকার বেশিরভাগ খেটে খাওয়া অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষদের যে কোনো দরকারে চিঠি লেখার ভার তার ওপর পড়েছিল। এখনকার মোবাইলের যুগ
হলে তার আর এই বাড়তি রোজগারটুকু হত না। এখানেই সে দেখেছিল, রাতের অন্ধকারে টর্চের
আলো এসে পড়ছে কারুর কারুর মুখে। যে মেয়েকে পছন্দ হচ্ছে, সেই মেয়ে চলে যাচ্ছে কোথায়
যেন, আর ভোরে ফিরে আসছে। তাদের টাকার অভাব হতেও কখনও দেখে নি ও। আর তাদের যে
নির্বাচন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এ জন্য তারা রীতিমত গর্ব অনুভব করত। এভাবে কেটে
গেল বেশ কয়েকমাস। সেই ঠিকাদার কাকা তাকে কিছু টাকা দিল ভালবেসে, আর তার নিজস্ব সঞ্চয় নিয়ে সে ফিরল
আবার নিজের গ্রামে। হ্যাঁ, উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হল, পাশও করে গেল ভালভাবে। এই
সময়ে কিছু বন্ধু আর স্যারেদের সাহায্য তার পাথেয় হয়েছিল। আর লেখার নেশা বেড়ে
গেছিল, পাঠ্য বইয়ের পাশে সাহিত্যের বই লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসত সে নিয়মিত। কবিতা
তার হাতে এমনি এমনিই ধরা দিত। কিন্তু সমস্যা তার সামনে এসে হাজির হল আবার। কলেজে
যে ভর্তি হবে টাকা পাবে কীভাবে? অগত্যা আবার সেই কাকার দ্বারস্থ হতে হল তাকে। এবার
কাকা বললেন, আর তোকে মজদুরি করতে হবে না। এবারে তোকে একটা ভদ্রলোকের কাজ করে
দিচ্ছি। সেই কথামত ছেলেটি এবার নিযুক্ত হল এক পার্টি অফিসের রিশেপশনিস্ট হিসেবে। কিন্তু
এবারে বাদ সাধল তার ভাষা। স্থানীয় হিন্দী ভাষা বুঝতে ও বোঝাতে তাকে খুব সমস্যায়
পড়তে হল। ফলে সেই কাজ ছেড়ে আবার কাকার কাছে ফিরে এল সে। এবারে আবার মজুরের কাজ পেল
সে। ইট বওয়া থেকে, মশলা মাখা... এই অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজের মধ্যে এক ঝলক টাটকা
বাতাস মেখে, তাকে আলোয় আলোময় করে, সামনে এসে দাঁড়ালো প্রেম।
সেই মেয়েটি তাকে আগলে রাখত, তাকে বিয়ে করে সংসার করে সুখে
থাকতে চেয়েছিল। সে কিন্তু তার অভাবের জন্য মেয়েটির ইচ্ছেকে মেনে নিতে পারে নি।
যদিও মেয়েটি এই অভাবের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, আমি তোকে রোজগার করে খাওয়াব। তুই
পড়ালিখা কর আরও। এই কথায় সে চোখের জল ধরে রাখতে পারে নি। রাতে শুয়ে সিদ্ধান্ত
নিয়েছিল, এখান থেকে ওকে পালাতে হবে। এই বন্ধন সে মেনে নিতে পারবে না, ভালবাসা ছেড়ে
তাকে চলে যেতে হবে। অনেক যন্ত্রণা মনে পুষে রেখে তাকে যেতে হবে। তার প্রথম প্রেম
বিচ্ছেদ নিয়ে এল এভাবেই অতর্কিতে একদিন। আত্মমর্যাদার হাত ধরে সে ফিরে এল আবার
নিজের গ্রামে।
একদিকে মনের যন্ত্রণা চেপে রেখে সে লিখে চলেছিল কবিতা।
অন্যদিকে বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে আবার পড়াশোনায় মন দিয়েছিল সে। এবারে
অবশ্য কিছু টিউশনি জুটিয়ে নিয়েছিল সে খরচ
চালানোর জন্য। আরেকটি উপায়ও এবার হঠাৎ এসে গেল। তার কবিতা লেখার কথা কারুর মুখে
শুনে এক কবি যশোপ্রার্থী ধনীর দুলাল তার থেকে কবিতা কিনে নিতে চাইল। একটি কবিতার
বদলে পাঁচ টাকা! সে বেশি কিছু ভাবে নি, কারণ পাঁচ টাকা তার কাছে অনেকটাই তখন।
এভাবে একের পর এক কবিতা সে সেই ধনীর দুলালকে বিক্রি করে দিয়েছে আর সেই দুলাল নিজের
নামে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সেই কবিতা ছাপিয়ে গেছে। আর এভাবেই একদিন সে একটি
কবিতার বইও বের করে ফেলল নিজের পয়সায়। অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে ততদিনে তাকে
একটু একটু করে কবি বলে চিনে নিয়েছে কিছু পাঠক। কিন্তু তার নামডাক হওয়া্র সময়সীমা
বোধহয় বেশিদিনের জন্য ছিল না। এক সভায়, যেখানে এই কবিনামধারী কবিটির কাব্য পাঠ
চলছে, সেখানে আসল কবিরই চেনা একজন আর সহ্য করতে পারে নি এই বেচাল। চিৎকার করে
লোকসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছিল আসল কবির নাম আর এই কবির কবিতা কিনে নেওয়ার কাহিনী।
ব্যাস্, সেই শেষ। এরপর থেকে আর নামডাকের চেষ্টায় এই কবিটিকে আর দেখা যায় নি। ফলে
আমাদের কবির বাড়তি রোজগার বন্ধ হয়ে গেছিল সে যাত্রা! কিন্তু এই ঘটনা প্রকাশ্যে
আসায় আসল কবিকে এবার সবাই চিনে গেল। ফলে আসল কবির কবিখ্যাতি পেতে আর কোনো বাধা রইল
না। এরপরে একের পর এক সাফল্য এসে কবির হাতে ধরা দিল। অবশ্য এর জন্য তার পরিশ্রমকে
বাহবা দিতেই হয়। পিএইচডি করার পরে তিনি এক হাই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
এই কবির কলম আজও সচল। প্রার্থনা করি, শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি এভাবেই লিখতে থাকুন।
তাঁর জীবন সংগ্রাম আমাদের কাছে এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, প্রেরণা জোগাবে। লক্ষ্য
স্থির থাকলে সমগ্র প্রতিকূলতাকে একদিন না একদিন কাটিয়ে ওঠা যায়, তিনিই আমাদের
দেখিয়ে দিয়েছেন চোখে আঙুল দিয়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন