রূপান্তর
ফোনের শব্দটা মৌমাছির গুনগুনের মতো
ক্ষীণ ভেসে বেড়াচ্ছিল ঘুমের ভেতরে। হঠাৎ রাত চমকে ঝনঝন! কোথাও কিছু ভাঙলো কি? ফোনই যে বাজছে
এটা বুঝতে খানিক সময় লাগলো। বিছানার এপাশে দেয়ালের দিকে শুই আমি। ঘড়ি, ফোন
সুশান্তের দিকে। সুশান্তের নাইট ডিউটি আজ। আজকাল প্রমোশন কল ছাড়া ল্যান্ডফোনে কল
আসে না। ধাতস্থ হয়ে ফোনটা ধরতে ধরতেই কেটে গেল। বেডসাইড সুইচ অন করে কলার আইডিতে
নাম দেখি। ‘মার্থা
মায়ার’। এত
রাতে! তক্ষুণি আবার বেজে উঠলো ফোনটা। ওপারে ফিসফিস, ‘স্যু ইজ দ্যাট ইউ?’ ‘কী হয়েছে
মার্থা?’ আমি সোজা হয়ে বসি। ‘ম্যাথ্যু রান্নাঘরের সিংক ধরে দাঁড়িয়েছে’। মার্থা
ফোঁপাচ্ছে। ‘থেঙ্ক্যু স্যু’। ‘কটা বাজে?’ ‘চারটা। সরি আই ওক ইউ আপ’।
‘ইটস ওকে কিন্তু এত রাতে
রান্নাঘরে কী করছিল ম্যাট?’ ‘ইট’স মাই বার্থডে। আই গ্যেস ম্যাট ওয়ান্টেড
টু গিভ মি দ্য আল্টিমেইট বার্থডে সারপ্রাইজ’, ওর ধরা গলায় থইথই করছে খুশি।
কিছু একটা ভাঙার শব্দে ওরও ঘুম
চটেছিল। ‘ম্যাট আমাকে জাগাতে গ্লাসটা ভেঙেছে। তোমার কথাই
ঠিক; ম্যাটের জন্যেই আমার এই পৃথিবীতে আসা’। আমি চোখ বুজে ফোনের ওপ্রান্তে ম্যাটকে কল্পনা করি। ‘ধন্যবাদ
স্যু’, মার্থা ফোন রেখে দেয়।
আমি চুপচাপ রিসিভার হাতে বসে
থাকি।
কুড়ি বছর আগে এমনই আঁধার ছিল
সেদিন। সূর্য আড় ভাঙেনি। ফরসেপ ডেলিভারি! জন্মের পর কাঁদেনি ও। আইসিইউ-তে
গাদাখানেক পাইপের ভেতরে চোখ বুজে শুয়েছিল
আমার সোনাবাবুটা। মেঘের মতো তুলতুলে শাদা। নামটা তখনই মনে আসে, ‘অভ্রনীল’। পাঁচদিন পরে
কোলে নিয়েছিলাম ওকে। সেই
অনুভূতি বর্ণনার ভাষা নেই আমার।
নিকেশটা শুরু হলো আরো পরে। আর
দশটা বাচ্চার মতো ও ছটফটে নয়। তিন মাসেও
ঘাড় শক্ত হলো না! ডাক্তার স্টেথো ঘুরিয়ে ওর ছোট্ট বুকের শব্দ শুনতে শুনতে জানান, ‘কারো
কারো একটু সময় লাগে’।
এরপর এক শীতের দুপুরে সুশান্ত
চেঁচিয়ে ঘর মাথায় করে, ‘অভ্র দেখতে পায় না!’
ওর প্রথম জন্মদিনে একটা নীল
রম্পার কিনেছিল সুশান্ত। শক্ত হাত-পা গলিয়ে জামাটা ওকে পরাতে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। হাতে লেগেছিল
হয়তো, অনেক কেঁদেছিল সেদিন। সেই জন্মদিনে একটাই ছবি তুলেছিল সুশান্ত। কাউকে
ডাকিনি। কী দরকার ‘আহা উহু’ শোনার! ঠিক চব্বিশদিন পরেই মাত্র তিন দিনের জ্বরে ও চলে
গেল।
দ্বিতীয় জন্মদিনে সুশান্ত সেই
ছবিটা বাঁধালো। কী সুন্দর হাসি-টলটল চোখ জোড়া! কিন্তু রম্পারটা পরানোর সময়
তো ও অবিরাম কাঁদছিল। ওর চোখদুটো এত্ত সুন্দর! আগে এত খেয়াল করিনি তো! অথচ ওর খুঁতগুলো
কেমন মগজে জ্বলজ্বলে তাজা।! কেমন মা আমি! নিজেকে নর্দমার কীট মনে হচ্ছিল। ত্রিভুবনে কোনো
প্রায়শ্চিত্তই আমাকে শুদ্ধ করবে না। একটা গোটা সমুদ্র বুকের ভেতর থেকে আছড়ে পড়ছিল যেন ডাঙায়! ছবিটা আমি টাঙাতে দি’নি।
নর্থ আমেরিকায় চলে এলাম সব ছেড়েছুড়ে। শুধু সেই চোখ
জোড়া সঙ্গ ছাড়লো না আমার। সুশান্তের শত মিনতিতেও আর মা হলাম না।
ডাঃ ডেবোরাহ্র সাথে এক সেমিনারে পরিচয়। ও সোম্যাটিক হিলিং নিয়ে
গ্রাউন্ড ব্রেকিং কাজ করছে। ডেবির প্রেজেন্টেশন দেখে আমি যেন বাঁচার নতুন মানে খুঁজে
পেলাম।
ফিজিও থেরাপির কোর্স করলাম। সার্টিফাইড
থেরাপিস্ট হলাম। একদিন
ডেবি মানে ডেবোরাহ্র প্রতিষ্ঠানেই থেরাপিস্ট টিমের একজন হলাম। একটা অদ্ভুত
ব্যাপার হলো; ক্লিনিকে আসা সেইসব বিশেষ শিশুদের চোখে আমি অভ্রনীলের চোখজোড়াই দেখতে
লাগলাম।
ডেবির সোম্যাটিক হিলিং
দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি। কোনো ওষুধ নেই। নেই কোনো যান্ত্রিক অবলম্বন। কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস, ভালোবাসা,
পরিবার, ডাক্তার এবং শিশুর নিজের ইচ্ছাশক্তি - এই মিলে হিমালয়ে চড়ার মতো দুরূহ
অভিযানে নামি আমরা।
দু’বছর আগে ম্যাথ্যু বা ম্যাটকে
নিয়ে এসেছিল মার্থা। সেদিন আমি ম্যাটের চোখে অভ্রকে দেখতে পাইনি। কী নিরুত্তাপ
জীবনবিমুখ চোখ! ম্যাটের মেডিক্যাল রিপোর্ট বলছে, জন্মের পর বাঁচার কথাই ছিল না ওর। ফাইল থেকে চোখ
তুলে ডেবি মার্থাকে বলে, ‘ও তো জাত যোদ্ধা’। মার্থা তাও নিরুত্তাপ। আঁতকে উঠি আমি! এ তো কুড়ি বছর আগের
আমি! হঠাৎ মনে হলো এরাই আমার প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যম। ডেবির চোখ এড়িয়ে মার্থাকে বলি, ‘ম্যাট দাঁড়াবেই’। শুয়োপোকার মতো হুইল চেয়ারে গোটানো ম্যাটের
হাত ছুঁই, বলি, ‘ইউ ক্যান ডু ইট’। ম্যাট হাসে। অদ্ভুত
এক প্রশান্তিতে মন ছেয়ে গিয়েছিল সেদিন; অভ্রনীলকে প্রথম কোলে নেয়ার সেই অনুভূতি
যেন!
ভোরের আলো জানালার কাচ চুঁইয়ে
উঁকি দিচ্ছে আমার বিছানায়। ল্যান্ডফোনের রিসিভারটা রাখি জায়গামতো। অভ্রনীলের
হাসি টলটল ছবিটা টাঙাবো আজ।
ভালো গল্প। মায়াময়।
উত্তরমুছুন