মনোলগ
(১)
রাতের আকাশে কত আগুন থাকে, তা জানে জ্বলন্ত তাপে পুড়ে যাওয়া ঘুমহীন দু’চোখ। আলের বাঁক পেরিয়ে যাওয়া মৌনতা
জানে,
দীর্ঘশ্বাসের মুখরতা... বুকের পাহাড় ডিঙিয়ে যখন নেমে আসে
লাভা-নদী,
তখন মরে যাওয়া চারাগাছগুলি ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে ওরাও বাঁচতে
চেয়েছিল...
আমার ছাদের কার্নিশে ঝংকার তোলে সহস্র আত্মহত্যার কঠিন
বুটের শব্দ। আমি স্থবির, বোবা ঠোঁটে
চাবুকের শাসন এঁকে বালিশের উঠোনে আঁকি নি:শেষ আদর।
দেখি মৃত্যুর বাঁকে আমায় জড়িয়ে ধরে আছে পিক্টোগ্রাফে ভেসে
ওঠা টলটলে তোমার নামের আদি অক্ষর...
(২)
শব্দের এক অদ্ভুত দ্যুতি থাকে। ছাইভস্ম মাখা রোজনামচার গায়ে
ভেজা গামছার মতো তাকে পেঁচিয়ে নিতে নিতে বুঝি, আসলে সবই শুধু মায়াজাল... মুহূর্তের অবদান।
আমার জানালার সার্শি ঘেঁষে রোজ একটা শালিক এসে বসে। ওর
বাদামী পাখায় রোদের ঝিলিক পড়লে যেমন
ফ্যাকাসে গন্ধ উবে যায়, তেমনি তুমি
চলে যাওয়ার পরেও তোমার উচ্চারিত ধ্বনিরা আমার খুলির ভেতর রোজ নতুন সাজে সেজে
মন্ত্রপাঠ করে।
আমি চেয়ে থাকি, আঙুলের ফাঁক দিয়ে হেঁটে চলে জন্ম থেকে জন্মান্তর।
বলিকাঠের হাঁ করা মুখের ভেতর গলে যায় আমার সমস্ত প্রতীক্ষার
দিন-রাত।
তারপর... অসংখ্য উলুধ্বনির ফেটে পড়া শীৎকারে তোমার আদরের
স্পর্শগুলো ভেসে ওঠে বিসর্জিত প্রতিমার মতো, ধীরে ধীরে...
(৩)
আজকাল অনায়াসেই মুঠোর ভেতর বালি চেপে ধরার চেষ্টা করি, এটা জেনেও যে মুহূর্তে মুঠো হয়ে যাবে খালি, শুধু কিচকিচে সময়ের দাগ বহুক্ষণ কথা বলে যাবে নিয়তির সড়কপথে।
আমার কপাল আয়নার গায়ে ঠেকিয়ে দেখি ওপারে ফুটে উঠেছে নিয়তির
চুপকথা চলাচল...
ঘেমে ওঠা ঝাপসা কাচ বোবা হয়ে যায় পারদহীন প্রলেপের মতোই।
সে ছায়ায় শুধুই কুয়াশা, আত্মদর্পণের আলিঙ্গন ছোঁয় না অস্তিত্ব।
ঠিক যেমন আজকাল তোমার শরীরের সবটুকু ভার আমি আমার দু’পায়ে
বয়ে নিয়ে চলি অবিরত...
বিম্ব থেকে প্রতিবিম্বে ফিরে আসে তির্যক আত্মযাপন।
পরিক্রমা
অন্ধত্বের সীমানায় দাঁড়িয়ে আলো
হাতড়িয়ে দেখেছি, বক্র আর সরল রেখাগুলি কেমন
একই ভাবে বৃত্তের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়... কোনো তফাৎ পাইনি আর।
নাগরদোলার আঁচলে দুলতে দুলতে যখন শূন্য থেকে সমতলে নেমেছি, তখন বুকের ভেতর যেমন করে ধ্বস নামার শব্দ শুনেছি, সেই শিহরণে প্রবল আনন্দ কেমন ভয়কে ছাপিয়ে এক তীব্র হাসির
বিস্ফোরণে আছড়ে পড়তে শুনেছি মুহূর্তকে। মনে হয়েছে, মাথার ভিতর
শূন্য হয়ে আসা ধূ ধূ যে ফাঁকামাঠ, তার গায়ে আমার
স্বপ্নের বীজগুলো ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে একটু একটু করে মুখ তুলছে কেমন...
মায়ের পাঁচ-আঙুলের গায়ে লেপ্টে থাকা চটকানো ভাত, আর আমার আহ্লাদী খিদে
যেখানে মিলেমিশে একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেছে, সেই বিন্দুতে ঘুমের আল বেয়ে নি:শব্দে এসে দাঁড়িয়েছি আমি একা, আর দেখেছি কোথাও কোনো শূন্যতা নেই, নেই কোনো অন্ধকার...
আমি মিশে যাচ্ছি আলোর পরতে পরতে
বলয়ের পর বলয় পেরিয়ে কেবল
পরিক্রমা...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন