আধুনিকতার রোলার কোষ্টারে প্রাচীন বাঙালিয়ানা
(পর্বঃ চার)
সম্পর্কের ব্যাকরণ
দিন বদলের পালায় বদলে গেছে বাঙালীর
চিরায়ত সম্পর্কগুলোর ধরণ ধারণ। ‘মা’ শব্দটির মধুর
ফুরফুরে আমেজের ঘাড়ে যেমন যুক্ত হয়েছে ‘মাম্মি’ নামের গুরুতর ববছাট
ফ্যাশনের বোঝা, তেমনি ভেতো বাঙালও হয়ে
উঠেছে হাঁক ছেড়ে ডাকাডাকির কাঙাল। মানে, বহু সম্পর্কই এখন গভীর আন্তরিকতার ছোঁয়ার চেয়ে, হাই ড্যুড, হ্যালো ব্রো-এর মতোন ঝকমকে
রূপে পানির উপর ভাসমান তেলের মতোন চকচকে
কিন্তু হালকা হয়ে পাড়ি দিচ্ছে সময়ের খেয়া।
হালের ‘ব্রো’রা কিন্তু আবার হিব্রু নয়, বাংলা নয়, বরং ব্যাংলিশ
সম্পর্কের প্রতিই বেশি অনুরক্ত। পুরাতন
মানসিকতার বাঙালী যেমন “চুল তার
কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা” আউড়িয়ে
দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ঘরের চৌহদ্দিতেই বনলতা সেনকে খুঁজতেন, আর “আমারে দু’দন্ড শান্তি দিয়েছিল” জপতে জপতে দিবানিদ্রার শীতল পাটির সাথে কোলবালিশটিকেই আঁকড়ে ধরতেন, হাল ফ্যাশনের বাঙালী কিন্তু সেই গুরুতর ভুল করেন না মোটেই।
তাই তারা পাটি নয়, বনলতার বোন
শান্তিকে খোঁজেন পার্টিতে। তবে বাংলায় নতুন কথা এক চালু হয়েছে , “শান্তির মা মারা গেছেন”, তাই বনলতা বা শান্তি দু’বোনের কেউই পার্টিতে হাজির হতে পারেন না। অগত্যা সেই ক্ষতি
পুষিয়ে নিতে, রঙীন পানীয় হাতে কোনো ‘কিটি’কেই
‘লাবণ্য’ বলে চালিয়ে নিতে হয় হালের অমিতাচার বাঙালীর ‘অমিত’ মনের।
‘ইয়ে নেহি তো উও হি সহি হ্যায়’ গাইতে গাইতে আজকের যুগের দেবদাসেরা পারু-চন্দ্রমুখী দুইজনকেই ফেলে ‘তিসরি মঞ্জিল’ খুঁজে নিতে কোনো ব্রেকআপেরই হপ্তাখানেকের বেশি দেরী করেন
না। পুত্রধনেরা নিজের মায়ের চেয়ে শাশুড়ি আকাশে অধিক স্নেহবৃষ্টির আভাস পান বিয়ের প্রায়
ঘন্টাখানেকের মধ্যেকার হালচাল আবহাওয়া বার্তাতেই। নিজ পরিবারের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার
অদেখা-অচেনা বা ডেটিং-মিটিংএর চেনা বন্ধু-বান্ধবকেই বেশি আপন মনে হয় আধুনিক বাঙালীর কাছে। এর ফলশ্রুতিতে পরিবারগুলোর
বন্ধনের খুঁটি নড়বড়ে হয়ে গিয়ে তাসের ঘরের মতোন ঝুরঝুর ভেঙ্গে পড়ে সামান্য ঝড়েই।
ভোগবাদিতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে
বাড়ছে প্রতিটি বাঙালীর সম্পর্কগুলোর শোম্যান শিপের প্রতিযোগিতা, কমছে সম্পর্কের চৈত্রদিনে ‘বটের ছায়ে কূপের জল’এর মতোন স্নিগ্ধ-প্রগাঢ় মমতার প্রলেপ। তার সাথে
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হতাশা-ক্ষোভ-একাকীত্ব এরকম নানা যন্ত্রণা। তবুও নিজেকে আর
সমাজকে প্রবঞ্চনা করতে তাকে নিত্যই হাসিমুখে হাজিরা দিতে হচ্ছে দিনযাপনের
কাঠগড়ায়।
আধুনিক এ সমাজ আপনাকে দেখতে চায়
চিরসুখী। অন্যান্য ইমোশনগুলো কাউকে শো করা, সে এক কঠিন দুর্বলতা। যেন সুখ-আনন্দ-উৎফুল্লতা ছাড়া মানুষের অন্য কোনো ইমোশন থাকতে নেই। পরীক্ষামূলকভাবে একবার কোনো
সামাজিক জমায়েতে একটু বিষাদ বা ক্রোধ দেখিয়েই দেখুন, হাতেনাতে ফল পাবেন এর মর্মবাণীর। ভেবে দেখুন, হয়তো ক্ষণিক আগেই হঠাৎ মনোমালিন্যে স্বামী-স্ত্রীতে মিলে বাপান্ত-শাপান্ত করে
পূর্ব নির্ধারিত কোনো দাওয়াতে গেছেন। সেখানেও কিন্তু ভাব দেখাতে হবে আপনাকে “চিরসুখী জন, ভ্রমে কি কখন, বুঝিতে নারে
ব্যথিত বেদন”। অর্থাৎ
এমনই “অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বাস করিতে লাগিল” গোছের জুটি বেঁধেছেন আপনারা বিয়ের গাঁটছড়া বেঁধেই যে, আপনাদের দ্বৈত জীবনের চলার বাঁকে বাঁকে সোনার ডালে
হীরামন-টিয়ে গাইছে, রূপোর গাছে
হীরের ফুল ফুটে বিছিয়ে আছে আপনাদের পায়ের কাছে। এমনটাই কামনা করে আপনার কাছে এ
সমাজ,
যদি আপনি আধুনিক হন।
আগে গ্রাম-বাংলায় ঘরে ঘরে নকশী
সেলাইয়ের ফোড়ে রং-বেরঙের ফুল তুলে ফ্রেমে বেঁধে দেয়ালে লেখা থাকতো...
“ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন,
যদিও পৃথক হয়,
তা নারীর কারণ”।
অধুনা আর সেই চল নেই। বরং
সম্পর্কিত ধনরতন হিসেবে লাইফ পার্টনার, শ্বশুরকুল, বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড, কলিগ, বাস্তব ও
ভার্চুয়াল বুন্ধু -- এইরকম মাল্টিপল চয়েসের মধ্যে কোনটাতে টিকচিহ্ন দেবে -- a,b,c,d,e নাকি সবক’টাই? এই চিন্তায়
উদভ্রান্ত আধুনিক বাঙালী। তাই যতই সে হোক
স্নেহ-ভালোবাসার কাঙাল, পায় না
সম্পর্কের স্থিতির নাগাল।
তবুও পৃথিবী ঘূর্ণায়মান, তাই মূলতঃ এখন যেভাবে টিকে আছে সম্পর্কগুলো, বিশেষতঃ নর-নারীর সম্পর্ক, তা হলো, ‘পুরুষ হচ্ছে টাকার মতোন, যখন যার হাতে থাকে তখন তার’। বর্তমানে
সমাজব্যবস্থা কিছুটা উদার আর নারী বেশ খানিকটা স্বাবলম্বী হওয়ায় নারী/পুরুষ উভয়ের
ক্ষেত্রেই কমবেশি খাটে এই কথা। এজন্যই এসব প্রবাদ-প্রবচনের আবেদন চিরকালীন।
আরো কৌতুকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, আধুনিক কালে সম্পর্ক রক্ষার চেয়ে, তার খুঁতগুলো কীভাবে মেরামত করা যায়, সেই আকাশ-পাতাল চিন্তাতেই বেশি সময় ব্যয় করতে পছন্দ করে মানুষ। হয়তো যে সময়টুকু ঘরণী বা
প্রেয়সীর সাথে এক কাপ ধূমায়িত চায়ে চুমুক দিয়ে চোখে চোখ রাখলেই সমস্যার সমাধান হতে
পারতো,
সেই সময়টা সেখানে ইনভেষ্ট বা ক্ষেপণ না করে, আধুনিক নারী-পুরুষ সেই সময় ব্যয় করে সম্পর্কটা ‘ক্লিক’ করছে না বলে বন্ধুজনের কাছে হা-হুতাশ করে। শুনতে অতিরঞ্জিত
মনে হলেও,
আসলে বাস্তবিক চিত্রটা এমনই। যেন রোগ হলে ওষুধ-পথ্য না খেয়ে, শুধুই কপাল চাপড়ে বিলাপের মতোন অরণ্যে রোদন।
আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের
যাঁতাকলে সব কিছুই বড্ড গৎবাঁধা। আধুনিক সম্পর্কগুলোও তাই। মাপা হাসি, মেপে কথা, মাপজোক করে
একে অপরের প্রতি যত্নবান হওয়া -- যেন দাঁড়িপাল্লার মাপে চলছে এই কানার হাট-বাজারে
সম্পর্কের বেচাকেনা। ফলতঃ দ্রুতই হাঁপিয়ে উঠছে মানুষ। দূরে কোথাও পালাতে চাইছে তার
মন তার নিজেরই জীবন থেকে। কিন্তু সে জানে না, এই পলায়নপর মনোবৃত্তি নিয়ে পাহাড়-সমুদ্র-অরণ্য-রিসোর্ট বা রিমোট কোনো জায়গা
যেখানেই সে যাক না কেন, নিজের জীবনের ইতিবৃত্ত তার বয়ে নিয়ে যেতে হবে
সেখানেই। যদি না সে নিজের চিন্তা-চেতনা-মানসিকতা-দৃষ্টিভঙ্গীতে স্থিরতা আনতে না
পারে,
(ইংরেজীতে যাকে বলে ইনার পিস) তবে কোনো
পর্বত-অরণ্যানীই তাকে শান্তির আশ্বাস দিতে পারবে না; দিতে পারবে না মনের ক্ষতের উপর সাময়িক সান্ত্বনার প্রলেপ।
এজন্যই বলা হয়, তোমার
দৈনন্দিন জীবনকেই তুমি এমনভাবে গড়ে তোলো, যাতে তোমাকে কোনো অবকাশ কেন্দ্রে যাবার জন্য হাঁপিয়ে উঠতে না হয়। এটাই সঠিকভাবে সফল জীবন যাপনের মূলমন্ত্র।
আর এ কথাও সত্য, মানুষের পাশে মানুষের বদলে এখন বড় একটা স্থান করে নিয়েছে
যন্ত্র। তা সে বই-খাতা, টেলিভিশন, পিসি, ফোন যে রূপেই
হোক না কেন। দিনের
বেশির ভাগ সময়ই যন্ত্রের সাথে সময় কাটায় আধুনিক মানুষ। রবি ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, “প্রতিটি মানুষ হচ্ছে একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোন”। আধুনিকতার বলি
প্রতিটি মানুষকে যদি আমরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসাবে ধরি, তবে তার যন্ত্রাদি হচ্ছে পারিপার্শ্বস্থ মানুষ আর তার
মধ্যেকার অথৈ অকুল সমুদ্রজল। যা পাড়ি দিতে গেলেই পার হতে হয় বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা, কখনো-সখনো উত্তাল ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ প্রলয়। তারচেয়ে “এই বেশ ভালো আছি” মনে করে মানুষের চেয়ে যন্ত্রকেই বেশি নিরাপদ মনে করে আধুনিক
মানুষ। আধুনিক বাঙালীও এর ব্যতিক্রম নয়।
তবে এক হিসেবে ধরতে গেলে, এটাও এক ধরনের আত্মস্থিতিই। কারণ, যে কোনো যন্ত্রের প্রতি মনোনিবেশ করতে গেলে, আপনাকে সর্বপ্রথম সেই যান্ত্রিক কার্যাবলীর প্রতিসরণ ঘটাতে হয় নিজের চিন্তার
কেন্দ্রবিন্দুতেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন আপনি প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূরবর্তী কোনো
বন্ধুর সাথে কথা বললেন। আলাপ শেষে সে তো
শারীরিকভাবে নেই আপনার দৃষ্টিসীমায়। তখন আপনার মধ্যে এরকম বোধের জন্ম নেওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, আপনি যেন নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলছিলেন এতক্ষণ। আর এর ফল হয়
বিরূপ। আরো বেশি করে একলা লাগার অনুভূতি
কাজ করতে পারে এতে তার মধ্যে।
তবে কিনা “একাই এসেছি ভবে, একাই যেতে হবে”, একথা যেমন
চিরসত্য, ঠিক তেমনি একথাও সত্য যে, জন্ম মূলতঃ মানুষ একলা নেয় না। প্রসূতি মা, সেবাময়ী ধাত্রী, উৎকন্ঠিত পিতা, আনন্দিত পরিজন -- এরকম বহুবিধ মানুষের সম্মিলিত আবেগের
মধ্যে দিয়েই একটি শিশুর আগমন ঘটে পৃথিবীতে। তাই জীবন পথে চলার ক্ষেত্রেও সে আসলে
একা নয়,
চারপাশের প্রতিটি মানুষ সম্পর্কিত একে অপরের সাথে। এমনকি
রাস্তার অচেনা পথচারীও আপনার দৃষ্টিগোচরভুক্ত হলে, সেও সেই মুহূর্তে আপনার জীবনেরই অংশ।
তাই, সবিশেষ যত্নবান হতে শিখতে হয় সম্পর্কগুলোর প্রতি। দিনশেষে স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধনই এনে
দিতে পারে চিত্তের প্রশান্তি, একাকীত্ব নয়।
আধুনিক যান্ত্রিক মানুষ তথা বাঙালীর মননেরও বুঝতে হবে এই সারসত্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন