সোনারি মেমরিতে জমে ওঠা ভালোবাসার চিঠি
বারীন ঘোষাল। সমস্ত শব্দই প্রতীক শুধু ভালোবাসা প্রতীকরহিত – বলেছিল এই লোকটা। হ্যাঁ, সেই
চিরপরিচিত কবিতার ভিলেন তার ‘অতিচেতনার
কথা’–য়, যেখানে আমাদের প্রথম সেতুবন্ধন। চেনাশোনা। তখনও
চোখের দেখাশোনা বাকি। তবু ভালোবাসার স্নেহপ্রবণ চোখ গলে আমার মতো অচেনা পর্যটকের
বিস্ময়ী ডাকঘরে জমা পড়ল অজস্র চিঠি। একজীবনে
জড়ো করা নুড়িপাথরের পাশে ওইটুকুই আমার মণিমুক্তো। বুকের
ভেতর একলা আকাশ নামিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। মনে পড়ে কতশত ফিউসান, দুহাতে জড়ানো কত
হাসিগান আনন্দলহর। তাদেরই অন্তর খুঁড়ে এইসব বারীনসহবাস।
আমি তখন কবি কবিতা ও পাঠকের ত্রিকোণমিতিতে ঝুলে আছি।
ক্রিয়ারা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিক্রিয়ার নির্জলা সংঘাতে। বারীনের ‘আমার সময়ের কবিতা’,
পাঠপ্রতিক্রিয়ার নতুন দিগন্ত আমাকে দিল মাথার ওপরের আকাশটার খোঁজ। আর ‘অতিচেতনার
কথা’ জানালো কোনো কবিতাই কখনও ফুরোয় না। যেখানে সে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই আরো একটা কবিতার
জন্ম। বারীন বললেন, ভালো খারাপ বলে কিছু হয় না, কবিকে আবিষ্কার কর কবিতার মধ্যে। আস্তে আস্তে
জড়িয়ে গেলাম আবিষ্কারের নেশায়; যে নেশায় নিজেকেও আবিষ্কারের মন্ত্রণা।
২০১২ বইমেলায় আমার
পাঠপ্রতিক্রিয়াগুলোর সংকলন ‘অন্তর্বর্তী পঙ্ক্তি’ বেরোবে ‘কৌরব’ থেকে। বারীন কভার
নিয়ে চিন্তিত। সুদেষ্ণর করা কভারে অদলবদল করলেন একটু। ব্লার্ব লিখে বললেন ‘দেখ্ এখন
কেমন লাগছে’। সে ব্লার্ব পড়ে আমার সার্টের কলার একটু উঁচু হয়ে উঠলেও লজ্জার
রঙও লেগেছিল মুখে,
----------------
“আলোর অরুণ ও-রুণা কী নিপুণভাবে
প্রকাশিত করেছে পাঠবস্তুগুলি – কবিতাকে অণুকবিতায়, গদ্যকে স্বমহিমায় ফুটিয়ে তুলতে
গিয়ে তীব্র আসক্তি নিয়েও কেমনভাবে নিরপেক্ষ থাকতে হয় জানিয়েছে, সমস্ত প্যারাডাইম
শিফট ও সমস্ত নবীন জ্যঁরকে কলমে রেখে রচনাগুলির সিনেমা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও
সঙ্গীতকে জটিলতামুক্ত করে তুলেছে – আশ্চর্য হতে হয়!! এই বই পড়ার পর মূল বইগুলো
ফিরে পড়তে ইচ্ছে করবে, বলে রাখলাম। রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তো একজন পাঠিকা। আর আমরা!!”
-----------------
নিজেই নিজের কাছে যোগ্যতার প্রশ্ন
তুলেছি। এতো কিছু ভেবে লিখেছি কিনা। আজ বুঝতে পারি বারীন নিজের কবি ও কবিতা আবিষ্কারের নেশাটা নতুন প্রজন্মের ভেতর
চারিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাই উৎসাহ আর ভালোবাসা। আজ কেবলই মনে হচ্ছে লোকটার কাছে
সারাজীবন হাত পেতে নিয়েই গেছি, হাত উপুড় করা হলো না আর।
নিজে তখন একটা দুটো কবিতা লিখতে শুরু করেছি। নতুন হচ্ছে
কিনা প্রবল দ্বিধা নিত্য দ্বন্দ্ব। বারীন
তখনও তুমির আলাপে। সুদেষ্ণার ধমক তখনও রুনাকে রুণা করেনি। কবিতা লিখলেই বারীনকে
মেইল। উত্তরও যথারীতি। ভালো বলা সরলতা। লোকও প্রচুর মেলে। কিন্তু সরলে
ও সহজে বিস্তর ফারাক। কোথায় খারাপ লাগছে সহজ করে বলা সহজ নয়। বারীন এখানেও
অদ্বিতীয়,
--------------------
প্রিয় রুনা,
'দাবা থেকে দোয়াবঘেরা ছকে' কবিতাটা এতই অসাধারণ যে, সামান্য ত্রুটিও বড় বেমানান লাগছে। যেমন -- চুক্তি / গ্রীনটি। যেমন 'ন্ত' যোগের শব্দগুলো। বাকিটা দারুণ হয়েছে।
দ্বিতীয় কবিতাটাও সত্যি অসাধারণ হয়েছে। উড়িকিনাউড়ি বন্দর বা হিমমগ্ন হিয়া কী ভালো লাগছে ! খারাপ লাগছে -- নির্দিষ্ট, অনির্দিষ্ট, লগ্নভ্রষ্ট -- এই সব শব্দগুলো।
তো রুনা, এই তো তোমার হাতেও কী সুন্দর নতুন কবিতা ফুটে ওঠে ! তবে তুমি কেন
মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ো !
বারীনদা।
--------------------------
আবার নির্মাণ শব্দটাকে নিয়ে ভাবতে বসি। কবিতার
হাড় মাংস, জলের মন্ত্রশব্দ। বারীন বললেন, আমি তোমাকে বাধা দিচ্ছি না, সাহায্য
করছি। আজ বুঝতে পারি লোকটার ভালোবাসার হাত কতটা লম্বা ছিল। নতুন কবিতা জড়ো হতে
হতে ২০১৩ বইমেলায় ‘নিলামবালা ছআনা’। অতনু করল ‘এখন’
থেকে। সেবারে ভালোবাসার
মিলনমেলায় আমি গরহাজির। যদিও নতুন বই রয়ে গেল স্পর্শের বাইরে তবু মুঠোফোনের ভেতর দিয়ে ভেসে আসা শব্দে কান পেতে বইমেলার গন্ধ নিচ্ছি বুক ভরে।
ছবিতে ‘কৌরবে’র প্রিয় চেয়ারে বারীনদা। আমি যথারীতি বারীনদাকে আবার খোঁচা দিই ‘হার্ডকোর কৌরব’ নিয়ে। বইমেলা শেষ
হবার কিছুদিনের মধ্যেই মেইল এল। আশ্চর্য মানুষ! আমার বইটা এরই মধ্যে পড়া শেষ এবং ‘হার্ডকোর
কৌরব-২’ করার প্রতিশ্রুতি। আমি আবারও বিস্মিত। প্রতিটা কবিতা কত যত্ন
নিয়ে পড়া, কোথায় কতটুকু বাজল, কিংবা বাজল না তাকে বিস্তারিত বলা কত সহজেই পারে
লোকটা। চোখ চিকচিক করে ওঠে লতিয়ে ওঠা ভালোবাসায়,
বইমেলা শেষ হতেই আমিও হার্ডকোর নিয়ে ঝুলে পড়লাম বারীনদার
সঙ্গে। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। ‘কৌরবে’র পুরনো লেখা জড়ো করা, তাদের সম্পাদনা করা – চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না লোকটা এতও পারে! একসঙ্গে
সম্পাদনার এই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা জমা রইল আমার মনের মণিকোঠায়। ২০১৪ বইমেলায় বিনয়
মজুমদারের করা প্রচ্ছদ সহ ‘হার্ডকোর কৌরব-২’ হাতে নিয়ে বারীনদাকে প্রণাম করি।
২০১৬ নভেম্বরে অতনুর ঘাড়ে পড়ল আমার
চতুর্থ কবিতার বই ‘পরবর্তী সংবাদ’। বারীনদা তখন জলপাইগুড়িতে, অতনুর বাড়ি। অতনুকে
ফোন করলে হাত গড়িয়ে বারীনদা,
-কেমন আছো বারীনদা?
-ফার্স্টক্লাস। তোর বই-এর প্রুফ
সামনেই খোলা।
-কেমন লাগছে?
-ভালো লিখছিস আজকাল। সায়েন্সকে
সাবজেক্ট হিসেবে নিয়ে ভালোই করেছিস।
-সেও তো তোমারই প্ররোচনা
-আমি একটা ভূমিকা লিখেছি, পড়ে
দেখিস।
...জানি না গল্প না কবিতা। শুধু বারীনদার
হাতে লেখা এই ভূমিকাটুকু রয়ে গেল বুকের ভেতর। পৃথিবীর সমস্ত অস্বীকার তুচ্ছ হয়ে
গেল বারীনদার এই স্বীকৃতিটুকুর কাছে। ...আমার পরের বইগুলোর ভূমিকা এবার কে লিখবে
বারীনদা?
২০১৭ বইমেলায় যথারীতি ‘কৌরবে’র
চেয়ারে বারীনদা। অজস্র কবি সমাগম বারীনকে
ঘিরে। হাসি, গল্প, লিটিল ম্যাগাজিন স্টল, কীভাবে যে কেটে গেল ১২টা দিন! আজ তুমি
নেই অথচ এগিয়ে আসছে বইমেলা। খালি থাকবে তোমার প্রিয় চেয়ারটা। আমরাও কি খালি হয়ে
গেলাম না, বারীনদা? তোমার দেওয়া দেনমোহরে এইসব রসায়ন, গোপন রক্তস্রোতে
মেটামরফোসিস। চেনা আঙুল নিশ্চিত স্বরলিপি ফেলে হারমানাহার বিতানবিলাস থেকে বারীন
পর্যন্ত আসতে গিয়ে আবারও ভেসে ওঠে বারীন আলাপ –
-কেমন আছো বারীনদা?
-ফার্স্টক্লাস
-তুই?
-বিন্দাস।
-আর তোর খোঁজ?
-আছে। তোমার যেমন মনোরমা আমারও
তেমনি অনিমেষ।
-খোঁজ খোঁজ। হারাতে হারাতে একা হতে
হতে শুধু খোঁজ আর খোঁজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন