ভূত আমার পুত
ভূত
বলতে যেমন একটা গা ছমছমে অনুভূতি থাকে, একটা পুরনো বাড়ির ভেতরে যে অতৃপ্ত ভূত
রাতের বেলায় মোমবাতি হাতে নিয়ে একা একা গান গেয়ে বেড়ায় বা কখনও তার নূপুরের শব্দও
শোনা যায়... অথবা কোনো ব্যর্থ প্রেমিক ভূত ঝড় বৃষ্টির রাতে হাইওয়ে থেকে একা কোনো গাড়ির
মালিককে আলো দেখিয়ে হানাবাড়িতে টেনে এনে
খুন করে, আর সেইসব গল্প লোডশেডিঙের রাতে অন্ধকার ঘরে বাজ পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে
মৌজ করে বসে শুনতে হয়, আর তখন গায়ে কাঁটা দেওয়া যে অনুভূতি, তারই নাম বুঝি ভূত।
সত্যি বলতে কি, এই ধরনের গল্প শুনতে ভালো লাগলেও খুব একটা ভয় কোনোদিনই পাই নি
ভূতকে। রাতে দুঃস্বপ্নও দেখি নি ভূতের। একটা অনস্তিত্ব নিয়ে লোকে কত রকম
কল্পনা করে, ভয় মিশ্রিত এক ভালো লাগায় ভরে থাকে – ভাবলে বরং বেশ মজা পাই, উপভোগ
করি সেই ছোটবেলা থেকেই।
ভূত
অর্থাৎ অপদেবতা, যার সঙ্গে অন্ধকারের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। অন্ধকারের মধ্যে তাদের
কালো কায়াহীন দেহ ছায়া হয়ে মিশে থাকে। কেউ দেখতে পায়, কেউ পায় না। ভূত শহরের স্ট্রীট
লাইটের নীচে বা দিনের আলোয় বেরোয় না। ঝকঝকে তকতকে পরিবেশেও থাকে না। একটা পুরনো
গন্ধমাখা ছবির মধ্যে, একটা প্রাচীন ধারণার
মধ্যে ওরা থাকে। একটা বিশ্রী রূপ আর কটু
গন্ধের মধ্যে তারা থাকে। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু আলোময় ও প্রকাশ্য, ভূত তার থেকে
সাত হাত দূরে থাকে। এই যে যা কিছু অপ্রকাশ্য, যা কিছু অসুন্দর, তাকেই ভূত অর্থাৎ
অতীত বলে দেওয়া হলো – এই রকম ধারণার আমি প্রবল বিরোধী। অতীতে কি আলোময় দিন ছিল না? কত মধুর স্মৃতি ফেলে এসেছি, তার রোমন্থন
তো আমরা করেই থাকি বারবার। তবে কেন ভূতকে অন্ধকারময় করে রাখা হয়? কেন ভূত আলো
দেখবে না? প্রিয় কেউ মারা গেলে তার ভূত এসে আমাদের ভয় দেখাবে কেন? আমাদের যারা
প্রিয়, তারা তো ভয় দেখায় না! এইসব উদ্ভট ধ্যানধারণা দিয়ে একটা বিক্রয়যোগ্য মশলা
আমরাই তৈরি করি, আমরাই কিনি, আর মুচমুচে করে ভেজে খাই। সেই জন্যই এত হ্যালুয়িন, এত
ভূত চতূর্দশীর দাপট আমাদের দিনকালে এখনও।
ভূত
সম্পর্কিত একটা অভিজ্ঞতা বলি এখানে। যদিও আমি কিছু দেখি নি বা শুনি নি, কিন্তু
আমার বাড়ির অন্য সদস্যরা দেখেছেন বা শুনে ফেলেছেন! আমাদের দাদু মারা যাওয়ার পরের
ঘটনা। দাদু ছিলেন চরম ভক্তিবাদী। গেরুয়া ও খড়ম পরে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলার ঠাকুরঘরে
উঠতেন ব্রাহ্ম মুহূর্তে। আর সেই খড়মের আওয়াজ সারা বাড়ির লোকের ঘুম ভাঙাত। তাঁর
মৃত্যুর ঠিক পরে অনেকেই নাকি ভোরবেলায় এবং রাতের বেলায় সেই খড়মের শব্দ শুনেছেন!
এমনকি রাতে লোডশেডিং হলে তাঁর ঘরের ভেতর লাল চোখ জ্বলতে দেখেছেন কেউ কেউ! ভয়ে কেউ
তাঁর ঘরের দিকে যেতে চাইত না সেই সময়ে।
অথচ আমি কিছু দেখি নি, শুনি নি। আর দাদু লাল চোখ দেখিয়ে কেন তাঁর প্রিয় পরিবারের
সদস্যদের ভয় দেখাবে, সেটাও বোধগম্য হয় নি। এরকম অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে শুনেছি।
মহাশ্বেতা দেবী মারা যাওয়ার পর তাঁর পৌত্র তথাগত ভট্টাচার্য লিখেছেন এমনই এক
অভিজ্ঞতা কথা। ৩০শে জুলাই তিনি ফেসবুকে
লিখছেন, ‘কালকে রাতে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। পরশু থেকেই
পাগলের দশা। কালকেও সারাটা দিন সেই কাটলো। অসম্ভব ক্লান্ত। কিন্তু এক ছোটবেলার বন্ধু বিদেশে ফেরৎ
যাচ্ছে আজ। তার সাথে কথা বলতে বলতে বেশ রাত হয়ে গেলো। তখন বাকী সবাই ঘুমিয়ে কাদা।
শুতে যাওয়ার আগে বারান্দায় গেলাম সিগারেট খেতে। সবে ধরিয়েছি, সামনের রাস্তার কুকুরগুলো, যারা
আমাদের সবাইকে চেনে কিরকম পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে বাগানের দিকে ছুটে এলো।
কিরকম একটা ওয়ার্ণিং মনে হলো। বারান্দার বাঁদিক থেকে একজন
মানুষের গলার গোঁঙানির আওয়াজ আসতে শুরু করল। সেদিকে তাকাতেই দেখি বাগানের একটা
সারির গাছগুলো কিরকম একটা একটা করে দুলতে দুলতে আমার দিকে আসছে। যেন কেউ একটা কিছু
সরাতে সরাতে আসছে। সোজা ভেতরে ঢুকে দরজা দিলাম আর আশ্চর্যরকম ভাবে কুকুরদের ডাক
বন্ধ হয়ে গেলো’। এখন সদ্য
ঠাকুমাহারানো ব্যথা বা অতিরিক্ত ক্লান্তিজনিত কারণেই হোক আর যাই হোক, এই
হ্যালুসিনেশন তাঁর হয়েছিল তো!
অ্যামেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলো যতই প্রগতিশীল বলে নিজেদের
দাবী করুক না কেন, ওরা কিন্তু ভূত চর্চায় পিছিয়ে নেই। এমনকি ভূত নিয়ে বিভিন্ন
প্যাকেজ তৈরি করে তারা ঢালাও ব্যবসা চালাচ্ছে। যে সব পুরনো বাড়ি, হোটেল, প্রাসাদ
ইত্যাদি হানাবাড়ির খেতাব পেয়েছে, তাদের ঘিরে তারা পর্যটন ব্যবসা খুলে ফেলেছে।
বিভিন্ন রকম প্যাকজে তারা টুরিস্টদের ভূত দেখাবার ব্যবস্থা করে। ভূত দেখতে গেলেও
ফেল কড়ি, মাখ তেল। বিভিন্ন রকম লাইট অ্যান্ড সাউন্ড এফেক্ট দিয়ে ভৌতিক আবহ তৈরি
করে আর দর্শকরাও সেই ভূতুড়ে ব্যাপারস্যাপার দেখে তৃপ্ত হয়। আমাদের দেশ অবশ্য
ব্যবসার ক্ষেত্রে এমন সাফল্য লাভ করে নি, কিন্তু হানাবাড়ি আমাদের এখানেও কম নেই।
ইউনাইটেড স্টেটসের পেনিনসিলভ্যানিয়ার ফিলাডেলফিয়ায় ইস্টার্ন
স্টেট পেনিটেনসিয়ারি ১৮২৯ সালে তৈরি হয়েছিল। এই জেলে প্রথম পেনিনসিলভ্যানিয়া
সিস্টেমের প্রচলন হয় যেখানে সলিটারি সেলে কয়েদিদের আটকে রাখা হতো। এই সেলে কয়েদিরা
সম্পূর্ণ একা থাকত, একা ঘু্মোত, একাই খেত, এমনকি সেলের বাইরে নিয়ে যেতে হলে তাদের কালো কাপড়ের হুড
পরিয়ে বাইরে বের করা হতো। এর ফলে বেশির ভাগ কয়েদিরা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে পড়ত। এই কারণে ১৯১৩ সাল থেকে এই
সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং তারপর থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত এটি সাধারণ জেল-এ পরিণত
হয়। ১৯৭১ সাল থেকে এই বিল্ডিংটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়। যদিও ১৯৪০ সাল থেকেই অনেক রকম
ভৌতিক অনুষঙ্গ দেখতে পেয়েছেন অনেকে,
কিন্তু পরিত্যক্ত হওয়ার পরে অবস্থা আরও ঘোরালো হয়ে দাঁড়ায়। কালো ছায়ামূর্তির সাঁত করে সরে যাওয়া, গার্ড টাওয়ারে
কালোছায়া, সেলব্লক ১২ থেকে ভৌতিক চিৎকার ভেসে আসা, সেলব্লক ৬-এর দেওয়াল বেয়ে ছায়া
মূর্তির নেমে আসা, সেলব্লক ৪-এ ভূতুরে মুখ দেখতে পাওয়া, এছাড়াও পায়ের শব্দ, সেলের
দরজা ধাক্কানো, এসব তো রয়েছেই। জমজমাট এক ভূতের আসর বলা যায় আর কী!
কেনটাকির ওয়েভারলি হিলস স্যানাটোরিয়াম এরকম আরও একটি ভৌতিক জায়গা। ১৯১০ সালে একটি দোতলা কাঠের বাড়ি দিয়ে শুরু হলেও ১৯২৬ সালে এখন যেমন দেখা যায় সেই মূল আকৃতির বিল্ডিংটি তৈরি হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে মাঝ পর্যন্ত এটি যক্ষ্মার হাসপাতাল ছিল। মহামারীর সময়ে একসঙ্গে
প্রায় ৬৩,০০০ রুগী এই হাসপাতালে মারা যায়। এরপর থেকে ওয়েভারলি হিলস ইউএসের সব থেকে ভৌতিক স্থান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন ঘোস্ট অ্যাডভেঞ্চারস, ঘোস্ট হান্টারস (ট্যাপস)রা সক্রিয় হয়ে পড়ে। ট্যাপস তাদের থার্মাল ইমাজিনা ক্যামেরায় হলের ভেতরে তিন ফুট লম্বা এক ছায়ার হেঁটে যাওয়া দেখায়। পরে গবেষণা করে জানা যায় টিম নামের এক ছোট ছেলের ভূত ওটি। এর বাইরে বিভিন্ন রিপোর্ট যেমন ছায়া শরীরের ঘুরে বেড়ানো, ফাঁকা ঘর থেকে আসা চিৎকার, পায়ের শব্দ, একটা গা হিম করা অনুভূতি,
এসব তো আছেই।
নিউ
সাউথ ওয়েলস-এর জুনি-তে মন্টি ক্রিস্টো হোমস্টেড অস্ট্রেলিয়ার সব থেকে ভূতুরে
জায়গা। এই বিল্ডিং-টি তৈরি হওয়ার সময় (১৮৮৫) থেকে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলে
টানা ১৯৪৮ পর্যন্ত। ক্রলে পরিবারের ছিল এই সম্পত্তি। এই পরিবার একের পর এক অনেক
মৃত্যুর সাক্ষী থেকেছে। একটি বাচ্চা ছেলে সিঁড়ি থেকে
পড়ে মারা যায়। ব্যালকনি থেকে পড়ে এক পরিচারিকার মৃত্যু হয়। আস্তাবলে কাজ করা একটি
ছেলে আগুনে পুড়ে মারা যায়। ১৯৪৮ সালে ক্রলে পরিবার এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও মৃত্যুর
মিছিল থামে নি। এক দল কেয়ারটেকার এই বাড়ির দায়িত্ব নেয় এরপর। কিন্তু তাদের একজনও
খুন হয়ে যায় আচমকা।
নর্থ লন্ডনের হাইগেট সেমিটারি ঘোস্ট হান্টারদের জন্য এক আদর্শ স্থান। এখানে ঘুরে
বেড়ালে হিচককের হরর ফিল্মের মতো রোমাঞ্চ অনুভূত হবে। ঠিক যখন সন্ধ্যে নেমে আসবে এই হাইগেট সেমিনারির ওপরে, এখানকার
গথিক স্ট্রাকচারের বিল্ডিং গুলোর ওপরে, তার ওপর আবার ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে
মুন্ডুহীন ধরের মূর্তি, কাঁকড় বিছানো লম্বা ঘাস ভর্তি আঁকাবাঁকা রাস্তা – চারদিকে
শুনশান নিস্তব্ধতা আর হঠাৎ করে ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া পেঁচার ডাক – আপনার গা ভয়ে
কেঁপে যেতে বাধ্য। এই কারণে ইউকের সব থেকে ভূতুড়ে জায়গা হিসেবে নর্থ গেট
সেমিটারিকে ধরা হয়।
অ্যামেরিকার ওন্টারিওর স্ক্রিমিং টানেল এমনই আর এক কুখ্যাত ভৌতিক স্থান।
নায়াগ্রা ফলসের সঙ্গে টরন্টো আর নিউ ইয়র্কের সংযোগ রক্ষা করে যে রেলপথ, তার নীচে
এই সুড়ঙ্গ রয়েছে। শোনা যায় কয়েকশো বছর আগে এই সুড়ঙ্গের দক্ষিণ মুখের কাছে এক খামার
বাড়ি ছিল। কোনো কারণে সেই বাড়িতে আগুন লাগে আর সেই বাড়ির এক মেয়ে গায়ে আগুন লাগা
অবস্থায় প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটতে ছুটতে এই টানেলে প্রবেশ করে। যদিও সেই মেয়ে
সেখানেই পুড়ে মারা যায় শেষ পর্যন্ত। আর তারপর থেকে যদি কেউ এই টানেলের ভেতরে একটি
দেশলাই কাঠি জ্বালে, সেই মেয়েটির আত্মা চিৎকার করতে করতে ছুটে এসে সেই ব্যক্তিকে
খুন করে। প্রমাণ চান? তাহলে আপনাকে ওই টানেলের ভেতরে একটি দেশলাই কাঠি জ্বেলে
দেখতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি
বিচে জাপানীরা অকাতরে চাইনিজ সৈন্যদের খুন করত। হাজারে হাজারে সন্দেহভাজন চাইনিজ যোদ্ধাদের
এই বিচে অত্যাচার করা হতো, খুন করা হতো। এরপর
থেকে এই বিচে অসহায় নিরপরাধ মানুষের
চিৎকার ও কান্না শোনা যেতে থাকে। এমনকি রাতে শাবল দিয়ে লাশ পোঁতার জন্য গর্ত
খোঁড়ার শব্দ শোনা যায় আর যত্রতত্র মুন্ডুহীন ধর পড়ে থাকতে দেখেছে অনেকেই।
এছাড়াও সাউথ আফ্রিকার কেপ টাউনের ক্যাসল অফ গুড হোপ, লন্ডনের দ্য টাওয়ার অফ
লন্ডন, ইন্দোনেশিয়ার সেমারাং-এর লাওয়াং সেয়ু, ইটালিত পভেগ্লিয়া আইল্যান্ড,
মেক্সিকোর যোচিমিল্কোর আইল্যান্ড অফ দ্য ডলস, ক্যালিফোর্নিয়ার দ্য কুইন মেরি
হোটেল, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের মেরি কিঙ্গস ক্লোস, বারমুডা ট্রায়েঙ্গল যেমন
ভৌতিক স্থান হিসেবে বিখ্যাত হয়েছে, তেমনি এই তালিকায় ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউসও
বাদ যায় নি। কপাল সহায় হলে আর মন চাইলে এই বাড়িতে আপনি চার্চিল বা লিঙ্কনের ভূতের
সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে আসতে পারেন!
এ তো গেল বিলেতের সব সাহেব
ভূতদের এবং তাদের বাড়ির কথা। এবার নিজের দেশের হানাবাড়িগুলোর কথা বলি। রাজস্থানের ভানগড় ফোর্ট ১৭র দশকে তৈরি হয়েছিল। শোনা যায় এক
ডাইনীর অভিশাপ লেগেছিল এউ দূর্গের গায়ে। ফলে সেখানকার প্রায় দশ হাজার মানুষ মারা
গেছিল। তারপর থেকে সেই ডাইনী আর রাজকন্যার আত্মা ওই প্রাসাদে ঘুরে বেড়ায়। এই দূর্গ
টুরিস্টদের জন্য সূর্যাস্তের পর বন্ধ থাকে। এমনকি জানা গেছে, একটি ফিচার ফিল্ম
বানানোর সময়ে অভিনেতারা নানারকম ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। এই দূর্গটি ভারতের
সব থেকে ভৌতিক স্থানের মর্যাদা পেয়েছে!
মুম্বাইয়ের গ্র্যান্ড পারাদি টাওয়ারস এক বাসস্থান যেখানে
ক্রমাগত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রথমে বাসাদেও ও তারা দালাল তাঁদের পুত্র
বালকৃষ্ণ এবং পুত্রবধূ সোনালের অত্যাচারে এই বিল্ডিং থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা
করেন। ছেলে, ছেলের বউ অ্যারেস্ট হয়। কোর্টে কেস চলাকালীন এঁরা এঁদের ১৯ বছরের
মেয়েকে নিয়ে একই ভাবে বিল্ডিং থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এর পরেও এমন বহু
দুর্ঘটনার সাক্ষী থাকে এই টাওয়ার। কিন্তু এই ক্রমাগত দুর্ঘটনার কোনো যুক্তিসঙ্গত
কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি আজ পর্যন্ত।
গুজরাটের সুরাটের ডুমাস বিচ কালো বালির জন্য বিখ্যাত। এর
বাইরে এর রহস্যময় কর্মকান্ডও কম আকর্ষণীয় না! এই বিচে শ্মশান থাকার ফলে টুরিস্টরা
নাকি অনেকের কথা শুনতে পেলেও কাউকে দেখতে পায় নি। এমনকি টুরিস্টদের এই ভূতুড়ে স্বর
তাদের নিজের জায়গায় ফেরত যেতে হুমকি দেয়!
পুনের শনিওয়ারওয়াড়া ফোর্ট ঐতিহাসিক স্থান এবং ভূতুড়েও। শোনা
যায় ছেলেবেলায় এক রাজকুমার তার কাকার হাতে খুন হয়। আর মৃত্যুর আগে তার চিৎকার
‘কাকা মালা বাচবা’ (কাকা আমাকে বাঁচাও) এখনও রাতে শোনা যায়! আর এই চিৎকার শুনে যে
কোনো মানুষেরই দাঁতে দাঁত লেগে যেতে বাধ্য।
দিল্লীর সঞ্জয় ভান জঙ্গলে আবার বলিউড স্টাইলে এক সাদা শাড়ি
পরা মহিলাকে দ্রুত গতি গাড়ির স্পিডে চলে যেতে দেখা যায় আর নিমেষেই তিনি হাওয়ায়
মিলিয়েও যান!
কলকাতার সাউথ পার্ক সেমেটারি আরেক ভৌতিক স্থান। অনেকেই
এখানে এসে আচমকা মারা গেছেন। একবার নাকি একদল টুরিস্ট এখানে ছবি তুলেছিল বলে তাদের
ওপর নানা রকম উৎপাত শুরু হয়। যিনি ছবি তুলেছিলেন তাঁর হঠাৎ হাঁপানি জনিত শ্বাসকষ্ট
শুরু হয়ে যায়, যদিও জীবনে তাঁর কোনোদিন হাঁফানি ছিল না!
দিল্লীর অগ্রসেন বাউলির গল্পটা এরকম – এখানে এক কুঁয়ো কালো
জলে ভর্তি থাকত। আর মানুষকে এই জলের অশুভ আত্মা আত্মহত্যা করিয়ে নিত। এখনও রাতে এর
ধারেকাছে কেউ ঘেঁসে না।
রাজস্থানের কোটার ব্রিজরাজ ভবন প্যালেস হেরিটেজ হোটেলে
রূপান্তরিত হয়েছে। ১৮৫৭র সিপাই বিদ্রোহের সময়ে ব্রিটিশ মেজর বার্টন তাঁর দুই ছেলে
সহ এখানে খুন হন। এই হোটেলের নাইট গার্ডদের মুখে শোনা গেছে তারা এই মেজরের ভূতের
হাতে চড় খেয়েছেন!
কার্শিয়াঙের ডাও হিল-এর জঙ্গলে অনেক অস্বাভাবিক
কান্ডকারখানা দেখা গেছে। ভিক্টোরিয়া বয়েস স্কুল ও ডাও হিল বোর্ডিং স্কুল গর গার্লস
– ভৌতিক কান্ডের জন্য কুখ্যাত। পায়ের আওয়াজ ছাড়াও এক মুন্ডুহীন বালককে জঙ্গলের
দিকে প্রায়ই হেঁটে যেতে দেখা যায় এখানে।
মুম্বাইয়ের মাহিমের ডিসুজা চাওলের কাছে এক কুঁয়োয় নাকি এক
মহিলা পড়ে গিয়ে মারা যান। আর সেই থেকে রাতে কুঁয়োর চারধারে ঘুরে ঘুরে তার আর্ত
চিৎকার শোনা যায়।
দিল্লীর ফিরোজ শাহ কোটলায় কোনো মহিলার একা যাওয়া মানা। এই
ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা অশুভ আত্মা
মহিলাদের একা দেখলেই প্রথমে মিষ্টি খাওয়ার অনুরোধ করে, পরে তাকে আক্রমণ করে মেরে
ফেলে।
উত্তর প্রদেশের মিরাটের জিপি ব্লকের পাশ দিয়ে যাঁরা গেছেন,
তাঁদের অনেকেই চারজন যুবককে মোমবাতির আলোয় খানাপিনা করতে দেখেছেন। অনেকে আবার এই
পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে লাল জামা পরা এক মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখেছেন।
অসমের জাটিঙ্গা গ্রাম আবার পাখিদের আত্মহত্যার জন্য বিখ্যাত
এক গ্রাম। প্রত্যেক বছর সেপ্টেম্বরের পরে অমাবস্যার রাতে পরিযায়ী পাখিরা এখানে এসে
দলে দলে আত্মহত্যা করে। কয়েকশো বছর ধরে ঘটে চলেছে এই ঘটনা।
সেই ১৮০০সাল থেকে রাজস্থানের কুলধারা গ্রামটি পরিত্যক্ত পড়ে
আছে। কথিত আছে ১৮২৫ সালের কোনো এক রাতে
কুলধারা এবং আশপাশের ৮৩টি গ্রামের মানুষ
একসাথে কোনও সূত্র না রেখে উধাও হয়ে যায়। এও শোনা গেছে যে এই রাজ্যের মন্ত্রী
সেলিম সিং এই গ্রামে এসে মোড়লের মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করতে চায়। আর এই
হুমকিও দিয়ে রাখে, যদি মোড়ল এই প্রস্তাবে রাজী না হয় খাজনা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে
দেবে। নিজের জাতের বাইরে বিয়ে দেবে না বলে এই গ্রামবাসীরা তাই উধাও হয়ে যায়। এখনও
কুলধারা গ্রামে তাই বাইরের লোক ঢুকতে ভয় পায়।
দিল্লীর লোথিয়ান সেমেটারিতে ১৮৫৭র বিদ্রোহের পর একসাথে অনেক
কবর দেওয়া হয়। এই কবরখানা বৃটিশ সৈন্য নিকোলাসের মুন্ডুহীন ধরের আস্তানা।
মুম্বাইয়ের কোলাবার পরিত্যক্ত মুকেশ মিলে বহু সিনেমার শুটিং হয়েছে। কিন্তু রাতে
এখানে কেউ কাজ করতে সাহস পায় না। শোনা যায় একবার এক অভিনেত্রীকে ভূতে ধরেছিল এবং
তারপর তিনি পুরুষ স্বরে কথা বলতেন!
কলকাতার প্রসিদ্ধ রাইটার্স বিল্ডিং-এ ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির বৃটিশ ক্যাপটেন সিম্পসনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বিনয়, বাদল, দীনেশ
হত্যা করেন। আর সেই থেকে এখনও রাতে এই সাহেব ভূত এই বিল্ডিং-এ
ঘুরে বেড়ায়। অফিসের সময়ের পরে এবং রাতে এই বিল্ডিং-এ আজও কেউ থাকতে সাহস পায় না।
মুম্বাইয়ের সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্কে এক সময়ে বুনো
জন্তুদের হাতে অনেক মানুষ নিহত হয়। সেই থেকে নাকি ওখানে তাদের ভূত ঘুরছে! মুম্বাইয়ের
অভিজাত ও বিলাসবহুল তাজমহল হোটেলও ভূতের হাত থেকে রেহাই পায় নি। এই হোটেলের স্থপতি
এখানেই আত্মহত্যা করে। আর আজও তার ভূত তাই এই হোটেল ছেড়ে বেরতে পারে নি। থানের
বৃন্দাবন সোসাইটির ৬৬বি নম্বর বিল্ডিং-এ একজন একবার আত্মহত্যা করে। সেই থেকে রাতে
নাইট গার্ডদের চেয়ার থেকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, চড়-থাপ্পর সহ্য করতে হয়।
উত্তরাখন্ডের মুসৌরির লম্বি ডেহার খনিতে এক সময় লাখে লাখে
শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল দম বন্ধ হয়ে। সেই থেকে এখানে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে দেখা
যায়। শোনা যায় রাত বাড়লে পাহাড়ের ওপর থেকে এক পেত্নী নেমে আসে। এছাড়াও দিল্লির
জামালি কামালি মসজিদ, মুম্বাইয়ের বোম্বে কোর্ট, গোয়ার থ্রি কিঙ্গস চার্চ – এদেরও
ভূতুড়ে খেতাব রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার তোরাজান
উপজাতির আবার ভূতের ভয় নেই। পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেলে এরা সেই মৃতদেহকে বাড়িতেই রেখে
দেয়। আগের মতো নিয়ম করে খেতে-পরতে দেয়,
রাত হলে তার বিছানায় শুইয়ে দেয়। কিছুদিন বাদে সেই দেহকে মমি বানিয়ে কফিনে রেখে
দেয়। এরপর বিশেষ বিশেষ দিনে সেই মমিকে কফিন থেকে বের করে আনে। পরিবারের অন্য সদস্যরা
তাকে নতুন জামা পরিয়ে দেয়, আগের মতো সেই মমিকে পাশে বসিয়ে খাওয়ায় পরায়, উৎসব
আনন্দে সামিল করে। এরপর সেই মমিকে আবার কফিনে রেখে আসে। এদের বিশ্বাস, মারা গেলেও
পরিবারের সেই সদস্যের উপস্থিতি বা ভালোবাসা কমে না। জীবিত যারা তারাও তাই মৃতকে
এভাবে মনে রাখে। আমার তো বেশ পছন্দের এই প্রথা। প্রিয়জনের মৃত্যুতে যে শূন্যতা
তৈরি হয়, এই উপায়ে তা দূর হতে পারে। কী বলেন আপনারা?
বাহ্। দুর্দান্ত লিখেছ। ভূত নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর লেখা।
উত্তরমুছুনপরের পর্বে বাকিটা
মুছুন