ইচ্ছেকথন
কী এতো বিড়বিড় করে সৌম্য?
সে বলছিলো - স্যার যেন আসে, আসে, আসে।
মনে মনে বলা কথা মাঝে মাঝে ঠোঁট ফসকে বেরিয়ে আসে। এবারও তাই এলো। সৌম্য ক্লাস সিক্সে পড়ে। সব বিচ্ছিরি সম্পাদ্য উপপাদ্য পড়তে হয়। জ্যামিতির বই খুলে মাথা ভোঁ
ভোঁ। ত্রিভূজ, ত্রিভূজের
ভেতর বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত। সমস্ত মিলে রেখাচিত্রে যেন
আঁধার পুষে রেখেছে। ইংরেজী বই খুললেই এক স্তুপ আতঙ্ক- ট্রান্সলেশান, রিরাইট। পেঁচা দিনে ঘুমায়… দ্যা আউল স্লিপস
বাই ডে... পড়তে পড়তে রাতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। মা এসে মশা তাড়াল। ঘুম ভাঙ্গালো।
রোদ্দুরে পিঠ পেতে এক মনে কমলার আঁশ ছাড়াচ্ছে নানু। আঁশ ছাড়াচ্ছে কমলাও। হাতে সর্ষের তেল মেখে। নানু বেড়াতে এসেছে মেয়ের বাড়ি। মা-ই জোর করে এনেছে। বাবা যতদিন ট্যুরে নানু থাকুক। কচুর লতি চিংড়ি দিয়ে খেতে ভালোবাসে নানু। অফিসে যাবার আগে মা কমলাকে বলে গেছে রান্না করতে। সকাল থেকেই বারান্দায় লতি নিয়ে বসেছে কমলা আর কমলা নিয়ে নানু। কোয়ার্টসের সামনে পেছনে মাঠ। মাঠ পেরুলেই দোতলা স্কুল। বারান্দাটা বাড়ির পেছন দিকে। সেখান থেকে সৌম্যর স্কুল দেখা
যায়। যতটা কাছে মনে হয় ঠিক ততটা কাছে নয়। বেশ একটু ঘুরে সামনের মেইন গেট দিয়ে স্কুলে ঢুকতে হয়।
বারান্দা ঘেঁষে হরিতকি গাছ। ঝেঁপে ফল এসেছে এবার। কলা পাতা একবার বুক আরেকবার
পিঠ দেখায় বাতাসে। সেদিকে সৌম্যর চোখ নেই। বিড়বিড়ানি চলছে - ‘স্যার আসুক’। সে তাকিয়ে আছে ছোটকা’র সাইকেলের দিকে। আজ সন্ধ্যায় স্যার না এলে, বিকেলে ক্রিকেট
খেলার পর, সাইকেলে চড়ে একটু ঘুরে আসা যায়। অবশ্য যথেষ্ট ঘ্যানঘ্যান করতে হবে সেজন্য।
আসলে হয়েছে কি, কয়েক মাস ধরে সৌম্য লক্ষ্য করেছে, ও যা যা ভাবে ঠিক এর উল্টোটা হয়। এর পর থেকে সে সব উল্টো ভাবা শুরু করেছে। ব্যাস্! অমনি সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। ‘স্যার আসুক’
ভাবছে সে। এর মানে উল্টোটাই হবে। স্যার আজ আসবে না। আর কেউ না জানুক, সে তো নিজে জানে। আর সব কথা বড়দের বলতে নেই। হাসবে নইলে বকবে। সৌম্য তাই কথাটটা বেমালুম চেপে গেছে।
শান্তা খালা 'হল' থেকে বাড়ি এসেছে। ভার্সিটিতে পড়ে ফিন্যান্সে। ওর বাড়ির সামনে কয়েক পাক খাওয়ার
পর ছোটকা’র মন খুব ভালো থাকে। সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। শান্তা খালা সে সময় বারান্দায়
মেলে দেয়া কাপড় ঘরে তোলে। বারান্দায় একটু বেশি সময় থাকলে
ছোটকা’র দিলখুশ। শান্তা খালাদের সিঁড়ি ঘরে একদিন দেখে ফেলেছিল সে। টুক করে চুমু খাওয়াটা। ওকে দেখেই ছিটকে সরে গেল দুজন
দুদিকে। কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল সৌম্যর। অবশ্য বেশ ভালোও লাগছিল।
শ্যাওলা মাখা কার্নিশে দুটো কাক বসে আছে। সেদিকে রুটির টুকরো ছুঁড়ে দেয় সৌম্য। বিড়বিড় করে - শান্তা খালা একমাসও থাকবে না। থাকবে না, থাকবে না।
নানু কমলা এগিয়ে দেয় - মনা, কী বলো তুমি? নাও,
কমলা খাও। একটা কোষ মুখে পুরে উঠে যায়
সৌম্য। মিষ্টি রসে মুখ ভরে যায়। এই সময়টা কলে পানি থাকে না। মা বালতি ভরে পানি তুলে রেখে
গেছে। দুবার গায়ে পানি ঢেলে সে সাবানের ফেনায় বুদবুদ ওড়ায়।
স্কুল থেকে ফিরেই মন খারাপ। স্যার আজ আসবেন না। ফোন করেছিলেন। এ বাড়ি আসার সময় বাজারের রাস্তায় এক রিকশা ধাক্কা দিয়েছে। পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গেছে। পায়ে প্লাস্টার নিয়ে বাড়িতে
বসে আছেন। এদিকে শান্তা খালা নাকি মাস খানেক বাড়িতে থাকবে। ভার্সিটিতে আন্দোলন চলছে। কার গায়ে যেন গুলি লেগেছে। দিনভর মিছিল আর মিটিং। অনির্দিষ্টকালের জন্য ভার্সিটি বন্ধ।
রাতে লতি চিংড়ি দিয়ে ভাত খায় ছোটকা। মা’কে দেখে চিন্তিত গলায় বলে- ভাবী, গুলিটা ডান কাঁধে লাগেনি। বুকে লেগেছে। ছেলেটা মনে হয় বাঁচবে না। কিংবা হয়তো মরেই গেছে। অথরিটি সময় নিচ্ছে, একবারে প্রেস কনফারেন্স করে খবরটা জানাবে।
সৌম্য আর থাকতে পারে না। মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদে আর বলে - আর এমন বলব না। বলব না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় ওর। ওর ভাবনার জন্যই এমন অনর্থ
হলো। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে এ কি বিপদ ডেকে এনেছে সে!
মা চোখ মুছে দেয় - কী বলছ, মনা? কী বলবে না?
- সত্যি বলছি। আর এমন বলব না।
- ঠিক আছে, বলবে না। কী যে ভাবো সারাক্ষণ! কিচ্ছু হয়নি। শুয়ে পড়। আমি এসে মশারী গুঁজে দিচ্ছি।
সৌম্য আর ফোঁপাচ্ছে না। কেন জানি ওর মনে হলো মা সব ঠিক করে দেবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন