উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
প্রতিটি দেশ ও জাতির উত্থান-পতনে, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও সভ্যতা-সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্তের জোয়ার এসে যায়। সাধারণ অভিজ্ঞতা বলে, কোনো দেশ যখন সমৃদ্ধি, শান্তি, শৃঙ্খলা তথা নবজীবনের স্বচ্ছলতায় থাকে, তখনই তাঁর সৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির বিকাশ হয়। মানুষ যখন সুস্থিতির বাতাবরণে থাকে সে সময়েই তার চিন্তন-মননের সুষম বিকাশ হয়, তখন জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শন সাহিত্য শিল্পকলা সব বিষয়ে নব নব সৃষ্টির সূচনা ঘটে। ইতিহাস এর সাক্ষী দেয়। ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তও অবশ্য দুর্লক্ষ্য নয়। আমাদের দেশ ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকাকালে ঔপনিবেশিক শাসনে, তখন বিপরীত স্রোত পরিলক্ষিত হয়। ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শনের সংস্পর্শে ধীরে ধীরে এদেশে একটা জাতিসত্তা আত্মপ্রকাশ করছিল, সুসংহত রূপও পাচ্ছিলো। ইংরাজ শোষক, অত্যাচারী ছিলো সত্য, তবে তাদের মধ্যে কিছু এদেশের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীও ছিলো। তাই রবীন্দ্রনাথ তাদের ভালো ইংরাজ ও খারাপ ইংরাজ দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেন।
উনিশ শতকের গোড়ায় সেই ভালো ইংরাজ পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলায় সমৃদ্ধ
মূর্তিটাকে এ দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান। মোদ্দাকথা এদেশের
মঙ্গল কামনা করেন। সুফলও ফললো। যুগ যুগ ধরে গভীর সুপ্তিতে আচ্ছন্ন ভারতাত্মা
বিপুল বিস্ময়ে চোখ মেলে তাকালো, এদেশে নবজাগরণ তথা রেনেসাঁর সূচনা
হলো। এই নবজাগরণের অগ্রপথিক রাজা রামমোহন রায়, আর বাংলায় এই জাগরণের যে প্রমত্ত প্রবাহ শুরু হলো একদিন তা সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে
পড়লো। নক্ষত্রের মতো দ্যুতি নিয়ে বাংলার মাটিতে একের পর এক আশ্চর্য মানুষ জন্মাতে লাগলেন। বিপুল সংখ্যায় প্রতিভাধর মানুষ কীভাবে জন্মালেন ভাবতে বিস্ময় জাগে। আজ স্বাধীন
দেশে তুলনায় যেন একটা বন্ধ্যাকাল চলছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় দশকের
দিকে তাকালে সত্যটা যেন প্রখর হয়ে ওঠে। ১৮৬০ সাল থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে দশ বছরে
প্রায় দশজন প্রতিভাবান মনীষী জন্মেছিলেন। শ্রেষ্ঠ বাঙালি তাঁরা। ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, ১৮৬২ সালে স্বামী বিবেকানন্দ,
১৮৬৩ সালে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ১৮৬৪ সালে
ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, রামেন্দ্রসুন্দর
ত্রিবেদি আর স্যার আশুতোষ মুখার্জি, ১৮৬৬ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকার,
১৮৬৮ সালে প্রমথ চৌধুরী এবং ১৮৭০ সালে যদুনাথ সরকার জন্মেছিলেন। গভীরভাবে বিচার
করলে দশ নয়, আরো বেশি প্রতিভাবানকে পাওয়া যাবে। এ যেন নক্ষত্র
সমাবেশ,
প্রতিভার ছড়াছড়ি। এই ভরভরন্ত
সময়ে বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। সমগ্র বাঙালির
প্রিয়জন,
মনের মানুষ তিনি। আবালবৃদ্ধবনিতা সকল বাঙালির আশৈশব বন্ধু, সখা। ত্রিপুরার সাহিত্যিক বিমলেন্দ্র চক্রবর্তীর ডেইলি দেশের
কথা পত্রিকায় শিশুমহলে প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘কামদারঞ্জন থেকে উপেন্দ্রকিশোর
রায়চৌধুরী’ থেকে একটা বিচিত্র তথ্য জানা যায়। আমরা জানি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র সুকুমার রায়, সুকুমার রায়ের পুত্র সত্যজিৎ রায়,
সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়। এখন প্রশ্ন
রায়চৌধুরী উপাধি কীভাবে সুকুমার রায় থেকে 'রায়' হয়ে গেলো। এই রহস্য উদ্ঘাটনে বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় শিশুমহলের শিশুদের কেবল নয়, আমাদের মতো কৌতূহলী বুড়ো শিশুদেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। জানা গেলো উপেন্দ্রকিশোরের
একটা বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘উপেন্দ্রকিশোর
: জীবন ও সাধনা’ আলোচনায় 'অতি অল্প কথায় দারুণ সব তথ্য ও ইতিহাস লিখে
গেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের আলোচনার অনুসরণে উপেন্দ্রকিশোরের
সাড়ে চারশো বছরের বংশ পরিচিতি সহ রায়চৌধুরী বনাম রায় পদবীর রহস্যকেও উন্মোচন করেছেন
বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী মহোদয়। বর্তমান প্রসঙ্গে তাঁকে অনুসরণ করা যুক্তিযুক্ত।
উপেন্দ্রকিশোরের পূর্বপুরুষেরা দেব পদবীধারী দক্ষিণ রাঢ়ী-র কায়স্থ পরিবার ছিলেন। “প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে তাঁদের বাস ছিল
পশ্চিমবাংলার নদীয়া জেলার চাকদহ গ্রামে”
— বলেন বিমলেন্দু চক্রবর্তী। জীবন জীবিকার
খাতিরে এই বংশের রামসুন্দর দেব ময়মনসিংহের সেরপুরে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ব্রহ্মপুত্র
তীরে মসুয়া গ্রামে চলে যান। বন্যায় দুর্গতি হতো বলে সপরিবারে উচ্চ
স্থানে গিয়ে নতুন করে ঘরবাড়ি করেন। এই স্থানকে বড় মসুয়া বলা হতে থাকে। এই স্থান প্রকৃতপক্ষে
ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে। সেই বড় মসুয়া গ্রামে শ্যামসুন্দর দেবের
পুত্র রূপে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে জন্মগ্রহণ করেন উপেন্দ্রকিশোর। এই দেববংশের
বাংলা,
সংস্কৃত, আরবি, ফারসি,
ইংরেজি ইত্যাদি নানা ভাষায় পারঙ্গমতা ছিলো। ছিলো শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধূলায় সুনাম। চারশ বছরের
সমৃদ্ধ ও সুদীর্ঘ ইতিহাস ছিলো তাঁদের। সমৃদ্ধি, সাফল্য ও পাণ্ডিত্যের জন্য ক্রমে তাঁদের দেব উপাধি বিলুপ্ত হয়ে রায় বা রায়চৌধুরী
উপাধি হয়ে যায়। শ্যামসুন্দরের প্রকৃত নাম কালীনাথ শ্যামসুন্দর মুন্সীর
আড়ালে চলে যায়। তাঁর চার ছেলে। সবার বড় সারদারঞ্জন অঙ্ক ও সংস্কৃতে
পণ্ডিত ও সেকালের সেরা ক্রিকেটার। দ্বিতীয় কামদারঞ্জন, তৃতীয় মুক্তিদারঞ্জন ছিলেন শিক্ষাবিদ্ ও ক্রিকেটার। চতুর্থ কুলদারঞ্জন
শিশু সাহিত্যিক, ফটোগ্রাফি শিল্পী ও ক্রিকেটার। আর ছোট ছেলে
প্রমদারঞ্জন শিশু সাহিত্যিক। দ্বিতীয় ছেলে কামদারঞ্জনের জীবন ভিন্ন
খাতে প্রবাহিত হয়। তাঁকে দূর সম্পর্কিত জমিদার কাকা হরিকিশোর রায়চৌধুরী
দত্তক নিয়ে নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। পাঁচ বছর বয়সে
নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একদিন বাংলার গর্বের সন্তান হয়ে উঠেন তিনি।
১৮৮০ সালে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে স্কলারশিপ সহ এন্ট্রান্স পাশ করে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি ভর্তি হন। কিন্তু এখানে কিছুদিন থেকে তিনি ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান কলেজ (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে বি.এ. পাশ করেন। স্কুল জীবনেই তিনি খুব ভালো ড্রয়িং শিখেছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর একাধারে লেখক, চিত্রশিল্পী, বেহালা ও বংশীবাদক, সঙ্গীতজ্ঞ, কম্শোজার, প্রিন্টিং টেকনোলজির সুবিখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং স্বদেশে নতুন পদ্ধতির সার্থক প্রয়োগকারী। তাছাড়া তিনি প্রকাশক ও উদ্যোগপতি ছিলেন। প্রিন্টার হিসেবে ব্লকে চিত্রাদির খোদাই করে এদেশে অগ্রগামী হয়ে ওঠেন। এমনকি ব্লকে খোদাই করে রঙীন চিত্রাদির ছাপানো তিনিই শুরু করেন। পাশ্চাত্যে ঠিক সমকালে রঙীন প্রিন্টিং ও তার খোদাই শিল্প জোর কদমে চলছিল। উপেন্দ্রকিশোর এসব কাজ এমন দক্ষতার সাথে করছিলেন যে বিদেশে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রিন্টার হিসেবে উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম ব্লক প্রস্তুতকারী — হাফটোন ও রঙীন ব্লক প্রস্তুত ও ব্যবহারকারী হিসেবে সুপরিচিত তিনি। তাঁর বিখ্যাত বই ছেলেদের রামায়ণ-এর ছবি আঁকা, ছাপানোর জন্য লাইনব্লক তৈরি, সবই তিনি নিজে করেন। কিন্তু এই কাজ হতদরিদ্র চেহারার হওয়ায় বিলেত থেকে বইপত্র, কেমিক্যালস যন্ত্রপাতি সব এনে শিখতে লাগলেন, গবেষণা করতে লাগলেন। প্রচণ্ড পরিশ্রম ও জেদ ব্যর্থ হলো না। ১৮৯৫ সালে তিনি ব্লকপ্রস্তুতির ব্যবসা শুরু করলেন, এ বিষয়ে তিনি তাঁর সমগ্র চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অবিরাম বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে লাগলেন। ব্লক প্রস্তুতি বিষয়ক টেকনিক্যাল প্রকৌশল সম্পর্কিত বহু নিবন্ধ ব্রিটেনের ‘Penrose Volumes’এ প্রকাশিত হতে লাগলো। নিজেও নানা বই প্রকাশ করলেন। কিন্তু এ কাজে প্রথমদিকে ভিন্নতর পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন।
বিলেত থেকে নানা যন্ত্রপাতি এনে U. Ray নামে ছাপাখানা
ও প্রকাশন সংস্থা তিনি স্থাপন করেন ২১ সুকিয়া স্ট্রিটে। কিন্তু বিলেত
থেকে পড়াশোনা শেষে পুত্র সুকুমার রায় এতে যোগদান করলে এর নাম হয় M / S U. Ray&
Sons এবং ১০০ গড় পারে তা নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তরিত হয়। উপেন্দ্রকিশোরের
ইচ্ছে ছিলো বিলেতের ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রিন্টিং টেকনোলজি নিয়ে পুত্র
সুকুমার রায় এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। হলোও তাই। প্রিন্টিং টেকনোলজি
নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন।
প্রিন্টিং টেকনোলজির জটিল বিষয়-আশয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সূত্রাবলী বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মধ্যে যে বিজ্ঞানমনস্ক উপেন্দ্রকিশোরের সবল উপস্থিতি টের পাই, তাঁর অন্তরে প্রকৃতিমনস্ক, মানবপ্রেমী, শৈশবের মেদুরতা মাখা চির লালিত সৃষ্টিশীল শিল্পী সত্তাকেও অনুভব করা যায়। আমৃত্যু এই চিরশিশু, চিরকিশোর সত্তা যেন শৈশবের প্রান্তরে ঘোরাফেরা, ছোটাছুটি করেও ক্লান্ত হয় না।
জীবনের বেশির ভাগ সময় মহানগরী কলকাতায় বাস করলেও তাঁর মনের এক বিরাট অংশ জুড়ে এক শিল্পী বালক কেবলই ছবি আঁকে, বাঁশি বাজায়, টুনটুনি পাখির মতো লাফায় ঝাঁপায় উড়ে বেড়ায়। শৈশবের সেই দিগন্ত বিশারী সবুজ মাঠ, অরণ্যানী, কল্লোলিত নদীমালা, শাপলা শালুকের ঝিল, বিশাল পুষ্করিণী তাঁর মনে যে জাদুকাঠি ছুঁইয়েছিল, তার নেশাচ্ছন্নতা আজীবন উপেন্দ্রকিশোরের মনে মায়াজাল বিস্তারিত করে রেখেছিল। আর তাই তিনি শিশুসাহিত্যিক, ষোলো আনা খাঁটি শিশুসাহিত্যিক। উপেন্দ্রকিশোরের তুলনা উপেন্দ্রকিশোরই। ভারতের দুই মহাকাব্য শিক্ষিত অশিক্ষিত সব ভারতবাসীকে ভালো লাগা ও শ্রদ্ধার সূত্রে বেঁধে রেখেছে এখনো। এই দুটি মহাকাব্যকে কথায় ও ছবিতে তিনি এমনভাবে লিখলেন যাতে শিশুরা নির্যাস সত্য অনুভব করে ভাবী জীবনের মূল্যবোধ গড়ে নিতে পারে। ময়মনসিংহের পল্লীতে কত কাহিনীর ভাঙ্গাগড়া নদীর ধারার মতো সেই কোনকাল থেকে বয়ে চলেছে অনির্দ্দেশ্যের দিকে। বিস্মিত কিশোর তিনি একান্ত দর্শক। ছোটদের জন্য নানা কাহিনী তিনি বুনেই গেলেন। কাহিনীর অন্তরালে একটা নীতিকথা যেন ইঙ্গিতে প্রকাশিত। মজার গল্পে প্রচ্ছন্ন প্রখর সত্য। যারা বলবান, অত্যাচারী, অহঙ্কারী তারা অন্তে জেতে না। টুনটুনি জিতে রাজার কাছে, বাঘ হারে শেয়ালের কাছে। একটা মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা ছোটদের জন্য লেখার পেছনে সদা সক্রিয়। তাঁর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইনের’ মতো ফ্যান্টাসি শিশুকাহিনী সত্যিই বাংলাসাহিত্যে বিরল। সঙ্গীতের বই রচনা ও চর্চা, বিজ্ঞানের বই কি না লিখেছেন তিনি।
১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর অন্যতম কীর্তি ‘সন্দেশ’
পত্রিকা বের হলো। সম্পাদক ও প্রকাশক স্বয়ং উপেন্দ্রকিশোর। সন্দেশ একপ্রকার
মিষ্টদ্রব্য, আবার সংস্কৃতে এর মানে সংবাদ, ইংরেজিতে নিউজ। বাপের বাড়ি থেকে মেয়ের সংবাদ নিতে তত্ত্ব
হিসেবে সন্দেশ নিয়ে যাওয়া হতো। দুটি মিলেমিশে একাকার হয়ে মিষ্টদ্রব্য
সন্দেশ হয়ে গেলো।
উপেন্দ্রকিশোরের নিজের মত হলো, আমরা যে সন্দেশ খাই তা খেতে ভালো লাগে। আর এই সন্দেশ পড়তে ভালো লাগবে। সার্থকনামা তাঁর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। উপেন্দ্রকিশোরের লেখক জীবনের মূল লক্ষ্য ছিলো শিশু কিশোরদের জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেওয়া। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র’র ভূমিকায় বলেন, “ছোটদের চিত্তকে সবদিক থেকে সম্পন্ন ও সচ্ছল করে তোলা এবং কল্পনাকে সর্বদিক দিয়ে মুক্ত করে তোলা ছিলো যার ব্রত... সন্দেশের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা সঠিক উপলব্ধি করতে পারিনি। যেদিন পারবো তার স্রষ্টাকেও সেদিন বাঙালি শিশুর শ্রেষ্ঠবন্ধু বলে স্বীকার করে নিতে কোন কুণ্ঠা হবে না”। দেশ বিদেশের শিশু সাহিত্যের মূল্যবান অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি শিশু কল্পনাকে উসকে দিয়ে কৌতূহলী করে তোলেন বলে তাঁকে শিশুর যথার্থ শিক্ষক মানা যায়। ‘সন্দেশ’ ২০১৩ সালে শতবর্ষ পূর্ণ করলো। মাঝে মাঝে বিরতি থাকলেও ‘সন্দেশ’ সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। ভারতে এটি রঙীন চিত্র সহ প্রথম শিশুপত্রিকা। আর প্রথম থেকেই প্রকাশনার দক্ষতা ও বিষয় বৈচিত্র্যে এটি নজরকাড়া হয়ে একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এটির ভূমিকা লিপির যথার্থ শিরোনাম দিয়েছিলেন, “বাঙালি শিশুর শ্রেষ্ঠবন্ধু, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক”। এই অভিনব মূল্যায়ন, প্রকৃত অর্থে যথার্থ। উপেন্দ্রকিশোর পরে তাঁর পুত্র সুকুমার রায় এবং নাতি সত্যজিৎ রায় বেশিরভাগ শিশুদের জন্য লেখা ‘সন্দেশে’ প্রকাশ করেন। উপেন্দ্রকিশোরকে তাঁর ছোটগল্প, শিশুদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা আর বাংলাসাহিত্যে অন্যান্য মূল্যবান লেখার জন্য মান্যতা দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে উপেন্দ্রকিশোর, তাঁর পুত্র সুকুমার রায় এবং নাতি সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য প্রতিভার স্পর্শে ‘সন্দেশ’ বাংলা শিশুসাহিত্যে স্বর্ণযুগ গড়ে তুলেছিল।
প্রাচীনকালে রাজারা অভিযানে বেরিয়ে রাজ্যের পর রাজ্য জয় করে সাম্রাজ্যের
সীমানা বিস্তৃততর করে কীর্তিস্তম্ভ স্থাপন করতেন। উপেন্দ্রকিশোরের জীবনও এক অভিযান। সারাজীবন একের
পর এক কীর্তির রাজ্য জয় করেছেন। তাঁর প্রকৃত সাম্রাজ্য বাংলার শিশুসাহিত্যকে উন্নতির শিখরে পৌঁছানোর
জন্যই যেন অন্য সব ক্রিয়াকলাপ। সেসব কিছু সার্থকভাবে সম্পন্ন করে তিনিও
এক কীর্তিস্তম্ভ স্থাপন করলেন, আর তা হলো ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। যা একশো বছর
ধরে বংশানুক্রমিক উপেন্দ্রকিশোরের বিজয়বার্তার ঘোষক হয়ে আছে। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের
২০ ডিসেম্বর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিহারের গিরিডিতে (বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্য) দুনির্বার পথচলা সমাপ্ত করে মাত্র
৫২ বৎসর বয়সে অনন্তলোকের পথে যাত্রী হলেন। এক বিশাল মাপের
প্রতিভার মনীষী, কর্মযোগী আর চিরকালীন বাংলা শিশুসাহিত্যের পাঠকদের
বন্ধু ও শিক্ষকের মহাযাত্রা সমাপ্ত হলো। বাংলাসাহিত্য
ও বাঙালি কোনোদিন তাঁকে ভুলবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন