গৃহাশ্রম
ঋতালী একেবারেই গ্ৰামের মেয়ে। ভোরে উঠে বেশ কয়েক কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে একটি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পড়তে যেত। সে সব দৃশ্য মনে পড়লেই এখন কান্না পায় ওর। আরেকবার যদি সেই ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া যেত!
কিন্তু চোখের সামনে ওর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্বামী গোগ্ৰাসে ভাত আর ঝাল ঝাল শুয়োরের মাংসের ঝোল খাচ্ছে , ঋতালীর কাঁদো কাঁদো মুখ, তার সমস্যা কোনোটাই মাথায় ঢুকছে না অফিস যাওয়ার তাড়ায়। ঋতালী আর স্যামুয়েল দুজনেই সফ্টওয়্যার প্রযুক্তিবিদ। কিন্তু ঋতালী কয়েক গুণ বেশি মাইনে পায়। অন্যদিন এতক্ষণে বেরিয়ে যায়। কাল রাত থেকে তর্কাতর্কি চলছে স্যামুয়েল ডিকি গোমসের সঙ্গে। রাতে ঘুমটাও ভালো হয় নি।
ঋতালীর নতুন বডি অয়েলের শিশি অর্ধেক মেখে ছড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে প্রিয়াংকা, ওর ননদ। আলমারিতে মনে করে চাবি না দেওয়ায় বিয়ের নতুন দুয়েকটা আংটি সে পাচ্ছে না। ননদের নেশা করার অভ্যেস আছে। কলেজে পড়ে।
বাংলা ছাঁদের একটি বাথরুম ওদের আছে। ইংরেজি ছাঁদের বাথরুমটি ঋতালীর শয়নঘর সংলগ্ন। অথচ এটাতেই শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই স্নানকর্মাদি করবে। এতে প্রচুর অসুবিধা হয় নববধূর। দুয়েক মাসের বিবাহিত জীবনে এর প্রতিকার সে কীভাবে করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
যে ঘরে ঋতালী শোয় সেটি বিয়ের আগে ঋতালীর বাবা সারিয়ে টারিয়ে ঝাঁ চকচকে করে দিয়েছে টাকা ঢেলে। সঙ্গে এই নতুন বাথরুম। এর আয়না পর্দা বাথটাব ক্যাবিনেট ডোরম্যাট শাওয়ার কোমোড সব ত্রিতারাচিহ্নিত আভিজাত্য মাখানো।
স্যামুয়েলের বাবা যখন জাহাজে লাইটম্যানের কাজ করত তখন পয়সা নিজেই চোখে কানে দেখতে পেত না। এখন পুরনো পয়সার কারবার। মন্দা চলে। তবে রমণীমোহন আচরণের জন্য প্রেমিকাদের তেলে প্রেমিকাগুলোকে ভেজে ভেজে খান।
পাঁচ বছর ধরে প্রেম করার সুবাদে ঋতালী অনেক কিছুই জানে। শাশুড়ির অনেকটা সময় যায় পাগল সামলাতে। আবার বিবাহিত অবিবাহিত সতীনদের সঙ্গে খবরাখবর নেওয়া গালাগালি মান অভিমান এসব ছাড়া দিন কাটে না। কেরেস্তান সমাজের বৃত্তটা খুব ছোট। তার মধ্যে ঋতালী রোগা ফর্সা আর দাঁত ছরকুটে ঘোড়ামুখো। ভদ্রমহিলা অনেক চেষ্টা করেও ছেলের প্রেমবিবাহ আটকাতে পারে নি। সে পাখির চোখ করে রেখেছে পুত্রবধূর মাইনে আর একমাত্র কন্যা হওয়ার লাভজনক দিকটি।
মিঃ গোমসকে ঘিরে থাকে পূর্ব পুরুষদের ভিটেমাটি আর গুপ্তধন সংক্রান্ত কিছু মিথ। ঋতালী অনেক সময় ভেবেছে শ্বশুর ট্রেজার আইল্যান্ডের নায়ক। মিসেস গোমস অবশ্য বাঙালি পরিবারের। সিঁদুর পলা শাঁখা শাড়ি সবই চলে। জিন্স-শার্ট স্যুটেড বুটেড ঋতালীকেও চওড়া করে সিঁদুর লাগাতে হবে। কর্পোরেট অফিসে চাকরি আর চওড়া সিঁদুর দুটোর ভারসাম্য রাখতে গিয়ে ওর অবস্থা খারাপ। চাঁচাছোলা জিভ আর হাঁড়িচাঁচা গলা নিয়ে মিসেস গোমস দাপটে সংসার করে। ঋতালী অন্য দিকে ধীর স্থির নম্র। স্যামুয়েলের পকেটের জোর নেই হানিমুনে যাবার মতো। ঋতালী মেনে নিয়েছে।
সংসারে নয়নমণি আঠারো বছরের প্রিয়াংকা। উন্নাসিক। বদমেজাজি। উগ্র। যদিও কলেজে পড়ে ক্ষ্যাপাটে একটু আধটু। নেশা করে। গয়না চুরি যাওয়ার পর ঋতালী মানিব্যাগ সামলে রাখে। বাবা মাকে এসব কথা বলতে লজ্জা লাগে। অবশ্য গয়না সবই শাশুড়ির কাছে তালাবন্ধ। লকার কিনবে বলে কতবার তাগাদা দিয়েছে স্যামুয়েলকে। বিয়ের আগে যদিও বা বর জীবন্ত ছিল, এখন একেবারেই নীরস সদাশিব। তার মুখে একটাই কথা
- মা যা ভালো বোঝে!
এই যে বাথরুম নিয়ে সমস্যা। ঋতালীর শোবার ঘরের ভিতর জলের পাম্পের সুইচ। হানিমুন না হয় নাই হলো, আরাম করে রবিবারে যে দেরিতে উঠবে, তারও উপায় নেই। সকালে পাম্প চালানোর জন্য শাশুড়ি দরজায় ঠকঠক করেই যাবে। ঋতালী আজকাল গুম মেরে গেছে। অন্তত শ্বশুরবাড়িতে যতক্ষণ থাকে। কেমন যেন ঝালাপালা লাগে।
আজ কোমোডের ঢাকা তুলে বসতে গিয়ে দেখে, ময়লা জমে আছে। সৌজন্যবশত কেউ জল ব্যবহার করে নি। বর করে নি জানালো। তারপর?
ঋতালীর আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। প্রচন্ড রাগ লাগছে। স্যাম একটু মজা করার চেষ্টা
করল। কাজে দিল না। স্যাম বেসিনে মুখ ধুতে উঠে গেল। হঠাৎ একটা জান্তব চিৎকার আর দড়াম করে পতনের শব্দে ফিরে দেখে, ঋতালী অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। চোখ উল্টিয়ে শরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছে। সে মা-আ-আ-ম বলে চেঁচিয়ে ছুটে আসতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেল দরজায়। পিছনে আরো অনেকগুলো পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে স্যামুয়েল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন