শালিক অথবা হ্যানলে
আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে এখনও যখন বেঁচে উঠতে চায় শুরুর দিনগুলোর উত্তাল সময়, কিছু সুখস্মৃতি কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার ঝাপসা কাচে দৃষ্টি রেখে তার কেবল মনে হয় পৃথিবী ক্রমে ধূসর হয়ে আসছে। দৈনন্দিনতার এই একটানা মনোলগে তারপর কখন সে আবার টানটান হয়ে বসে। লক্ষ্য করে বারান্দায় রোদ পেতে দেওয়া মেঝেতে একাকি লাফিয়ে বেড়াচ্ছে একটা এক পায়ের দুখী শালিক। এক শালিক দেখলে যেন কি হয়... দুঃখ? কিন্তু ওর আরেকটি পা হারালো কোথায়, শালিককে সে দুখীই বা ভাবছে কেন...অবিচ্ছিন্ন ভাবনার ভেতর প্রভাতী মেসেজ ঢুকে যায় টুং শব্দের রেশ তুলে। এসময়ে কার টেক্সট আসে সে জানে। আজকাল আর খুলে পড়তে ইচ্ছে করে না। অথচ এই আদান-প্রদানের খেলায় তারই ছিলো মুখ্য ভূমিকা।
কী হয়... কী যে হ...
টেবিলের ওপর চাবি ফেলে সশব্দে মৌ। চটিজোড়ায় পা গলিয়ে মেঝেতে ঘষে ঘষে শব্দ তুলে এগিয়ে যায় সদর দরজার কাছে। হাতলে হাত রেখে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ কুঁচকে হাওয়ায় ছড়িয়ে দেয়... এলাম। খুলে যাওয়া দরজা দিয়ে যত তীব্রতায় আলো এসে অন্ধকার সরাতে যায় তার চাইতেও দ্রুতপায়ে মৌ বেরিয়ে যায়। যাবার সময় দরজা সপাট টেনে বন্ধ করে দিয়ে যায়। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দের ভেতর বন্ধ ঘরের অন্ধকারে দুলতে থাকে মৌ এর ওই এক শব্দের ‘এলাম’ ... হুঁ এলার্ম। এলার্মিং... সুতো ছিঁড়বে ছিঁড়বে করছে। শেষ মুহূর্তের ইলাস্টিক লিমিটে এক একটা এলাম বা এলার্ম আসলে এক একটা ডট। ঘোরগ্রস্ত মন তাই কি খুঁজছিল আপাত বন্দর, একটা নিরুদ্দেশ যাত্রার আগে একটু জিরিয়ে নেবার স্টেশন যেখানে দু দণ্ড বসে থাকা যায় চুপ করে!
জীবন এক জার্নি যাকে সে মেনে নিয়েছে নানা অভিঘাতের ভেতর দিয়ে তবে জীবনকে সে উৎসব বলার আগে অন্তত তিনবার ভাবে। কেন না উৎসবের এক একটা ঘরানা থাকে, আবহ থাকে, থাকে শামিয়ানার রঙ। যেমন এখনও সে ভাবছে আর ভাবনার মনঃসংযোগকে আলতো সরিয়ে সে সময়.. আরে যাহ.. কোথা থেকে শালিকটা আরেক শালিককে ডেকে আনছে। তার গায়ের খয়েরি ছিটছিটে কে রোদ মাখাচ্ছে আদরে... তাহলে? জীবন উৎসবই নয়? বাতাসে যে হেমন্তের রঙ তা উৎসব ন? ভালবেসে যে দিনরাত তাকেই ভেবে যায় সে কি উৎসব নয়, অতএব মুঠোফোন হাতে সে নিতেই পারে এবার। খুলে দেখতে পারে সাত সমুদ্র পেরিয়ে আসা টেক্সটে কতটা প্রিয়তার ছবি আঁকা আছে..দেখবে? না থাক। এইসব মেসেজগুলোকে আজকাল অর্থহীন লাগে তার। নইলে যে সব টেক্সটে ভালবাসবার শব্দদের জড়িয়ে থাকার কথা তাতে থাকে অতসব অভিযোগ! তবে সে অর্থে কোথায় অভিযোগ নেই! অভিযোগ সর্বত্র। সংসার নামের চিড়িয়াখানা থেকে কর্মসার্কাস এরিয়ার সবখানেই সংঘর্ষ অবিরাম। যাত্রাপথের আনাচকানাচ সবটাই তো যুদ্ধক্ষেত্র। খাবার নেই, অর্থ নেই, সঙ্গী নেই। নেই নেই আর নেই। যুদ্ধক্ষেত্রের পরাজিত সৈনিক কবেই তাই পিছু হটতে হটতে... ফিসফাস অন্ধকারে আজকাল কে বলে, বারবার বল, কই নিজেকে মুক্ত করার কথা ছিলো যে.. করো দেখি! আর সে চোখ বন্ধ করে প্রবল মাথা দোলাতে দোলাতে বলে আর্নেস্তো, আর্নেস্তো হেরে গেছি। আমি হেরে গেছি।
এক রাশ অন্ধকারে পালা করে আসে মৌ, আসে টুই। মৌ পারেনি। টুইও না। আসলে কেউ কিস্যু পারে না। যেমন পারে না সে। টুই না কি মিস করে প্রবল। কী করে? বুঝতে পারে না। কথা মানে তো কিছু শাব্দিক আদানপ্রদানে অনুভূতির আলোর আসা যাওয়া। তাতে বেশির ভাগ সময় টুই যেন হ্যানলে, জলমগ্ন সাবমেরিন। দশ লাইন লেখার পর একবার আলো আসে হুঁ শব্দে। কখনও আচ্ছা। প্রায়শই উদ্ধার অভিযানে নেমে টেনে তুলতে হয় টুইয়ের ভেতর জমে থাকা কথামালা। অথচ যে টুইকে সে জানতো তার ভেতর ছিলো প্রখর অনুভূতিমালা। কোথায় হারালো টুই! তার প্রতিটা হুঁ বা আচ্ছা বা হুম শব্দে ভেতর ভেতর যে তারও ঝড় ওঠে টুই কেন বোঝে না। আসলে কেউ কখনও অন্যজনকে তার মতো করে বোঝে না, আর তাই, কানের কাছে মুক্তি পাবার কথা যখন কেউ ফিসফিসিয়ে বলে, সজোরে সে চায়ের কাপ কি চেয়ারের হাতল আঁকড়ে একটানা বলে যায়... আর্নেস্তো... আর্নেস্ত...
সেসব
সময়ে সম্পর্ক নামের
সুতোগুলো আরও টানটান
হয়ে ওঠে। বাতাসের জোর বাড়ে। শ্বাস নেবার
জোর কমে।
একেকদিন
সমুদ্রে ঝড় ওঠে
প্রবল। ঝড় থামেও।
কেবল ঝড় শেষে নিশ্চিহ্নের প্রবল নৈঃশব্দের ভেতর পড়ে থাকে পরিত্যাক্ত একলা বন্দর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন