সোমবার, ২ অক্টোবর, ২০১৭

রঞ্জনা ব্যানার্জী

দুই ভুবন


ওদের স্কুলের ইসলামিয়াতের শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ্‌ সেদিন বলেছিলেন, ‘আপা আপনারা এত্তো সময় নষ্ট করেন রিকশাওয়ালার সাথে! ‘এই খালি যাবি’ - বলেই উঠে পড়বেন। তারপরে ইন্‌সাফ করে ভাড়া দিয়ে দেবেন। কেইস খতম বাঙলা সিনেমার ডায়ালগ মারেন বলেই আপনাদের পায়’মনোয়ারা আপা বলেছিলেন, ‘আপনি হুজুর মানুষ বাঙলা সিনেমার ডায়ালগ জানেন ক্যামনে?’ – ‘আরে কী কন,  হিন্দি সিরিয়ালের  ডায়ালগ ভি জানি। হুজুরাইনে তো সকাল সন্ধ্যা হিন্দি সিরিয়ালেই থাকে’

আজ মাসুম বিল্লাহ্‌র কথা মেনে রিকশাওয়ালার ‘কই যাইবেন’ এর উত্তর না দিয়েই ও উঠে পড়েছিল রিকশায়। বাস থেকে নেমে প্রায় বিশ মিনিট দাঁড়িয়েছিল রাস্তায়। খালি রিকশা তো দূর, কোনো রিকশাই চোখে পড়ছিল নাখাতার বান্ডিলটার ভার বেশ। বাঁ হাতটা এখনো টনটন করছে।    
রিকশাওয়ালা প্যাডেল পা দিয়েই বলেছিল, ‘বেশি দূরে হইলে কিন্তু যাইতাম না। চাইরটায় রিকশা ফিরত দেওন লাগবো’
কী আর দূর! মিনিট বিশেক। আর যদি জোরে টানে তবে পনের মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। খাড়া রাস্তাটাতেই যা একটু সময় লাগে।

স্কুলে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা চলছে। ছাত্রীদের উশখুশ দেখে মায়াই হচ্ছিলো। তাল পাকা গরম আজ। মাথার উপর বেকার ফ্যান ঘুরছে, হাওয়া নেই। ক্লাস নাইন আর টেনের ইংরেজি পরীক্ষা ছিল। ওর বিষয়। দুই ক্লাস মিলে প্রায় দু’শ চল্লিশটা খাতা। আজ রাত থেকেই খাতা কাটায় হাত লাগাতে হবে। দশ দিনের মধ্যে রিপোর্ট কার্ড। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম কড়া কিসিমের। ইদানিং সব কিছুতেই খিটখিট। জীববিজ্ঞানের সীমাদি বলেন, ‘মেনোপজের লক্ষণ!’
  
পরীক্ষা শেষ হওয়ার খানিক আগে হঠাৎ পিয়ন নোটিস নিয়ে ঢুকেছিল হলে। মিটিং। মনোয়ারা আপাও ছিলেন ডিউটিতে। আপার মেয়ের স্কুল ছুটি হবে বারোটায়। পরীক্ষা শেষে মেয়েকে নিয়ে ফেরার কথা তাঁর। ভ্রূ কুঁচকে পিয়নকে বলেছিলেন, ‘দাওয়াতপত্র আনার আর টাইম পাইলেন না?’
ভাগ্যিস অর্পাকে আনা-নেওয়ার জন্যে টিপুর মা’ আছে!  
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের রুমে ঢুকেই জানা গেল শিক্ষামন্ত্রী আসবেন শহরে। ম্যাডামের স্বামী শহরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, তিনিই মন্ত্রীর সফর তালিকায় এই স্কুলের নাম ঢুকিয়েছেন। আগামী মাসের কুড়ি তারিখ মন্ত্রীর সফর। মন্ত্রী মহোদয়ের সংবর্ধনার তোড়জোর নিয়েই আজকের মিটিং। মনোয়ারা আপা দাঁত চেপে বলেছিলেন, ‘ফাইজলামির আর জায়গা পায় না। একমাস আগে মিটিং ডাকে। আজাইরা!’   

মিটিংটা ছোট গল্পের মতোই ‘শেষ হইয়াও শেষ হয় না’ প্রায় দু’ ঘন্টা আলোচনার  পরে প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শেষে প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম বিরিয়ানির ব্যবস্থা করেছেন। ও উঠে পড়ে,  বিরিয়ানির জন্যে বসলে আরো এক ঘন্টা দেরি।

স্কুলের সামনে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাস পেয়ে গিয়েছিল। কন্ডাক্টরটাও বেশ আদবের সাথে খাতার বান্ডিলটা ওঠাতে সাহায্য করলো। অর্পাকে একটা ফোন দেবার ভাবনাটা আবছা মনে দোল খেলেও ব্যাগ থেকে ফোন বের করেনি ও। আজকাল ফোন চোরেরা সবখানে ওঁত পেতে আছে। মিটিংএর মাঝখানে অবশ্য অর্পার মেসেজ পেয়েছিল ‘এসেছি’;  ও-ও ‘বুড়ো আঙুল’ ইমো পাঠিয়েছিল। অর্পা  জানে মা ব্যস্ত থাকলেই ইমো পাঠায়। মিরাজকে দেরির কথা জানানো দরকার ছিল। যাগ্‌গে জরুরি কিছু হলে মিরাজই ফোন দেবে!

রিকশাওয়ালা টানছে প্রাণপণে। ওর কি নেমে যাওয়া উচিত? রাস্তা ফাঁকা, এই উঁচু টানটা পেরুলেই মিনিট দশেক। হাতের কবজি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে। চারটে বেজে পাঁচ।  রিকশাওয়ালার রিকশা দেবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সমতলে উঠতেই রিকশাওয়ালা থামে। বেচারা হাঁপাচ্ছে রীতিমতোমাথা থেকে গামছা খোলে। মুখ ঘাড় মোছে।  আহারে! মনে মনে ঠিক করে ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে দশ টাকা বেশিই দেবে। মাসুম বিল্লাহ্‌র কথা মতো ইন্‌সাফ করতে হবে। রিকশাওয়ালাকে আলগোছে এবার  ঠিকানাটা বলে, ‘ মিঞা খাঁন লেইন। ট্র্যাফিক সিগ্ন্যালের মোড়ের ডান দিকের গলির দুই নম্বর বিল্ডিং’রিকশাওয়ালা ঘুরে তাকায় ওর দিকে। ‘আফা এই উঁচা রাস্তায় টানন লাইগবো জাইনলে ভাড়াডা নিতাম না আমি। বুকে অসুখ আছে। উফ্রে টানতে জানডা বাইরাই যায়’।  
লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে ওর , ‘আহা আমি বুঝিনিরে ভাই! এত  রোদ, আসলেই যদি না যাও তাই বলিনি বখশিশ দিয়ে দেব’
রিকশাওয়ালা হাসে। কী সুন্দর ঝকঝকে হাসি,  ‘আফনের বাড়িত নাইমা ভাইডারে এক গ্লাস ঠান্ডা ফিরিজের পানি খাওইয়াইয়েন’রিকশাওয়ালার কথাটা বাতাসে মেলানোর আগেই পেছন থেকে জোর ধাক্কা।  রিকশাশুদ্ধু ওরা পালকের মতো উড়ে পড়ে মাটিতে। কেউ কিছু বোঝার আগেই ট্রাকটা ঝড়ের বেগে অকুস্থল পার হয়ে যায়  
রাস্তায় মাথাটা ঠোকার আগে ও ভেবেছিল, ভাগ্যিস রিকশাওয়ালাকে বলেছিল ঠিকানাটা!   


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন