ডিলিট
শ্বেতা আড়চোখে ফোনের দিকে তাকালো। নাহ কোন মেসেজ আসেনি। থাক, কাজ করুক। উঠে বারান্দায় গিয়ে বসলো সে। এই বারান্দার দামে যেন গোটা বাড়ি কেনা যায় সেইরকম দামী। বেতের ইজিচেয়ার আর সাইড টেবিল, টেবিলে কফির সরঞ্জাম। সারা বারান্দায় লাগাতার গাছ লতানো প্রান্ত। আর কিছু ঘ্রাণবর্জিত ফুল।
এই গন্ধ ছাড়া ফুলগুলির আলাদা একটা অরুণিমা সৌন্দর্য আছে। রঙ্গন, দোপাটি, নয়নতারা, লিলি আর আছে ফার্ন। ফার্ন খুব পছন্দ ছিল মাহির। খুব মুগ্ধ হয়ে সে ফার্নের ঝোপ দেখতো। আর বলত, তোর চুলের মতো ঝোপ রে! দেখলে মনে হয় একসাথে সব হাতে নিয়ে ঝুঁটি করে দিই।
মাহির মুখের
আদল তেমন বদলায়নি। সবচেয়ে
বেশি এক রকম আছে চোখ। চশমার ফাঁকে চোখে দেখে চমকে গেছে শ্বেতা। বায়োস্কোপ চোখ, তাকালে
অনেক কিছু দেখা যেত। শ্বেতা মজা করে বলত, তোর চোখে সাদা অংশটা বেশি রে! রুপালি
পর্দা।
কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ভাবতে ভাবতে। কেন
এত ভাবছে নিজেই বুঝতে পারছে না। রাজ্যের
খাতা পড়ে আছে, দু’ দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে। মাথাটা দপদপ করছে। শ্বেতা উঠে গেল গায়ে মাথায় পানি দিতে। জোরে
জোরে চোখে জলের ঝাপ্টা দিতে থাকলো। কুড়ি পঁচিশবার
ঝাপ্টা দিয়ে আয়নায় ভেজা মুখে তাকালো শ্বেতা। সেই মাহি টলটলে
চোখে তাকিয়ে আছে। জলের ঝাপ্টায় দৃষ্টি সরানো যায় না। যে কোনোদিন সামনে এসে
তাকায়নি, সে কীভাবে আয়নায় আসে!
দশবার লিখে বিশবার ডিলিট করা শেষ, বারবার ভাবছে শ্বেতা যদি কিছু মনে করে। যদি হ্যাংলা ভাবে! যেন ঠিক এই সময়ের জন্যই তক্কে তক্কে ছিল। অথচ সেরকম অস্বস্তির কিন্তু কিছু নেই মাহির। গুছিয়ে কথা সারা কলেজেই বলতে পারেনি সে। শেষ সময়ে না পারতে ক’টা লাইন লিখে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সে সব দিয়ে নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া সময় ভেসে গেছে।
আসলে এখন নতুন করে কিছু ডানা মেলার নেই। যে কথা যখন বলার তা যদি একবার বলার রাস্তা হারিয়ে ফেলে তবে সেই সুর চিনে চিনে আর পথ ফেরে না। মাহি শুধু একা পথ হারায়নি, পথও তাকে হারিয়ে ফেলেছে।
এপর্যন্ত লিখে শ্বেতা মেইল পাঠালো।
‘দেখ হয়েছে?’
‘হলো কোথায়? তুই তো কোনো রোমান্টিক দৃশ্যই রাখিসনি!’
‘এর মধ্যে কখন আবার রোমান্টিকতা? এক থাবড়া খাবি!’
‘আছে তো। কত কত দিন পর দেখা হলো। একটু তোকে জড়িয়েই ধরলাম না, কিছু না। এভাবে শেষ হয় নাকি! আমরা খোলা পথে ঘুরতে যাব। গান শুনি না কতকাল তোর। পাশে বসে শুনবো। আমরা গ্রামের বাড়িতে যাব। মাঝরাতে বারান্দায় বসে কফি খাবো। তোর হাত ধরবো তো!’
‘সেখানে ঝিরঝির বাতাস থাকবে। পুকুরপাড় থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে তোকে আমাকে উতল স্পর্শ দেবে’। শ্বেতা যোগ করছে আর পায়ের নখে নেইলব্রাশ লাগাচ্ছে।
‘তোর চুলগুলো হাওয়ায় কোথায় কোথায় উড়বে ঠিক নেই। আমি দিশা হারিয়ে নিঃস্ব হব। পুকুরের শান বাঁধানো পাড়ের ধার ঘেঁষে অগণিত জোনাকের সংসারটা জ্বলবে আর জ্বলবে, আবার তাড়া শেষে নিভে নিভে ঘুম ঘুম শান্ত হয়ে যাবে’। মাহির কন্ঠে আবেগ।
‘এ পর্যন্ত ভালো হলো তো। কফি খাওয়া শেষ’। শ্বেতা শেষ করে দিচ্ছে।
‘কফি খাওয়া শেষে আমরা দুজন...’ মাহি শুরু করে।
‘বাকিটা আমি জানি। কফি খাওয়া শেষে মগগুলোকে আমরা বিদায় জানাবো। আজ এখানেই আমাদের শেষ প্রহর। কিছুক্ষণের মধ্যে না উঠলে আমরা ট্রেন মিস করব রে!’ শ্বেতার ক্লান্ত স্বর।
‘এটা কখনও হয়? আজ আরেকটু থাকি। সেদিন তো কিছু বলতে পারিনি ছায়ানটের করিডরে। শুধু কয়েকটা কালো অক্ষর আর সাদা পাতা। তুই শোন একটু...’
শ্বেতা দ্রুত উঠে পড়ল। হ্যান্ডব্যাগটা ছাড়া আর তেমন কোনো লাগেজ নেই। সে কাঁধে হ্যান্ডব্যাগ ঝুলিয়ে রওনা করলো। পিছনে তাকাচ্ছে দনা। জানে মাহি তাকে একা ছাড়বে না। আসবেই। এখান থেকে আজ যেতেই হবে। যা কিছু ঘটেনি তা আর ঘটতে দেওয়ার সুযোগ নেই।
এ পর্যন্ত লিখে গল্পটা হুট করে ডিলিট করে দিল শ্বেতা। চট করে চোখে শ্রাবণ। মাহিকে আর গল্পটা পাঠাবে না। ল্যাপটপ বন্ধ করে কতক্ষণ চুপ বসে থাকে। মেয়ে কফি চেয়েছে অনেকক্ষণ। মাঝরাতে কফি টাইম মা মেয়ের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন