সোনাবৌ
কমলা রঙ চওড়া পাড় সাদা
মিহি চিকনের শাড়িটা ধুলায় লুটিয়ে। এই গুটিয়ে থাকা শাড়ির ভেতর কোনো মানুষ আছে
বলে বুঝতেই পারিনি। আকাশের হাল্কা লালচে আভা শেষ বিকেলে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। একেই কি কনে
দেখা আলো বলে?
লাল কাচের চুড়ি ভর্তি চিকন সরু হাতের অনামিকায় একটি আংটি
জ্বলজ্বল করছে।
কে? কে ওখানে?
একটু এগিয়ে যেতেই চমকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম উল্টে।
এ কী দশা? এ যে উত্তর
পাড়ার মাস্টারবাড়ির সোনাবৌ! এখানে? কী করে?
‘এ পাড়ায় আরেকটি নতুন বৌ এলো বুঝি, সুবাস? তবে যা বলবে
বলো,
বৌ বলতেই এই পাঁচ
পাড়ায় যার কথা মন বড় করে সকলে বলে, সে হচ্ছে গিয়ে সোনাবৌ, বুঝলে?’ রোয়াকে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে টেলিভিশনের খবরে চোখ যায় বজলুর রহমানের – “প্রধান নির্বাচন
কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সময় জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশে
বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করেন। এ নিয়ে রাজনীতির মাঠ
সরগরম”…
‘শা…লা… একাত্তরের খুনি-রাজাকার
পুনর্বাসন করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চৌদ্দটা বাজিয়েছে, সে নাকি পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা? এ দেশে ইতিহাস
বিকৃতিটাই বেশ প্রতিষ্ঠা পেলো, কী বলো?’
‘তা যা বলেছেন বড়’দা! না হয়, এই ক’বছরের মধ্যেই জামাত বিএনপি’র তান্ডব, ধ্বংসলীলা ভুলে যায় মানুষ? আর জিয়ার মতো পাকিস্তানর চর যদি এত জনপ্রিয়তা পায়, তা কিসের বিনিময়ে, সে কী আর বুঝি না আমরা?’
বজলুর রহমান চরম বিরক্তি নিয়ে বলেন, ‘সুবাস, ছাড়ো তো এসব
নষ্ট লোকেদের কথা। কে যে কার স্বার্থে মত্ত, কে জানে ভাই! ধুর!’ রিমোট টিপে বন্ধ করে দিলো টেলিভিশন।
মুখ টিপে বীরত্বের হাসি হেসে আবার বজলুর রহমান বলে ওঠে, ‘ভাগ্যিস টেলিভিশন বন্ধ
করার সুযোগ আমাদের হাতে আছে, কী বলো ভাই, সুবাস?’ ‘…হাহাহা হাহা… দাও দেখি চালটা দাও এবার। ওসব ভেবে আর কাজ নেই। আমরা এই দাবার বোর্ডেই রাজা মন্ত্রী মারি, চলো…’
সুবাস কাকার সঙ্গে কাল সন্ধ্যায়ও এভাবেই দাবার বোর্ডে আড্ডা
চলছিলো প্রতিদিনকার মতো। আমি আমার রুমে বই
পড়তে পড়তে শুনছিলাম। সোনাবৌ ছিল তাদের আড্ডার ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু
সোনাবৌ আমাদের বাড়ির রাস্তায়… এভাবে…
আশে পাশে কাউকেই দেখছি না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে?
অত সাত পাঁচ ভাববার সময় নেই, বাবার কাছেই নিতে হবে। এ তল্লাটে আর ডাক্তার কৈ? যা একজন মহিলা জেলা পরিষদে নতুন বদলি হয়ে এসেছিলেন, তিন মাসের মাথায় গত মাসেই বদলি নিয়ে চলে গেছেন বিভাগীয় শহরে। অজ পাড়া গাঁ
না হলেও গ্রামে কোনো মহিলা ডাক্তারের থেকে যাওয়া বড্ড কঠিন এখনো।
‘বাবা, বাবা!’
‘এ কী গুঞ্জন! কেন ডাকছিস
এমন হাঁকাহাঁকি করে?’
‘বাবা, এই যে দ্যাখো, মাটিতে পড়ে রয়েছে সোনাবৌ…’
‘ও কী! ধর্,
ধর্, দেখি। কবির আমার
স্টেথোটা আন দেখি! এখানে এলো কখন, কী হলো হঠাৎ? গুঞ্জন, তোর মা’কে ডেকে নিয়ে আয়, বরফ দিয়ে একটু তেঁতুল জিরার শরবত আনতে বলিস’।
মা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে বারান্দায় এলো। বাবার চেম্বারের দিকে
ছুটে যেতে যেতে বলল, সোনাবৌ নাকি
আমাদের রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে? যা গরম পড়েছে, এতটা পথ কি
হেঁটে এলো এই রোদে? দেখি... দেখি...’
এবার মায়ের হাত সোনা বৌয়ের মাথার নিচে। বুকে টেনে নিলেন মা
সোনা বৌকে। ‘ও সোনাবৌ, কী হলো তোমার?’
একটু চোখ মেলে দেখলো সোনাবৌ, আবার অজ্ঞান। বাবা
তাড়াতাড়ি করে এবার একটা ইঞ্জেকশান দিলেন। মা’কে বললেন পাশে
বসতে।
কেন সবার এত প্রিয় সোনাবৌ? সবার যদি এত প্রিয়ই হবে, তাহলে এমন একলা কেন মেয়েটা!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন