শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

পারমিতা চক্রবর্তী

সহবাস




সহবাস শব্দের অর্থ বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, এই শব্দটির তিনটি আঙ্গিক বা দিক  আছে - . একত্রে অবস্থান, অর্থাৎ একসঙ্গে বাস করা, . সংস্পর্শ, সান্নিধ্য (“সহবাসের দ্বারা একরকম মন আরএক রকম হইয়া পড়ে”, . সঙ্গম, রমণ (স্ত্রী  সহবাস) {সহ+বাস} শব্দটিকে বিভিন্ন রূপে ব্যবহার করে থাকি৷ সহবাস শব্দটি  বললেই সবার আগে যেটি মাথায় আসে তা হলো একটি নারী পুরুষের সহ অবস্থান তা দৈহিক, মানসিক এবং পারিপার্শিক সবটুকুই বোঝা যায় এখন দেখা যাক এই শব্দটিকে নিয়ে কে কী ভাবে ভেবেছেন :  

সহবাস শব্দটির প্রচলিত অর্থ করলে আমরা দেখি একসঙ্গে অবস্থান, সংসর্গ (“এই মহাশয়ের সঙ্গে অনেক দিন সহবাস করিয়াছিলাম” - প্যারীচাঁদ মিত্র; “হেন সহবাসে  হে পিতৃব্য বর্বরতা কেন না শিখিবে? গতি যার নীচসহ, নীচ সে দুর্মতি” - মাইকেল মধুসূদন দত্ত; “মুসলমান সহবাসে প্রায় দিবারাত্তির থেকে কেতাই এঁর বড় পচন্দ”  - ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, কালীপ্রসন্ন সিংহ; “তবে একটা কথা  জিজ্ঞাসা করি, তুমি  স্ত্রীলোক হইয়া সর্বদা জীবানন্দ ঠাকুরের সহবাস কর কেন? ‘আনন্দমঠ’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; “নারীর সঙ্গ যাহাদের পক্ষে একান্ত উপাদেয়  আমি সেই সামান্য শ্রেণীর মানুষ নই এবং দেশের ইতর সাধারণের ঘনিষ্ঠ সহবাস আমার পক্ষে সম্পূর্ণ বর্জনীয়” ‘গোরা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) সহবাস শব্দটিকে  সংস্পর্শ বা সান্নিধ্য অর্থেও ব্যবহার করেছেন প্যারীচাঁদ মিত্র (“সহবাসের দ্বারা একরকম মন অন্য আরএক রকম হইয়া পড়ে”) মাইকেল মধুসূদন দত্ত সহবাস  শব্দকে গতিশীল করতে  চেয়েছিলেন৷

কালীপ্রসন্ন সিংহ এক জায়গায় সহবাসকে সহাবস্থান অর্থাৎ বর্ণ, ধর্ম, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখতে চেয়েছিলেন৷ ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘আনন্দমঠ’এ  সহবাস শব্দকে নারী-পুরুষের এক গভীর মর্মবোধের মধ্যে দেখতে চেয়েছিলেন৷ রবিঠাকুর নারী চরিত্রের দুর্জ্ঞেয়তা তীব্র সামাজিক বোধ ফুটিয়েছিলেন তাঁর বিভিন্ন ছোটগল্পে৷ ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুন্দরভাবে সহবাস ব্যাখা করেছেন আশালতা, বিনোদিনী, মহেন্দ্র, বিনোদবিহারী চারটি চরিত্রের মধ্যে  সহবাসকে অদ্ভুত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘চোখের বালি’র গল্পে নারী পুরুষের মধ্যে শুধু দৈহিক সহবাস ছাড়াও মনের সহবাসকে রবীন্দ্রনাথ প্রাধান্য দিয়েছিলেন৷

“বিহারী কহিল, বৌঠান, আমি অনেক ভাবিয়াছি নানান হাঙ্গামে আমাদের জীবনের জালে অনেক জট পড়িয়া গেছে এখন নিভৃতে বসিয়া বসিয়া তাহারই একটি একটি গ্রন্থি মোচন করিবার দিন আসিয়াছে পূর্বে সমস্ত পরিষ্কার করিয়া লইতে হইবে এখন হৃদয় যাহা চায়, তাহাকে আর প্রশ্রয় দিতে সাহস হয় না পর্যন্ত যাহা-কিছু ঘটিয়াছে, যাহা-কিছু সহ্য করিয়াছি, তাহার সমস্ত আবর্তন, সমস্ত আন্দোলন শান্ত করিতে না পারিলে, জীবনের সমাপ্তির জন্য প্রস্তুত হইতে পারিব না যদি সমস্ত অতীতকাল অনুকূল হইত, তবে সংসারে একমাত্র তোমার দ্বারাই আমার জীবন সম্পূর্ণ হইতে পারিত -- এখন তোমা হইতে আমাকে বঞ্চিত হইতেই হইবে এখন আর সুখের জন্য চেষ্টা বৃথা, এখন কেবল আস্তে আস্তে সমস্ত ভাঙচুর সারিয়া লইতে হইবে এমন প্রত্যাখ্যান ও সমর্পণ, যার ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়!

কিন্তু এই শব্দটি দিয়ে বাংলায় শুধু স্বামী-স্ত্রীর যৌনমিলন বোঝায় (“নতুন বিবাহ হলে গুরুসেবা না করে স্বামী সহবাস করবার অনুমতি ছিল না” ‘হুতোম প্যাঁচার  নকশা’,  কালীপ্রসন্ন সিংহ; “অতএব যাহাতে আপনার পুত্রবধূর সঙ্গে আপনার  পুত্রের কখন সহবাস না হয় বা প্রীতি না জন্মে, সেই ব্যবস্থা করুন” ‘সীতারাম’,  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
সংস্কৃতে সহবাস শব্দের সমার্থক শব্দ হলো সহবসতি' (আমি তোমার স্বামী আমার  সহবসতিই তোমার ধর্ম)
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে বাংলায় সহবাস শব্দের আর একটি অর্থ লিখেছেন, পতির পত্নীর সহিত অবস্থান' আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ ‘সঙ্গদোষে' অর্থে সহবাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন (“হেন  সহবাসে, হে পিতৃব্য, বর্বরতা কেন না শিখিবে?)

সহবাস শব্দ নিয়ে বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক বিভিন্ন আঙ্গিকে ভেবে গেছেন এই শব্দকে কখনই নারী-পুরুষের দৈহিক, মানসিক প্রেক্ষাপটে আটকে রাখা ঠিক হবে না এখন প্রশ্ন হলো এই শব্দটিকে আমরা শুধু মনুষ্য জাতির মধ্যে আটকে রাখব  কেন! সহবাস অর্থাৎ সহাবস্থান শব্দকে আমরা প্রকৃতি বা জীবজগতের মধ্যে  প্রায়শই দেখি ৷ একটি গাছ সে তো মাটির সাথে আজীবন সহবাস করে ৷ শিকড় যত গভীরে যায় গাছটির আয়ুও বাড়তে থাকে ৷ মাটিকে কেন্দ্র করে সহবাস করে কেঁচো, কেন্নো, বিছা প্রভৃতি কীটসম্প্রদায় ৷ এখানে দেখা যাচ্ছে এক মাটিকে ঘিরে বহু প্রাণী গাছের সহবাস হয়ে থাকে ৷ প্রকৃতির সাথে সহবাসের অর্থ এক্ষেত্রে আদিম মানুষের ন্যায় অসহায় দশায় প্রকৃতির হাতের পুতুল হয়ে থাকা নয় বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে প্রকৃতির অনুকূলে প্রয়োগ করে সহবাস করতে হবে এই যে বর্ষণের ফলে জল জমে, এর কারণ নগর পরিকল্পনার অভাব শহরে যত্রতত্র নির্মাণ চলছে সুবিশাল আকাশচুম্বী ইমারত, বাণিজ্যবিপণি, আবাসস্থল দেখলে মনে হবে বিজ্ঞানের কী অপার মহিমা! মাটিতে পাদস্পর্শ করলেই টের পাওয়া যায় মহিমা  জলকাদালাঞ্ছিত কোথাও হাঁটু অবধি, কোথাও তার চাইতেও বেশি যানবাহন অচল কর্মনাশা দিন বৃষ্টির সাথে আমাদের সহবাস হয় না কালবৈশাখীর প্রবল দাপটের সাথে মেঘের সহবাস আজকাল হয় না

আমাদের শরীরের সাথে মনের সহবাস থাকাটা ভীষণ জরুরি মন, যাকে বাহ্যিক স্পর্শে দেখা যায় না ঠিকই কিন্তু তার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে আমাদের অনেক বিষয়, ঘটনা, চরিত্রের সাথে সহবাস করতে হয় আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না শরীরের সাথে মনের সহবাস সঠিকভাবে হলে খোলা জানালা দিয়ে উড়ে আসে একঝাঁক পাখি, প্রজাপতির দল  বিকেলে ভোরের ফুল ফুটতে হয় না ‘প্রেম’ নামক এক উড়ন্ত মেঘের জন্ম নেয়  পুকুরপাড়ে কত হাঁস চড়ে বেড়ায় দৈনন্দিন জীবনে কত সংঘাত এক নিমেষে তরান্বিত করে, যদি মনের সাথে প্রেমের সহবাস থাকে

অন্তরতম মুহূর্তে শুরু হয় শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ দেহ অর্থাৎ একজন পুরুষ নারীর সহাবস্থানের এক রূপ বলা চলে সহবাস দুটি পৃথক পৃথক হৃদয় এক নিরাকার পাত্রে সহাবস্থান করে



যেখানে দেহজ ক্রিয়া, মানসিক ক্রিয়া একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে একজন নারী একজন পুরুষের এক সমতলে অবস্থান, তা সামাজিক বা বৈধ হতে পারে আবার নাও হতে পারে এখানে প্রশ্ন হলো বৈধতা ! কাকে বৈধ বলব কাকে নয় !  একজন পুরুষ একজন নারী যখন পারিপার্শ্বিক সমাজ, পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে উঠে  সম্পর্কের গভীরতায় পৌঁছায় তখন বৈধতার প্রশ্ন আসলেও তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলে চোরা স্রোতে সামাজিক স্বীকৃতিতে বিবাহ হলো সহবাসের উজ্জ্বল  প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর এই সহবাসকে ঘিরে তৈরি হয় পরকীয়া এখন প্রশ্ন হলো প্রেম / সহবাস / পরকীয়া কোনটি আগে বা কোনটির অবস্থান মুখ্য !  

আমার কাছে প্রেম এক অনুভূতি আর তার বাহ্যিক প্রকাশ হলো সহবাস পরকীয়া  শব্দটি ভীষণভাবে আপেক্ষিক রাধাকৃষ্ণের প্রেম যদি সমাজে পবিত্র হয় তবে একজন পুরুষ একজন নারী সামাজিক ভাবে স্বামী স্ত্রী বা প্রেমিক / প্রেমিকা হতে পারবে না কেন? তাতে সমাজের কাছে ভুল বার্তা যাবে; কিন্তু নিজের কাছে, নিজের  অস্তিত্বের কাছে ! তার খবর আমরা বোধহয় কেউই রাখি না তাই আজও আমাদের সমাজ সহবাসকে মেনে নেয়নি আমাদের জীবনবোধ আমাদের মানতে শেখায়নি

ছবি : আন্তর্জাল  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন