নদীর
ওপারে
ভোরের এই সময়টা খুব সুন্দর।
আলো
নামে তখন একটু একটু করে গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায়। নদীর শরীরে জমে
জলের আদর। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে রঙ।
সকালের শুরু এমনই শুদ্ধ আর পবিত্র। বেলা যত বাড়ে নানা ধুল-ঝুল-কালি মনের খাঁজে
খাঁজে জমে বাড়িয়ে তোলে কতরকম গ্লানি। রাতুলের প্রতিটা ভোর শুরু হয়ে এখানকার জল
হাওয়ার শুদ্ধতায়। এ আলোয় রাতুল শুদ্ধ হতে চায়। কেউ কি জানে আর একটু পর কী ঘটতে
চলেছে! জানে না বলেই এক মাথা ধূসরতা নিয়ে
কেউ দীর্ঘকাল টিকে যায় এই পৃথিবীতে, কেউ হয়তো পথ শুরু হবার আগেই
হারিয়ে ফেলে ঠিকানা।
এবার
বেশিরভাগই অতিবৃষ্টিতে কাটিয়ে প্রকৃতিতে শীত এসে গেছে আগেভাগে। রাতুলের গায়ে একটা
মরচে লাল পুলওভার আর সাধারণ বারমুডা। পায়ে সাধারণ হাওয়াই চটি। ভোরবেলার শীতল হাওয়া
চোখেমুখে লাগছে। রাতজাগা মুখে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। রাতুল তার শরীরের ভার
একবার ছেড়ে দিচ্ছে ডান পা আরেকবার বাম পায়ের ওপর। যেন আজ শুধু ভোর নয় আরো কিছুর
অপেক্ষা। তার দৃষ্টি সেতুটার দিকে, যার একদিক দৃশ্যমান হলেও
অন্যদিকটা ঢাকা পড়ে গেছে শীতের কুয়াশায়। একটা বাইসাইকেল পাকুড় গাছটার
গায়ে হেলান দিয়ে রাখা।
এ
নদীর নাম মধুমতী।
মধুমতী
নদীর ওপাশেও আছে আরেক শহর। সেখানে যারা থাকে তাদেরও কেউ কেউ ভোরের প্রথম আলোর
প্রত্যাশী। তারাও মধুমতীর তীরে দাঁড়িয়ে জীবন নিয়ে ভাবে। যেমন মধুজা, এ মুহূর্তে
নদীর দক্ষিণ পাড়ে পৌরসভার উদ্যোগে প্রাতঃভ্রমণকারী এবং সাধারণের জন্য বসা এবং
হাঁটার জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটার একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে ভাবছে
জীবন নিয়ে। তার মনে হচ্ছে, জীবন আসলে নিজের ধর্মেই চলে আর জীবনের ব্যাপক সময় আমরা নষ্ট করে ফেলি
স্রেফ আবেগের বশে। এই যে মধুমতী তারও চলার ধরন আছে, জলপ্রবাহের
কলকল শব্দ আছে। হাওয়া মৃদু হলে সুখের পরশ
জাগে, ঝড়ো হলে ভেতর বাহির কাঁপিয়ে তোলে। অথচ সময়... কী নিঃশব্দ
তার চল... বোঝার আগেই হারিয়ে যা... মধুজার ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলী ধ্যানীর মতো
বিশেষ মুদ্রায় এসব সময়ে পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকে। যেমন ছুঁয়ে ছিল তারা, পরস্পরকে।
রাতুল
বিশ্বাস করে দিনের শুরুটায়
সেতুর ওপাশেও কেউ আছে। যেমন তার জীবনে ধ্রুবতারার মতো সত্যি হয়ে আছে আজও ওই নাম।
রাতুল জানতো সে মুখে ফুটে থাকা অপেক্ষার নাম, রাতুল। আজ মনে হয় জীবনে ধ্রুব
বলে আসলে কিছু নেই। যা কিছু সত্যি বলে আমরা ভাবি তা আদতে আপেক্ষিক। নইলে মধুজা রাতুলকে
ছেড়ে, কী করে চলে গেলো সেতুর ওপাশে! রাতুল আজও বুঝে পায় না
কেন এই বিচ্ছেদ! ছোট ছোট অপূর্ণতা সবারই থাকে। তাদেরও ছিল। হয়তো মধুজার মনের কথা রাতুল সবসময় পড়ে উঠতে পারত না।
তারও তো কত রকমের ব্যস্ততা। কিন্তু ভালোবাসার ঘাটতি তো ছিল না। ছিল প্রবল আবেগ। আবেগের তীব্রতা থেকেই কি জন্ম নেয় অভিমান! যে
অভিমান জমাট বাঁধতে বাঁধতে একদিন হয়ে ওঠে নিরেট দেয়াল...
মধুজা
ডান হাত দিয়ে গায়ের গরম চাদর টেনে সোজা হয়ে বসতে গিয়ে লক্ষ্য করলো কুয়াশা কেটে
অনুজ্জ্বল রোদের দেখা মিলছে। এবার সে ঘরে ফিরবে। ঘরের কথায় ম্লান এক চিলতে
হাসি নিচের ঠোঁটের বাম কোণে এসে থমকে যায়। যেখানে সে থাকে তাকে ঘর বলা যায় না
কিছুতেই, তবু মাথা গোঁজার ওইটুকু জায়গা সে করে নিয়েছে । একার সাথে বসবাসে আর যাইহোক
অনুভূতির লেনদেনে ঘাটতি ঘটে না। ফেরার আগে কোণের চাওয়ালার কাছ থেকে মধুজা এখন এককাপ
চা আর দুটো নোনতা বিস্কুট নেবে। রোজ পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে যে নেড়ি তাকে বিস্কুট
খাওয়াবে। তারপর হাঁটা দেবে শহরের পুব দিকে। মধুজা কি নিয়তিতে বিশ্বাস করে! নিজেকে
প্রায়ই এ প্রশ্ন করে, উত্তর বেশিরভাগ দিন না-বোধক
হয়। এক আধদিন আবার নিয়তির দিকেও চলে যায়।
যেমন আজ চা খেতে খেতে মনে হলো যা কিছু ঘটে তা পূর্ব নির্ধারিত না হলে তার তো
রাতুলকে ছেড়ে থাকার কথা নয়! আবেগ, অভিমান, জিদ এসব
অর্থহীন শব্দের চাইতে নিয়তি বেশি ওজনদার। নইলে এই পাঁচ বছরে দেখা হতো না! নিয়তিই
ছাড়া আর কী!
মধুজা
যখন এইসব এলোমেলো ভাবনায় ডুবে শহরের পুবদিকে যেতে গিয়ে আনমনে পা বাড়িয়েছে সেতুটার
দিকে, তখন সেতুর
ওপাশ থেকে একটা অস্পষ্ট কালো বিন্দু ক্রমে স্পষ্ট হতে হতে সাইকেলের রূপ নিচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন