বন্য বন্য এই অরণ্য ভালো
বাঙালির একটা বদনাম আছে, সে নাকি ‘দীপুদা’র কাছে ছাড়া আর
কিছুই বুঝল
না! শুরুতেই নিশ্চয়ই হোঁচট খেলেন, ‘দীপুদা’! সেটা আবার কে? ‘দীপুদা’ হলো
বাঙালির চিরন্তন দীঘা-পুরী-দার্জিলিং। এই বৃত্তেই নাকি
বাঙালি ঘুরপাক
খায়। আমি কিন্তু কিছুটা হলেও সেই দুর্নাম কাটাতে পেরেছি।
আমার কর্তা
বিভিন্ন অফবিট জায়গায় ঘুরে বেড়ান। বিয়ের কিছুদিন আগেই তিনি
ডুয়ার্স
গিয়েছিলেন। আমাদের প্রেম তখন মধ্য গগনে। কিন্তু বেছে বেছে
উনি এমন এক
জায়গায় গেছেন যে এই যুগেও ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। কথায় বলে
বাঙালি জীবনে প্রেম নাকি কাঁঠালের আঠা। কথাটা বিলক্ষণ সত্যি। কারণ সুযোগ পেলেই
আমাকে টুক করে ফোন করে নিচ্ছে কোনও ঐতিহাসিক টেলিফোন বুথ থেকে। আর এত সুন্দর বর্ণনা
দিচ্ছেন যে আমি দিব্য চোক্ষে সব দেখতে পাচ্ছিলাম।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘আবার অরণ্যে’ এসব দেখছি আর
ভাবছি। কবে যাব এমন
একটা জায়গায়। বুদ্ধদেব গুহের উপন্যাস পড়ে জঙ্গলের প্রেমে
পড়ে গেছি। মনের
মধ্যে প্রতিদিন ছবিটা আঁকতাম। চারিদিকে জঙ্গল। মাঝখানে
ইংরেজ আমলের তৈরি
একটা কাঠের বাংলো। সন্ধ্যেবেলায় ঝিঁঝিপোকার ডাক। টিমটিমে
আলো। গা ছমছমে পরিবেশ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ আরও রহস্যময় হতে থাকে। ডিনারে
দেশী মুরগীর ঝোল আর গরম গরম ভাত। দূর থেকে ভেসে আসছে হাতির ডাক। আহা! কী রোমাঞ্চ।
এইরকম কল্পনা করতে করতে শীত এসে গেল। কমলালেবু রোদ্দুর গায়ে মেখে আমরা চললাম
ডুয়ার্স।
আমাদের গন্তব্য রাজা ভাত খাওয়া। আগে যখন টিভিতে এই নামটা
শুনতাম মনে মনে হাসি পেত। ভাবতাম এ আবার কীরকম জায়গার নাম! শিলিগুড়ি জংশন ছাড়িয়ে কাঞ্চনকন্যা
এক্সপ্রেস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে আলিপুরদুয়েরের দিকে। ট্রেনে বসেই প্রায় জঙ্গল
সাফারি হয়ে গেল। একমাত্র কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসই বক্সা
রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতর দিয়ে যায়। মালবাজার পেরনোর পরই ট্রেন
খুব আসতে হয়ে গেল। দু’ পাশে ঘন গভীর জঙ্গল, আর চা বাগান। জীবনে সেই প্রথম চা বাগান
দেখার যে কী আনন্দ! সকাল দশটার সময়
আলিপুরদুয়ারে নামলাম। সেখান থেকে অটোতে করে সোজা রাজা ভাত খাওয়া। গিয়ে নামলাম বহু
পুরনো এক কাঠের বাংলোর সামনে। সেটা দেখেই মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। সেইসময় গাইতে খুব
ইচ্ছে করছিল- ‘আমার স্বপ্ন যে সত্যি হলো আজ’। কিন্তু সেই
ইচ্ছেকে অনেক কষ্টে সংবরণ করলাম। ঘরটা
বিশাল বড়। বেশ ছিমছাম। মনে মনে ভাবছিলাম, এই ঘরে কোনও এক ইংরেজ সাহেব থাকতেন, কেমন ছিলেন তিনি!
এসব ভাবতে ভাবতেই স্নান করতে গেলাম। সেখানে গিয়ে কী বিপত্তি!
বাথরুমের
পেছনেই গভীর জঙ্গল। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’ গল্পের কথা
মনে পড়ে
যাচ্ছিল। দিনের বেলাতেই আমার কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগল।
কলকাতার
কোলাহলে থেকে অভ্যস্ত। এত তীব্র নির্জনতায় ভয় লাগারই কথা। যাইহোক
স্নান
সেরে আমরা একটা হোটেলে খেতে গেলাম। কারণ কেয়ারটেকারের শরীর
খারাপ থাকায় সে রান্না করতে পারেনি। সে হোটেলটাও প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। তবে
হাঁটতে মন্দ লাগছিল না। চারিদিকে বিশাল বিশাল গাছ। হাতেগোনা লোকজন। চারিদিকে সবুজে
সবুজ। ছবির মতো সাজানো সুন্দর নির্জন রেলস্টেশন। সারাদিনে মাত্র দুটি ট্রেন যায়। অরণ্যের
পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য ট্রেন আসার কোনও ঘোষণা মাইকে হয় না। টুং টুং করে
মৃদু একটা ঘণ্টা বাজে। সেই স্টেশনের গায়েই ঝুপড়ি একটা হোটেল।
আমার কর্তা অতি
বুদ্ধিজীবী হলেও একেবারেই মাটির মানুষ। নিন্দুকেরা
বলেন তিনি নাকি যেখানেই যান সেখানেই খাবার হোটেলে ধারের
খাতা করে আসেন। অর্থাৎ তার ব্যবহারে এতটাই আপ্লুত হয়ে যায় দোকানদারগুলো যে বলে,
-‘বাবু, ধার বাকি থাক।
আপনি পরেরবার এসে দেবেন।’
আমি বিশ্বাস করতাম
না। কিন্তু দেখলাম যা রটে তার কিছুটা তো সত্যি বটে।
তাই সেই হোটেলে যেতেই একমুখ হাসি নিয়ে একটি কাজলকালো মানুষ
বেরিয়ে এসে আমাদের যত্ন করে বসালো।
কর্তাকে দেখে সে একেবারে গলে গেল। লোকটির চেহারাটি বেশ। বেঁটেখাটো
নাদুসনুদুস। কালোমুখে সাদাহাসি আমি দেখতে বড় ভালোবাসি। বলা বাহুল্য, দৃশ্যটি মোটেই
নয়নাভিরাম নয়। কথায় কথায় জানতে পারলাম
লোকটির নাম বুলু। আরণ্যক সরলতায় আমাদের পঞ্চব্যাঞ্জন দিয়ে ভাত খাওয়ালো। এই রান্নার
স্বাদ যে কোনও পাঁচতারা হোটেলকেও হার মানায়। খাওয়া দাওয়ার পর শীতের হালকা রোদ্দুর
গায়ে মেখে জঙ্গলের চারপাশটা ঘুরতে লাগলাম।
চারিদিকে নাম না জানা অজস্র বড় বড় গাছ। জঙ্গলের মাঝে মাঝে
একটা দুটো
করে কাঠের বাড়ি। দেখলে মনে হবে চেনা পৃথিবী থেকে অনেক দূরের
কোনও রূপকথার জগতে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা নদী কুলুকুলু শব্দে
বয়ে চলেছে। ক্রমশঃ আমরা গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি। মনে ভয়, মুখে হাসি। এমনিতেই ভীতু বলে আমার দুর্নাম আছে। আর দিনের বেলায় ভয় পাচ্ছি
বললে তো আর রক্ষে নেই। সভয়ে গোটা জঙ্গলটা একবার তাকিয়ে নিলাম। ত্রিসীমানাতেও কোনও
হাতি দেখতে না পেয়ে একটু আশ্বস্ত হলাম। শীতের বেলা। আসতে আসতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে।
আমার ভয়ের পারদ বাড়ছে। বাংলো থেকে আমরা তখনও অনেক দূরে। কর্তার হাত অতি শক্ত করে
আমি মুঠোবন্দী করে ফেলেছি। যদিও সে আমাকে ভাষণ দিয়েই চলেছে, ‘এখানে কোনও ভয়
নেই। প্রকৃতিটাকে উপভোগ করতে শেখো। এই যে সন্ধ্যে নেমে আসছে, পাখিরা সব বাসায় ফিরছে, তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আজকের এই মনোরম সন্ধ্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম তুমি
আর আমি।’
ভয়ে আমার গলা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। আর উনি কাব্য করছেন। গা
জ্বলে
যাচ্ছিল। বক্সা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতর আমরা রয়েছি।
সন্ধ্যে হয়ে
গেছে। অনুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে খুঁজলেও সেখানে কোনও স্ট্রীট
লাইট,
কী কোনও
মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে না। ভরসা একমাত্র চাঁদের আলো।
রোমাঞ্চ তখন
আমার মাথায় উঠেছে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে। আর কী তাদের সঙ্গে
কোনওদিন দেখা হবে! হাতি বা বাঘের পেটে না গেলেও ভয়ের চোটে হার্টফেল করতে কতক্ষণ!
হাঁটতে হাঁটতে একটা গুমটি দেখতে পেলাম। সেখানে কিছু পাণ্ডব
বর্জিত চকলেট
আর বিস্কুট খেয়ে ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো।
ভয়টা কিছুটা কাটল মানুষের মুখ দেখতে পেয়ে। সেই গুমটিতে
কিছুক্ষণ বসে
আবার হাঁটতে শুরু করলাম বুলুদার দোকানের উদ্দেশ্যে। এক পা
করে হাঁটি আর
ভয়ে ভয়ে পেছন দিকে তাকাই। অবশেষে বুলুদার দোকানে এসে যেন
কাঁপুনি দিয়ে
আমার জ্বর ছাড়ল। দোকানের ভেতর ইলেক্ট্রিসিটি নেই। লণ্ঠন
জ্বেলে সে রান্না
করছে। এমনিতে রাতের বেলায় তার হোটেল বন্ধ থাকে। কিন্তু শুধু
আমরা খাব বলে
সেই রাত্রিরেও আমাদের জন্য হোটেল খোলা রেখেছে। এমন
আন্তরিকতা শহুরে
শিক্ষিত মানুষের কাছে আশা করতে নেই। বুলুদার দোকানে বসে মনে
হচ্ছিল যেন
রূপকথার জগতে চলে এসেছি। লণ্ঠনের আলোয় গরম গরম ভাত, আলু ভাজা আর দেশি মুরগীর ঝোল। আহা! মনে পড়লে এখনও জিভে জল
আসে। খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। বুলুদার কাছে জানতে পারলাম
প্রায় প্রতিদিনই হাতি বেরোয়। এটা তাদের কাছে কোনও ভয়ের ব্যাপার নয়। তাদের বাড়ি ঘর
ভেঙ্গে দিলেও তাদের মাথায় বজ্রাঘাত হয় না। কারণ এভাবেই তারা অভ্যস্ত।
খাওয়া তো হলো। এবার তো আবার
অতটা হেঁটে ওই নির্জন বাংলোতে ফিরতে হবে।
মুখে কৃত্রিম হাসি এনে বরের হাত ধরে হেঁটে চলেছি। দু’পাশে
গভীর জঙ্গল। আমার কর্তার মুখে ভয়ের টিকিও
খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে মনের সুখেগান গেয়েই
চলেছে, ‘আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ’। আমি কিন্তু আনন্দবাবুকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। সে কথা কে বোঝায়! বড় বড় গাছগুলোকে মনে হচ্ছে এক একটা
দৈত্য। নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভয় লাগে। চাঁদের আলোয় ধরণী ভিজে গেছে। আমরা একে অপরের
হাত ধরে হেঁটে চলেছি। জনঅরণ্যে থাকতে থাকতে মনে হতো একটু নির্জন প্রকৃতির মধ্যে
যেতে পারলে বেশ হয়। কিন্তু ঐরকম ভয়ংকর নির্জন পরিবেশে থেকে বুঝলাম আমি মানুষকে কত ভালোবাসি।
কোলাহল কত মধুর। বাঘ বা হাতিকে ভয় পাইনি।
ভয় পাচ্ছিলাম ওই ভয়ংকর নির্জনতাকে।
মহানগরীতে থেকে, জঙ্গলের মাঝে নির্জন ডাকবাংলোতে থাকার স্বপ্ন দেখতে
বেশ ভালই লাগে। কিন্তু বাস্তবটা অতি কঠিন; বিশেষতঃ আমার মতো ভীতুর পক্ষে।
দিনেরবেলায় যদিও কেয়ারটেকার ছিল, রাতের বেলায় সে চলে গেল।
ওর ঘর প্রায়
হাফ কিলোমিটার দূরে। সে আবার যাবার সময় আমায় আশ্বস্ত করে
গেল, ‘ডরনেকি কই বাত নেহি ম্যাডামজি। ম্যায় পাশ মে হি হুঁ।
কিসি চিজ কি জরুরত পড়ে তো মুঝে বুলা লে না।’
আমি ওর কথায় একেবারে বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা হয়ে গেলাম।
সত্যিই তো
ডরনেকি কই বাত নেহি। হাতি এসে মাঝরাতে এই কাঠের বাংলো
গুঁড়িয়ে দিল! আমার মুণ্ডু নিয়ে ভূতে গেণ্ডুয়া খেলল! তখন আমি তোমাকে ডাকব! সত্যি
সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ! জানালা দিয়ে, চাঁদের আলোয় ভেজা রাতের জঙ্গলকে দেখার
ধৃষ্টতা আমার না থাকলেও কর্তার চাপে পড়ে দেখতেই হলো। স্বামীকে খুশি
করতে যুগে যুগে স্ত্রীদের কি না করতে হয়েছে! আর এ তো শুধু জঙ্গল দেখা। একথা সেকথার পর, সাহসে ভর করে ব্যালকনিতে গিয়ে দুজনে রোমান্টিকভাবে জঙ্গল
দেখতে লাগলাম। অফ হোয়াইট জঙ্গলে জ্যোৎস্নার বাতাসা। মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। দূরে কোথাও
বনমোরগের কর্কশ চিৎকার। হঠাৎ... যা দেখলাম! বলব কেন? জাস্ট ইমাজিন!
পরেরদিন পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
সম্বিত ফিরে
পেতেই বুঝলাম যে কোনও বন্যপ্রাণীর হাতে আমাদের প্রাণ যায়নি।
আমরা দিব্যি
বেঁচে আছি। কোনও ভূত আমার মুণ্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলার
দুঃসাহস দেখায়নি।
তখন আমি কিছুটা ‘কনডিফেন্স’ পেয়ে গেলাম। মুখটুখ ধুয়ে
স্নানপর্ব সেরে
বেরিয়ে গেলাম। বুলুদার দোকানের পাশেই বুলুদার দাদার দোকান।
সেখানে সকালবেলায় বেশ গরম গরম ফুলকো লুচি, আলুর তরকারী সহযোগে বিটনুন আর আচার দিয়ে বেশ জমকালো একটা ব্রেকফাস্ট হলো। কিন্তু এখানে
কোথাও চা পাওয়া যায় না। এরা নাকি চা খায়ই
না। যেখানে এত চা উৎপন্ন হয় সেখানকার লোক চা খায় না! একেই বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায়
না।
এবার কোথায় যাওয়া যায়! এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে এক ছোকরা
এগিয়ে এলো। বয়স কত হবে, এই ধরুন উনিশ কুড়ি। কী আন্তরিক ব্যবহার। সরলতায় মাখানো মুখখানি।
বলল, ‘চলুন জয়ন্তী
থেকে ঘুরিয়ে আনি।’
আমরাও এক কথায় রাজি। চেপে বসলাম তার অটোয়। নাম তার বাবু।
অটো চালাতে চালাতে সে আমাদের সঙ্গে খোশগল্প
জুড়ে দিল। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে বাবুর অটো ছুটে চলেছে। মাঝরাস্তায়
একজায়গায় ও অটোটাকে দাঁড় করালো। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি একটা শিব মন্দির। মন্দিরের পাশ দিয়ে ফরেস্টের কোর এরিয়া শুরু হয়েছে। এখানে ফরেস্টের
পারমিশন ছাড়া সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারে না।। সেই মন্দিরের কাছে যেতেই চোখে পড়ল রোগা
ছিপছিপে এক সাধুবাবা। মাথার জটা পা পর্যন্ত এসে পড়েছে। তাঁকে গিয়ে প্রণাম করলাম। বাবুর কথায় জানতে পারলাম যে তিনি বারোমাস এই
মন্দিরেই থাকেন। কোনওদিন ভাত খান না। বনের
ফল খেয়েই থাকেন। সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলে জানলাম যে হাতির দল প্রায় দিনই তাঁর কাছে
আসে।
ওরা নিজেরাই দরজা খুলে শিবের পুজো করে চলে যায়। সাধুবাবার
কোনও ক্ষতি করে না। অন্য এক সাধু তাঁর সঙ্গে থাকতে এসেছিল। কিন্তু হাতিগুলোর তাঁকে
পছন্দ হয়নি। তাই সেই সাধুর ওপর হাতিগুলো
অত্যাচার করতে গেলে ইনি গিয়ে তার প্রাণ বাঁচান। তাঁকে ছাড়া আর অন্য কাউকে হাতিগুলো
সহ্য করতে পারে না।
আমরা বাক্যহারা হয়ে গেছি তাঁর কথা শুনে। চোখের সামনে যা
দেখছি তাকে
বিশ্বাস না করে তো উপায় নেই! কথায় বলে না ট্রুথ ইজ
স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন!
সেখান থেকে প্রায় একঘণ্টা পর জয়ন্তী পৌঁছোলাম। জয়ন্তীকে
নাকি ডুয়ার্সের
রাণী বলা হয়। কেন বলে জানি না। কারণ আমি রাণীর যোগ্য কোনও
সৌন্দর্য খুঁজে
পাইনি। নদীর এপ্রান্ত থকে ওপ্রান্ত হাঁটলাম একটু জলের
খোঁজে। কিন্তু জল
এই নদীতে কাল্পনিক চরিত্র বলেই মনে হলো। আমরা গেলাম
একটি ভাঙ্গা ব্রিজের
কাছে। সেখানে একটুকরো রেললাইনের দেখা পেলাম। জানতে পারলাম
এটা নাকি খুব ঐতিহাসিক জায়গা। এখান দিয়ে আগে ট্রেন চলত। কিন্তু জলের স্রোতে সেসব
নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই জায়গাতেই নাকি ‘আবার অরণ্যে’ শুটিং হয়েছিল।
এখানেই টাব্বুকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী মানুষকে
বিয়ে করার এটাই
হচ্ছে সুফল। জীবনে অনেক কিছু শেখা যায়। জানা যায়।
দুপুর বেলায় জয়ন্তীতেই মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নিলাম। বাবুও
আমাদের সঙ্গে
খেল। যদিও কিছুতেই সে খেতে রাজী নয় আমাদের টাকায়। খুব লজ্জা
পাচ্ছিল। আমি এক ধমক দিলাম, ‘তুই না আমার ভাইয়ের মতো! আয়, খেয়ে নে। অত লজ্জা পাবার কী আছে!’
ও খুব খুশি হলো। কারণ কলকাতার
লোক এর আগে ওর সঙ্গে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ
আচরণ করেছে কি না সন্দেহ। খাবার পর আবার এদিক সেদিক ঘুরে
আমরা গেলাম বক্সা। তখন বিকেলের আলো প্রায় নিভতে বসেছে। পাহাড় এবং জঙ্গলে কিছু বুঝে
ওঠার আগেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছলাম তার নাম সান্তালাবাড়ি।
গ্রাম্যহাট তখন ভাংতে শুরু করেছে। বক্সা পাহাড়ে ওঠার
রাস্তা শুরু হয়েছে ওখান থেকেই। ওই পাহাড়ের ওপর একটা জেলখানা
আছে। সেখানেই নেতাজীকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। পাহাড়ে ওঠার কোনও গাড়ি নেই। পায়ে
হেঁটেই উঠতে হয় সকলকে। পাহাড়ের ওপর একটা গ্রাম আছে। লেপচা খাঁ। সেখানে বেশ কিছু হোম
স্টেও রয়েছে। তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেললাম যে পরেরবার এসে ওই লেপচা খাঁতেই থাকব।
গল্প করতে করতে পায়ে পায়ে অনেকটাই উঠে গিয়েছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যে
নামতেই ফেরার পথ ধরি। সেখানেও আমার পতিদেবের ঐতিহাসিক মন্তব্য, ‘আরে কোনও ভয়
নেই। তুমি যা মোটা, হাতি তোমার
কিস্যু করতে পারবে না। উলটে তারাই তোমাকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে। আরেকটু ওঠাই
যায়।’
কীরকম অসভ্য ভাবুন! আমি মরছি আমার জ্বালায়। ভয়ের চোটে আমার
মুখখানা
শুকিয়ে একেবারে আমসী হয়ে গেছে। তখন কী এসব
সস্তা আদিখ্যেতা ভালো লাগে!
ফিরে এসে একটা দোকানে বসলাম। খড়ের চাল দেওয়া মাটির দেওয়াল।
সেখানেই এক নেপালী মহিলা দোকান করেন। তিনি আমাদের জন্য গরম গরম মোমো বানিয়ে দিলেন।
যতক্ষণ মোমো বানানো হচ্ছিল ততক্ষণে সেই দোকানের পোষা এক রামছাগল আমাদের সঙ্গে
বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়েছে। শুধুই কোলের কাছে ঘুর ঘুর করছে। ছোট নয় যে কোলে নেব। বেশ
হৃষ্টপুষ্ট দানব গোছের নধরকান্তি চেহারা। লটপটে কান। কচি পটলের মতো সিং। মুখে আবার
দাড়ি রাখা হয়েছে। ট্রিম করে কি না কে জানে! আমার ব্যাগে কোনও বিস্কুটও নেই যে দেব।
চোখে পড়ল দোকানেই তো ছোট ছোট বিস্কুটের প্যাকেট
রয়েছে। দু’ প্যাকেট বিস্কুট কিনে খাইয়ে আমি ছাগলের প্রতি আমার বাৎসল্য রসের পরিচয় দিলাম।
ছাগল বলে কি ও মানুষ নয়? বিস্কুট খেয়ে ছাগলটা বিশাল বড় একটা হাই তুলল। ছাগলও তাহলে
হাই তোলে! আমি ভাবলাম যাক! ওর ঘুম পেয়েছে। ও আর আমাদের জ্বালাবে না। কিন্তু সেগুড়ে
বালি। তার মোমো খাওয়া চাই। তাড়ালেও কিছুতেই যাচ্ছে না। এমন তেঁদর ছাগল যে টেবিলে
উঠে যাচ্ছে। ওদিকে সেই নেপালী মহিলা দাঁত কেলিয়ে হাসছে। অবশেষে আমাদের তিনজনের কাছ থেকে মোট ছটা মোমো খেয়ে সে
রণে ভঙ্গ দিল।
এবার ফেরার পালা। এখানেও গোটা রাস্তাতে কোথাও ইলেকট্রিসিটি
নেই। রাত যত
বাড়ছে ঠাণ্ডাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। অটোর তো তিন দিক
ফাঁকা। বাবু বেশ
জোরেই অটো চালাচ্ছে। কিন্তু আমি তখন প্রাণটা হাতের মুঠোয়
নিয়ে বসে আছি।
ভাবছি হঠাৎ যদি মাঝরাস্তায় অটোটা খারাপ হয়ে যায়! বাঁচাতে তো
কেউ আসবেই
না। ফোনেও নেটওয়ার্ক নেই। জনমানবশূন্য অন্ধকার রাস্তা ধরে আমরা
এগিয়ে
চলেছি। ভয়ের চোটে অটোর দুপাশে রাখা তিরপল ফেলে দিয়েছি।
বাবুর গাড়ির আলোতে হঠাৎ করে রাস্তার ওপর কার যেন দুটো চোখ জ্বলতে দেখা গেল। বাবু গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়।
আমি তো ‘মা গো বাবা গো’ করে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি। ওদিক থেকে বাবু খুব হাসছে। বলছে, ‘দিদি অত ভয়
পাওয়ার কিছু নেই। ওগুলো লেপার্ড। মাঝে মাঝে বেরোয়। আমরা প্রায় দিনই দেখি।’
বুলুদার হোটেলের কাছেই বাবু আমাদের নামিয়ে দেয়। বুলুদা
আমাদের দেখেই বলে,
-‘এত দেরী করলে! আরে হাতি বেরিয়েছে তো। তাড়াতাড়ি খেয়ে বাংলোয়
ফিরে যাও। চাইলে হাতিটাকে দেখেও আসতে পারো।’
একেই বলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
এক চিতায় রক্ষে নেই আবার হাতি দোসর। ভয় লাগলেও রাত্রি বেলায় আদিম অরণ্যে হাতি
দেখার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
সার্কাসে আর ডিসকভারিতে শান্ত শিষ্ট হাতি দেখতেই আমরা
অভ্যস্ত। কিন্তু
এমন জংলী পরিবেশে হস্তীদর্শন সত্যিই দুর্লভ। ভয় এবং রোমাঞ্চ
মিশিয়ে সেই
জায়গায় যেতেই দেখা গেল, বিশাল সাইজের হাতিটিকে। জঙ্গল থেকে একাই বেরিয়ে এসেছে। মনের সুখে গাছপালা
ভাঙ্গছে। যত না খাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি
নষ্ট
করছে। ওখানে এক দোকানদারের ঘর ছিল। পাশেই একটা ডোবা। তার
ঘরের কাছে যাতে হাতিটা না আসে সেজন্য সে টায়ার জ্বালিয়ে দিল। কারণ আগুন এবং খালকে
হাতি ভয় পায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অন্য চিত্র। আগুনের পাশ দিয়ে ডোবার ভেতর দিয়ে
ছপাং ছপাং করতে করতে হাতি অন্য দিকে চলে গেল। বুলুদার হোটেলে নাকে মুখে দুটো গুঁজে
বাংলোয় ফিরে গেলাম।
পরেরদিন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট জয়ন্তীতে আমাদের জঙ্গল সাফারি
করার ছাড়পত্র
দেয়। ভোর চারটের সময় বাবু এসে হাজির। জঙ্গলের কোর এরিয়ায়
ঢুকব। কী আছে সেখানে, কেমন হয়
আরণ্যক জীবন এসব ভেবে রাতে আর ঘুম হয়নি। পাঁচটার মধ্যে আমরা জয়ন্তীতে হাজির।
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারিদিক খোলা একটা জিপসি গাড়ি এলো। উত্তেজনার
পারদ ক্রমশঃ চড়ছে। বাবুকেও আমাদের সঙ্গে নিলাম। সামনের সিটে ড্রাইভার ও গাইড। আস্তে
আস্তে আমরা কোর এরিয়ায় প্রবেশ করছি। গাড়ি চলছে একেবারে সাউণ্ডলেস। আমরা যতই এগোতে
থাকি জঙ্গলের গভীরতাও তত বাড়তে থাকে। চারিদিকে নিঃঝুম প্রকৃতি। এমন পরিবেশে কথা
বলতেও যেন ইচ্ছে করে না। মনে হয় প্রকৃতির যেন ধ্যানভঙ্গ হয়ে যাবে। জঙ্গলের ভেতরটা
এতটাই ঠাণ্ডা যে সোয়েটার চাদর ভেদ করেও শীতের হুল ফুটছে শরীরে। অন্ধকার ক্রমশঃ
ফিকে হতে শুরু করে। পূব আকাশে লালের ছিটে।
গাড়ির পেছনে আমরা সকলেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন গভীর জঙ্গলের
সৌন্দর্য
যাতে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারি। শুধুমাত্র পশুপ্রাণী
দেখতেই অধিকাংশ লোক
জঙ্গল সাফারি করে। কিন্তু তার বাইরেও এই গভীর অরণ্যের যে
আলাদা একটা
সৌন্দর্য আছে সেটা কারও চোখেই পড়ে না। কিছুদূরে একটা
বার্কিং ডিয়ার ঘাস
খাচ্ছিল। আমাদেরকে দেখেই সে ভয়ে পালিয়ে গেল। আগের দিন
বিকেলে যে জয়ন্তীকে দেখে ভালো লাগেনি, এখন এই জঙ্গলের রূপ দেখে মনে হলো সত্যিই সে রাণী। পথ চলতে চলতে কিছু ময়ূরের
নিভৃত ঘোরাফেরা নজরে এলো। কিছু বুনো খরগোশ এপাং ওপাং ঝপাং করতে করতে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভোরের আকাশে আবির ছড়াতে ছড়াতেই একসময় সূর্যোদয় হলো। একটা জায়গায়
আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। আপনারা অনেকেই
টাইগার হিলে সানরাইজ দেখতে যান। কিন্তু গভীর জঙ্গলের বুকে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখার
সে যে কী সৌন্দর্য তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ভোরের সেই নরম আলোয় ভেজা অরণ্যকে
দেখে মনেই হলো না আমরা কোনও ডেঞ্জার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।
এবার একটা জলাশয়ের কাছে আসতেই হস্তীদর্শন হলো। জলাশয়ের
চারপাশে ফরেস্ট থেকে প্রচুর নুন দেওয়া হয়।
এই নুন নাকি হাতিদের খুব প্রিয়। এটা না খেলে তাদের হজম হয় না। অত ভোরবেলায়
বাচ্ছাকাচ্ছা নিয়ে হাতিগুলো নুন খেতে
এসেছিল। জঙ্গলের মধ্যেই বেশ কয়েকটা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে।
সবগুলোতে না উঠলেও একটাতেই উঠেছিলাম। অত ওপর থেকে এই আদিম অরণ্যকে দেখার সেই আনন্দ
ভোলার নয়। যে অরণ্য মানুষকে এতখানি আনন্দ দেয় তাকেই মানুষ কেটে কেটে শ্মশান বানিয়ে
ফেলেছে।
জঙ্গল সাফারি শেষ করে যখন ফিরে এলাম তখন জয়ন্তী জেগে উঠেছে।
সেখানেই হালকা টিফিন করে আমরা ফিরে এলাম। এরপর একদিন আড়াই ঘণ্টায় বিদেশ ভ্রমণ, মানে ভূটান গিয়েছিলাম ঝটিকা সফরে। ফেরার পথে চা বাগানে
আমাদের রোমান্স - এসব নিয়ে আবার পরে কখনও লেখা যাবে। একসঙ্গে এত লিখলে আপনাদের চাপ
হয়ে যাবে।
তার পরের দিন ফেরার পালা। বিকেলে আমাদের ট্রেন। মন দুজনেরই
খারাপ। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একটা
ডাকঘর নজরে পড়ল। এখানে এখনও ‘ডাকহরকরা’ মানে ‘রানার’ আছে। সে এখনও পিঠে চিঠির বোঝা নিয়ে ছুটে যায় এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।
ছুটে যায় সেই দুর্গম বক্সা পাহাড়ে-
‘হাতে লণ্ঠন
করে ঠনঠন
জোনাকিরা দেয়
আলো’।
সব শুনে মনটা কেমন নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গেল। ভাবলাম
বহুদিন কাউকে
চিঠি লিখিনি। এখানে এখন লিখলে কেমন হয়! যেমন কথা তেমন কাজ।
আমরা ভেতরে যেতেই গুটিকয়েক লোকজন এমন বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন আমরা
মঙ্গল গ্রহের প্রাণী। পোস্টকার্ড চাওয়াতে তো আরও অবাক। এই হোয়াটসঅ্যাপের যুগেও যে
কেউ কাউকে চিঠি লিখতে পারে এটা তাদের ভাবনারও অতীত। সেখানেই গোটা চার পোস্টকার্ড
কিনে একটা জিওল গাছের নিচে বসে চিঠি লিখতে শুরু করলাম। একটা দাদুকে, একটা আমার ছোট্ট ভাই কুট্টুসকে আর একটা আমার এক স্যারকে।
চিঠিগুলো আদৌ হয়তো কোনওদিন
পৌঁছবে না সেই ঠিকানায়। তবুও...
আবার ফিরে এলাম জনারণ্যে মনখারাপের সুর নিয়ে। দিন যায় দিন
যায়। কেটে
গেছে তারপর থেকে প্রায় ছ’ মাস। হঠাৎ একদিন দাদুর ফোনে সেই
চিঠির প্রাপ্তি
সংবাদ পেলাম। তিনি আমার চিঠি পেয়ে যে কী খুশি হয়েছেন তা বলে
বোঝানোর নয়। সকলকে ডেকে ডেকে সেই চিঠিখানা পড়িয়েছেন। মাত্র পঁচিশ
পয়সার বিনিময়ে একজন অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষকে যে এতখানি আনন্দ দেওয়া যায় সেটা এই
প্রজন্ম বুঝল না। বাকিরা পায়নি। ভারতীয় ডাকব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ছিলাম।
কিন্তু একেবারেই বিশ্বাসটা হারাই কী করে বলুন তো? সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মানুষের ওপর...’ উঁহু। ডাকঘরের ওপর বিশ্বাস
হারানোও তো পাপ। কী বলেন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন