নিস্তব্ধের শব্দ
একটা শব্দ লাফ দিয়ে আমার সামনে পড়তে চমকে বেয়াল্লিশ।
শব্দের ভেতর থেকে তার লুকোনো কথাগুলোকে টেনেটেনে বের করব, নাকি যে সব মানে নেই তার উপস্থিতি খুঁজব বুঝে পাই না। একটা শব্দ উচ্চারণে কত শব্দই যে অনুচ্চারিত থেকে যায়! তোকে নীরবে বুঝিয়ে
যাই। শব্দ মানে চিহ্ন। আর চিহ্ন
দিয়ে চেনা যায় বায়ুমণ্ডলের হাজারো স্তর। সূর্য নেমে এলে আকাশ লাল হয়। আকাশী আকাশ কেন লাল হয় ভেবে ডাইনিং টেবিলের কোণা
ধরে টেনে আনি। নীচে ঘাস নেই। ঘাসফুল নেই। ঘাসের মতো কিছু ঝুল জমে আছে। টেবিলটা সরে
যেতে আলো পড়ল সেই ঝুলের ওপর। ঝুলটা স্মৃতির মতো ওখানেই থেমে থাকে। তুই থাকলে ঝুলটা
ওখানে থাকতো না। স্মৃতি আর ঝুল সমার্থক হয়ে ওঠে। সম্পর্কহীন ঝুল কেমন আপন হয়ে যায়।
শরীরে আঙুল বোলানোর মতো তর্জনী দিয়ে রোদটাকে কাটাকুটি করি –
ঝুলটা থেকে একবার মোরগজটা ফুলের মতো লাল শব্দ ওঠে, পরক্ষণে কালো। টেবিলের কাচের ওপর আঙুল দিয়ে
ঠুমরী বাজাতে যেতে শুয়ে থাকা গ্লাসটা মেঝেতে পড়ে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে। গ্লাসটা ওখানে কয়েক যুগ
ধরে নীরবে বসে ছিল। নির্বাক, বোবা। গ্লাসের গায়ে এত শব্দ লুকিয়ে ছিল ভেবে অবাক হই। গ্লাস পড়ার মেকানিক্যাল শব্দ
শরীরে তীব্র তড়িৎচুম্বকীয় অনুভূতি নির্মাণ করে। যে অনুভূতি কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া। সোডিয়াম আর পটাশিয়াম
ব্যাল্যান্স। গ্লাস, মেঝে আর বায়বীয় শব্দের সম্পর্কের মধ্যে সূর্যের নির্মাণ
একাকার হয়ে যায়। কার্তিকের বিকেলে সূর্যের চপ্পলে পা গলিয়ে তিনটে জীবনানন্দীয়
শালিক পৃথিবী থেকে উড়ে যায়। রোদটা কাটাকুটি হয়ে শালিকের যাওয়াটুকু পড়ে থাকে। অপেক্ষা
করি গ্লাসের শব্দটা রোদের সাথে মিশে যাওয়া পর্যন্ত। ততক্ষণে রোদটা নির্বাক হয়ে গেছে।
পাপোশের ওপরটা এখনো গরম। তার কাছে যেতে পাপোশটা আদুরে শব্দ
করে উদগ্রীব হয়ে থাকল। একটা কালো বেড়াল কিছু আগে ওখানে শুয়েছিল। তুঁতে রঙের চোখ
বন্ধ করে। শীতের রোদ পাপোশের ওপর থেকে সরে গেছে। অনুচ্চারিত বেড়ালের উষ্ণতার
স্পর্শ পায় শরীর। সেই স্পর্শের সাথে আমি জুড়ে যেতে উষ্ণতার মানে বদলে যায়। উষ্ণতা
একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে। বেড়ালের নিজস্ব একাকীত্ব আমার শরীরে সংলাপ বলে চলে।
সুকুমার রায় এমনি করে রুমাল থেকে বেড়ালের অস্ত্বিত্ব নির্মাণ করেন। অথবা বেড়ালের
দুঃখটা। পাপোশ থেকে দুঃখটা শরীর
জড়িয়ে ধরে।
তুই নেই। কতদিন ছোঁয়া হয় নি। আজকাল তোকে খুব মিস করি। আজকাল নিস্তব্ধের শব্দ
শুনতে পাই।
খুব সুন্দর বিরহের আল্পনা দেওয়া
উত্তরমুছুন