রাফখাতা
ইচ্ছে হলেই আধমালা বিকেলটা ফিরে আসবার সুযোগ পাবে না। তাকে
ভাবনার জন্য যত আয়োজন তা যদি জানতে দেয়া যেত তাহলে অনবরত চলতে থাকা যুদ্ধের
বিবরণটা পেইজ মার্কার দিয়ে থামিয়ে রাখা যেত। মত্যুভাবনার অন্তরঙ্গতা তখন বোঝা যায়
যখন জন্ম তারিখ ঠুকরে ঠুকরে খায় জন্মদাতাই।
কাচামিঠা আমের কথা ভাবলেও মুখে টক রস আসা টিফিন ব্রেকটাকে দেখতে পাই না। আরোও টের পাই না দাঁত বের করা ইটের দেয়ালের পাশে গা ঘেঁষাঘেঁষি তোমার নিয়মিত এটেন্ডেণ্টস। তোমার হয়ে কে যেন 'উপস্থিত স্যার' বলে দিয়েছে।
ছুটির ঘন্টা কোনমতে দেড় মিনিট বাজতেই হুড়মুড় করে বের হতে গিয়ে সব রাফখাতা কাদায়। কাদাভর্তি খাতা নিয়ে স্যারের রুমে তলব। শাস্তির সময়টুকু আমি সামনে ছিলাম না। বারবার দেখতে পাচ্ছিলাম তোমার চোখের কোণ তিরতির করছে। নিমীলিত। খাতা ফেলে দেবার জন্য নয়, আমাকে না দেখার অন্যমনস্কতায়।
যে বাহানা আলোছায়ার কুঁচিদার আহ্লাদ মেখে বারান্দার পাঁচিলের পিছনে ইট দিয়ে উঁচু করা জায়গাটাকে এসে দাঁড়াতে, তার পিছনেই কচি কচি ঝুলে থাকা ছটফটে সজনেগুলো গাছে বসে বেদম মাথা নাড়তো। পাশের সরু পায়ে চলা পথটা তখন খাঁ খাঁ করতো, 'ঠিক দুপ্পুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা।' মধ্যদুপুরের নম্রবাতাসে এই পাতাবিহীন সজনেগুলো দেখে ভয় পেতাম মাইরি।
আমি ভাব করতাম কিছুতেই শিসটা শুনতে পাচ্ছি না । অথচ পাতার এই শিস শুনতে গিয়ে দুপুরে না ঘুমিয়ে বুবু'র আলতা পায়ে দিতে গিয়ে একগাদা ঢেলে ফেলেছি মেঝেতে। আবার মেঝে ঘষতে গিতে মায়ের টাঙ্গাইলের জরিপাড়টাকে অল্প বয়সেই আত্মাহুতির ব্যবস্থা করে রেখেছি । মা যেন টের না পায় তাই তাকে চালের প্রায় খালি ড্রামের ভেতরে চেলে ফেলে দিয়েছি। মা তো আর অত চালাক না, বুঝবে না। ড্রামটাতে তেমন চাল কেন ছিলো না যে! মা খুব ভাতের ফ্যান খেতেন লবণ কাঁচামরিচ দিয়ে।
বেবাক উচাটনের কারণটা আমি জানি আর টিয়াটা জানে, সে গোটা বারান্দায় একাই ঝোলে। আমি বারবার ছোলা খাওয়াতে বারান্দায় আসি আর টিয়া তীক্ষ্ম শিস দেয় যে 'এখনই তো খেলাম বুন্নু!’
ফেয়ারওয়েলের দিন মাধ্যমিকের শেষ তারিখ থেকেই শুরু হলো চিরকুট। কোনটা চারকোণা, কোনটা তেকোণা । না বেলতে জানা তেড়াব্যাঁকা রুটি চেহারার পাতা ছেঁড়া প্রেম।
নিরঞ্জন স্যর রিহার্সেলে তোমার বিদ্ঘুটে কন্ঠ শুনে কিম্বা না শুনেই একাগ্র নিদ্রায় ‘আহা’ বলেছেন কি বলেননি, তুমি মহানন্দে আরেকটা নজরুল শুরু করেছো। ওমনি সাঁই করে চেয়ার থেকে নেমে পড়লেন স্যার। 'আজ থাক। ঘুমটা বেশ করে টুটিয়ে দিলি।'
সন্ধ্যায় একশ গোলাপ হাতে
তুমি চোখের সামনেই। আমি শ্বাসহীন মৃত্তিকা।
‘ঠিক পাঁচ মিনিটের গান, পাঁচ মিনিট দাঁড়াবে পাখি?’
পাঁচ মিনিট কি পাঁচ ঘন্টা যে দাঁড়িয়ে আছি! উঁকি মেরে মেরে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে ঠসা পড়ে গেছে, তা চেপে গেলাম আবহাওয়া সংবাদের মতো। কন্ঠে সুর তেমন ছিলো না। বড্ড মন ছিলো। আমি বহুকাল থেমে ছিলাম টুকরো টুকরো বেসুরেই।
‘ঠিক পাঁচ মিনিটের গান, পাঁচ মিনিট দাঁড়াবে পাখি?’
পাঁচ মিনিট কি পাঁচ ঘন্টা যে দাঁড়িয়ে আছি! উঁকি মেরে মেরে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে ঠসা পড়ে গেছে, তা চেপে গেলাম আবহাওয়া সংবাদের মতো। কন্ঠে সুর তেমন ছিলো না। বড্ড মন ছিলো। আমি বহুকাল থেমে ছিলাম টুকরো টুকরো বেসুরেই।
গানটুকু শুনেই পলাতকা। গোলাপ আর নিইনি । এতটা ঘ্রাণ কোন প্রান্তরেই
লুকানো যেত না । তোমার তটস্থ চোখ সারাটা সন্ধ্যা সিঁড়িটা পাহা্রা দিলো শুধু একটা
বিরতিহীন চুমু দেবে বলে, সেই একটাই।
নিজেকেই খুঁজি । লুকিয়ে রাখার অছিলা জানি। এ যেন এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যাবার মধ্যে
বাদাম কিনতে নেমে পড়ার পর, আচমকা পায়ে আটকে যাওয়া
সাতচারা গুটি যাকে শৈশবে ধার ঘষে গোল বানিয়েছি হেলায়।
শেষ অব্দি তোমার মা সব টের পেয়ে গেলে তুমি
নজরবন্দী। জাঁদরেল পিতা এক দুপুর বরাদ্দ করে আচ্ছাসে ঠেঙালেন তোমাকে সভ্যতা
শেখাতে। তুমি চিরতরে সভ্য হলে। বিনা জৌলুসে কিসের বিক্রয়!
শেষ চিরকুট যেটা লিখছিলে তা
আর আমি পাইনি। হ্যারিকেনের মৃদু চোখের জলেরা চিকচিক করে। আমি আলতো
করে আলো কমিয়ে দিই। চোরধরা ইঁদুরের কলে ইঁদুরের বদলে আটকে গেছে আঠারো বছরের দীর্ঘশ্বাস।
বেদম মারের পর তুমি তখন অপরিচিত। আমি রইলাম সিলেবাসের বাইরে। হাসপাতাল
এবং ভিটামিনের দূরদর্শিতায় আমার রাফখাতা ফেলে গেলে একগাদা হুইসেলে্র মাঝে। ম্যলাদিন পর্যন্ত আমি কেবল ঝিকঝিক আওয়াজ শুনে ঠায় বসে থেকেছি।
বছর পঁচিশেক পর হঠাৎ এক ভোরে
ফোনের শব্দ। চেনা ভঙ্গিতে ডাকছে। এত ভোরেই কি ডাকতো! ফোনের রিংটোনটা আমার ঘর
পর্যন্ত আসতে পারছে না, নো ম্যান'সল্যন্ডে আটকে গেছে। যাক গে। আমি কফি বানাতে চল্লুম।
হেজেলনাট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন