বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

মেঘ অদিতি

প্রিয় সম্ভাষণ


আমার জানালায় নেমে আসা ভোরে গত দুদিন কোনো পাখি ডাকেনি জানো। গোলার্ধেআলোকিত অংশে তুমি, আমার এদিকে অন্ধকারে মনকল্যাণ, সুর ছুঁয়ে ঝরে পড়ে যার সেতার সম্মোহনের ঝালা। তোমার সুশীতল ঘরের বাইরেটায় এখন আগুন গরম। এখানে ঘরের ভেতর নরম উষ্ণ মোম কারুকাজ, বাইরে ব্লিজার্ড। তাণ্ডব চলছে তুষার আস্তরের সাথে হাওয়ার। পঞ্চাশ কিলোমিটার গতিবেগের সাথে প্রতি ঘন্টায় তিন চার ইঞ্চির তুষারপাতের। আর ঝড়ো বাতাসের একটানা আওয়াজ ছাপিয়ে কী করে ভেসে উঠেছে যেন তোমার গমগমে কন্ঠ। যেন এখুনি আমাকে তুমি পড়ে শোনাবে ‘দ্য বেলজার’ থেকে চ্যাপ্টার এইট।

বসন্তর খবর জানাতে আগাম যে চেরির মুকুলগুলো এসেছিল তারা এখন কোথায়! শীতের একদম শেষপ্রান্তে সত্তর সেন্টিমিটার পর্যন্ত তুষারপাতের আশঙ্কা নিয়ে আঘাত করা এই ঝড় আমাদের ঘরবন্দী করে রেখেছে। ঘর বলতে যদি অন্দরমহল হয় তবে তাকে উষ্ণ রাখা হয়েছে যতটুকু উষ্ণতাকে মনোরম বলে মনে হয়। আর যদি অন্তরমহলের কথা বল তবে বলব ইমনে কল্যাণে, তুষারে হাওয়ায়, সেখানে দিনরাত বাজছে সমিল সঙ্গীত যার কাছে কান পাতলে খুব মৃদু সুরে ভরে ওঠে আমার আকাশ। নিরক্ষরেখায় বিভক্ত যে আলোকিত গোলার্ধ তোমার সেখানে এখন পূর্ণ দুপুর।  ছায়াশীতল ঘরে কার্টেনের ফাঁক দিয়ে শহরের গনগনে রোদের আঁচ মাপতে যেদিক তাকিয়ে এখন তুমি শুধু সেখানে নয় সর্বত্রই গরম কামড়ে ধরেছে শহরের ফুসফুস। শ্বাস কমে আসছে তার। এই মধ্যমার্চ, এই ঝলসে দিতে চাওয়া রোদ - এই হাঁপ ধরা সময়েও আর কিছুক্ষণ পরে তোমাকে বেরুতে হবে দু’টো অফিস ভিজিটে আর তখনও তোমার লাঞ্চবক্সে একই ভঙ্গীতে শুয়ে থাকবে শান্ত সবুজাভার স্যালাড, দুটো ভেজ স্যান্ডুইচ আর সবুজের ততোধিক গাঢ়তায় ডুবে থাকা বয়েলড দু টুকরো ব্রোকলি। তোমার যাপন ছবির মতো আমার কাছে দৃশ্যমান হয় এভাবেই। এই যে লাঞ্চবক্স পড়ে রইল টেবিলে চুপচাপ আর তুমি চেয়ারে হেলান দিয়ে এইমাত্র ডুবে গেলে নতুন কোনো ভাবনায়, তোমার চিবুকে কিন্তু গাঢ় একটা ছায়া মিশে গেল তখন আড়াআড়িভাবে। এভাবে আমিও কতগুলো বছর তোমাতে মিশে আছি বল তো!

তোমার আড়িয়াল খাঁ আমি কখনো দেখিনি। দেখিনি নিজের ধলেশ্বরীকেও কাছ থেকে। তবু খুব প্রিয় কী জিগ্যেস করলেই প্রথমেই বলি নদী। এই এখন, বাইরে যত তাণ্ডব বাড়ছে এদিকটায় তত শান্ত হয়ে আমি ডুব দিচ্ছি তোমাতে আর বাইরের ব্লিজার্ড কখন যেন বুকের ভেতর  কলোরাডো নদী হয়ে উঠেছে। নদী মানে অথৈ জল, নদী মানে গভীরতা। তবে কোনো কোনো নদী খরস্রোতা, কোনো নদী মরাসোঁতা হয় জানোই তো। হয়ত আমিও তাই। তোমাকে কখনো জানানো হয়নি যা কিছু দেখে ভেবেছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ এক পরিবারের চালিকাশক্তিটি আমি তেমন পরিবার কিন্তু আমার কখনই ছিল না। আমার বাবারও কি ছিল! বাস্তবতার একনায়কতন্ত্রে তাঁর শিল্পসত্ত্বার অকাল মৃত্যু ঘটেছিল! আর আমার? সংসার বলতে তো শুধু ঘরময় ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা তোষকবালিশ বাসনকোসন নয়। সংসার একটা বাগান যেখানে পর্যাপ্ত জল হাওয়া পেলে প্রতিটি ফুল স্বাস্থ্যবান হয়ে ফুটে ওঠে। আমি বরং একে বলি নাট্যমঞ্চ যেখানে আমার বাবা অথবা আমি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে বহুদিন অভিনয়  করে এসেছি । বাবা চলে গেছেন ছ বছর। দেয়ালে পিঠ  ঠেকতে ঠেকতে কী করে যেন আমি এসে পড়েছি ব্লিজার্ড বিপজ্জনক ঠান্ডার এই গোলার্ধে যেখানে দুপুরের নির্জনতা প্রায়ই আমাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ছড়িয়ে দেয় বাতাসে। আর রাতগুলো মায়ের মমতার মতই প্রশ্রয়ী। সেজন্যই কি আমি আবাহন করি রাতের! অথচ প্রতিটি রাতই কি আমাকে দাঁড় করিয়ে দেয়নি ম্যজিকাল  মিররের  সামনে যেখান থেকে আমার অতীত স্পষ্ট হয়ে ওঠে? কী করে যে তোমার কাছেও অতীত হয়ে উঠেছিলাম! পুরনো খবরের কাগজ বা আসবাবের মতই এত জীর্ণ হয়ে গেছি কবে!

গোলার্ধেআলোকিত অংশে তুমি। আর এবার বাড়ি ফেরার তাড়া, তোমার গাড়ি ছুটে চলেছে উড়াল সেতু ধরে আর পশ্চিমাকাশ লাল হয়ে উঠছে ক্রমে। সেদিকে তাকিয়ে কী একটা ভাবছো তুমি। এই উড়াল সেতুর বিপরীতেই একাকি শুয়ে আরেকটি বিষণ্ণ সেতু আমারই মতো কি? কই সেদিকে তুমি তো তাকালে না!

এরপর আলো নিভে এলে ঘরে পৌঁছে যাবে তুমি আর আলো ফুটবে তখন আমার আকাশে। তোমাকে লেখা এ চিঠির প্রতিটি শব্দ উড়িয়ে দেবো তোমারই উদ্দেশ্যে। ঘুমের ভেতর তখন আবার তুমি আমার হাত ধরবে।

এসো ঘুম, এসো - দু’চোখে স্তব্ধ নিবিড় পাতায়।
শান্ত হোক পৃথিবী...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন