শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

‘যেযালসেহরা’ বা বাংলা প্রবাদের রাজনীতি সমাজনীতি





বহুদিন ধরে ভাবি প্রবাদ বা সুভাষিতর রাজনৈতিক বা সমাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে ভাবার অবকাশ কম নয়। দ্রাবিড়ভূমিতে থিরুভাল্লুভারের লেখা থিরুক্কুরাল থেকে আসা অনেক সুভাষিতই সব কটি  রাজনৈতিক দলের দিগ্‌দর্শক হিসেবে কাজ করে। উত্তর ভারতে সে রসদের ভাঁড়ার ছিল তুলসীদাসের রামচরিত মানস। আমাদের এখানেও কৃত্তিবাসী রামায়ণ কতকটা  সুভাষিতর যোগানদার। বাকির কিছুটা আসে ভারতচন্দ্র থেকে। তার পরে আছেন আমাদের গেঁয়ো অনামা, অজানা দার্শনিকরা। তাঁদের যোগান দেওয়া প্রবচনগুলি স্বাভাবিক কারণেই অনেক বেশি সেকিউলার। একটা বাংলা প্রবাদ ধরা যাক যার  উৎস রামায়ণ কাহিনী — ‘যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’। অর্থাৎ স্বর্ণলঙ্কায় গেলেই সবাই রামত্ব হারান। শাসকের বিচ্যুতিকে বৈধ করার ক্ষেত্রে এই প্রবাদটির মত কার্যকর প্রকৌশল বোধহয় আর দুটি নেই। সব চেয়ে সুবিধে হলো এই বৈধীকরণ আসে শাসকের উদ্যোগ ছাড়াই, শাসিতের কাছ থেকে, স্বতঃ। কেন বলি।

আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন কংগ্রেস আমলে, যথা নেহরুর সময়কার নির্দেশনা / অনুজ্ঞার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতির (ইংরেজিতে ‘কম্যাণ্ড পলিটি, তথা ‘কম্যাণ্ড পলিটিক্স’-এর) সাধারণ পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের একক-প্রাধান্যশীল-দল ব্যবস্থা থেকে দাবি-রাজনীতির তথা ‘ডিম্যান্ড পলিটিক্স’-এর লক্ষণাক্রান্ত  কংগ্রেস-ও, কংগ্রেস-আর, ম্যয় কংগ্রেস-আইএর সময়কার  রাজনীতি থেকে জনতা আমল, ন্যাশন্যাল ফ্রণ্ট, ইউনাইটেড ফ্রণ্ট, এনডিএ ১/২/৩, ইউপিএ ১ ও ২ আমলে নানা স্ক্যাণ্ডাল, স্ক্যাম, ঘোটালা, কেলেংকারি আমাদের রাজনীতিকে বর্ণিল করেছে। হরিদাস মুন্দ্রা, ধর্মতেজা ও জয়ন্তিয়া শিপিং কোম্পানি, বোফর্স হাউইট্‌জার,  কার্গিল কফিন কেলেংকারি থেকে শুরু করে কোলগেট হয়ে টুজি স্পেকট্রাম অবধি একমাত্র বোফর্স ছাড়া আর কোনো স্ক্যাণ্ডাল, স্ক্যাম, ঘোটালা, কেলেংকারি যে কেন্দ্রে সরকারকে টেনে নামায়নি তার কারণ হয়তো এই যে ‘যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’ নামক বাংলা প্রবাদের অধঃশায়ী মনোভাবের অখিল ভারতীয়ত্ব। রাজীবকেও নামাতো না যদি সেই সময়ে দুই সংখ্যার মুদ্রাস্ফীতি না হতো। আর কে না জানে ভারতবর্ষে দুর্নীতি-সহিষ্ণুতার তুলনায়  মুদ্রাস্ফীতি-সহিষ্ণুতা অনেক কম, যতই কেন তা অর্থনৈতিক বিবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হোক।  

আর এই একই কারণেই বোধহয় উত্তর ভারতে উত্তর প্রদেশে মুলায়মের ও পরে তাঁর জাত শত্রু মায়াবতীর জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন স্ক্যাম, পরে মায়াবতীর তাজ করিডর স্ক্যাম, পূর্ব ভারতে লালুর গোখাদ্য, দক্ষিণ ভারতে জয়লক্ষীর শাড়িধুতি, ইত্যাদি অজস্র স্ক্যাণ্ডাল, স্ক্যাম, ঘোটালা, কেলেংকারি তাঁদের আসন টলাতে পারেনি। অথবা বিভিন্ন কারণ সন্নিপাতে তাঁরা সরে গেলেও অন্যতর উপায়ে ফিরে এসেছেন। আমাদের বঙ্গভূমিতেও হলধর পটলের নামাঙ্কিত ভূষিমাল, সঞ্চিতা, সঞ্চয়নী, ওভারল্যান্ড, ভিখু পাসোয়ান, মণীষা মুখার্জিকে নিয়ে নানা সত্যিমিথ্যে ঘোটালা থেকে শুরু ক’রে শ্রীরামকৃষ্ণপত্নী, দেবর্ষি ইত্যাদির নামাঙ্কিত সারদা, নারদা স্ক্যাণ্ডাল, স্ক্যাম, ঘোটালা, কেলেংকারি হয়ে টেট ইত্যাকার স্ক্যাণ্ডাল, স্ক্যাম, ঘোটালা, কেলেংকারি সেই সময়কার ক্ষমতাসীন দলের আসন টলাতে পারেনি একের পর এক ইলেকশনে। খুব সম্প্রতি নারদাতে ক্ষমতাসীন দলের ত্রয়োদশ অশ্বারোহীকে যতই টান মারুক  সিবিআই,  শিক্ষিত উচ্চবর্গীয়  বাঙালি হাতের কাছে ইলিশের বাটি, বিয়ারের বোতল অথবা হুইস্কি/ভদকার পেগ টেনে নিয়ে বলে ‘জমে গেছে’। আর যুগযুগান্তর ধরে উচ্চবর্গের অন্যায় শাসন, শোষণ, ব্যভিচার, অনাচার, চুরি-জোচ্চুরি দেখে দেখে গা-সওয়া নিম্নবর্গ তার সাঙ্কেতিক মন্ত্র বলে যেযালসেহরা 

দেখুন, বামফ্রণ্ট-কে রাজক্ষমতা থেকে শত্রুদের সরাতে লেগেছে ঘোটালা নয়, সিঙ্গুর, রিজোয়ান, নন্দীগ্রাম ইত্যাদি প্রশ্নে ভুল ইস্যু-ম্যানেজমেণ্ট। এর মানে একটাই। ‘যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’ নামক প্রবাদ ভোটারদের আণ্ডশাসকদের অজস্র স্ক্যাণ্ডাল, স্ক্যাম, ঘোটালা, কেলেংকারি  সম্পর্কে ক্ষমাস্নিগ্ধতা অটুট রেখেছে।

কিন্তু ‘যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’ প্রবাদটির মধ্যে বিভিন্ন শাসকদের স্ক্যাণ্ডাল, স্ক্যাম, ঘোটালা, কেলেংকারি ছাড়াও আরেকটা ব্যাপার আছে। সেটা হলো কেন বা কী কী কারণে বিভিন্ন দেশে শাসক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয় পরে সেগুলো রাখতে পারে না, কিম্বা আরো  সিরিয়াস কথা হলো চায় না। এক কথায় কেন দলগুলি ক্ষমতায় আসার পর ‘পলিসি ডেলিভারি’ করতে  পারে না বা চায় না। ফলে লঙ্কায় যাওয়া মাত্তর রাবণ হয়ে যায়। আর জনগণও এ ব্যাপারে শাসকদের চাপ দিতে চায় না।  ফ্র্যাঙ্ক ক্যানিংহ্যাম তাঁর ডেমোক্রেটিক থিওরি অ্যাণ্ড  সোশ্যালিজম  বইতে শাসক-শাসিতের এবম্প্রকার  ঔদাসীন্য বা চ্যুতিকে ব্যাখ্যা করতে দুটি ধারণার আমদানি  করেছেন। প্রথম এবং মুখ্যটি হলো  স্বতঃরফা/স্বয়মাপোষ বা ‘autocompromising’, আর দ্বিতীয় ও গৌণটি হলো বিনটিকিটে চড়ন তথা ফিরিভোগ বা  ‘freeriding’

আমরা প্রথমটাকে নিয়ে ভাবিত। এটায় ক্যানিংহ্যাম বলছেন যে, রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন কীভাবে  বিভিন্ন প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলের কার্যলক্ষ্য তাদের মূলস্রোতের অনুসারীদের প্রথম পছন্দের সঙ্গে মেলাতে পারে না। প্রত্যেক দলের নীতিপ্রণেতারাই ভয় পায় যে যদি না দল প্ল্যাটফর্মের মধ্যিখানটাকে রূপায়নের জন্য আঁকড়ে ধরে তবে অন্যান্য দলগুলিও এই স্ট্র্যাটেজিই নেবে, আর পরবর্তী নির্বাচনে এর ফায়দা কুড়োবে। ফলে কোনো দেশের সমগ্র রাজনৈতিক বর্ণালীর সম্পূর্ণ  ডাইনে, মধ্যিখানে, বা একেবারে বাঁয়ে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দল দক্ষিণী- র‍্যাডিক্যাল, বাম-র‍্যাডিক্যাল বিভিন্ন ইস্তেহার বা প্ল্যাটফর্ম নিয়ে নির্বাচনে নামে। কিন্তু জেতার পর মধ্যপন্থী হয়ে যায়। কারণ তাদের ভয় হলো এই মধ্যিখানটাতেই সব চেয়ে বেশি  সমর্থক, আর তারা একে না ধরলে অন্যরা ধরবে। 
তাছাড়া সব দলই ভয় পায় যাতে ফ্রিরাইডাররা সরকারি দাক্ষিণ্যের সুযোগ না নিয়ে চলে যায়। এর ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে সেটি হলো যেই নির্বাচনে জিতুক না কেন সেটা কারুর প্রথম পছন্দের প্ল্যাটফর্মে হবে না। নিজেদের সদস্যদের প্রাথমিক নীতিমান, মূল্যবোধ, পছন্দ বা লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটায় এমন প্ল্যাটফর্ম অনুসরণ করার চেয়ে প্রত্যেক দলই অনিশ্চয়তার মধ্যে আগাম আপোষ করে বসবে। এই সমস্যাটা কতকটা গেমতত্ত্বের ‘কয়েদির উভয়সঙ্কট’-এর মতো।  সেখানে পরস্পর সংযোগহীন দুই কয়েদি, একে অন্যের  প্রতি অবিশ্বাসের কারণেই সরকারি উকিলের কাছে কৃত অপরাধ কবুল বা না কবুল করার ব্যাপারে খুব সীমিত বিকল্প পায়।


ফ্র্যাঙ্ক ক্যানিংহ্যাম দেখিয়েছেন এই  স্বতঃরফা / স্বয়ংআপোষ বা ‘autocompromising’  সব চেয়ে বেশি প্রবল কোনো দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায়। কারণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর এদের যে দ্বৈত প্রভাব থাকে তার ফলেই এদের উপর ভোটারদের নিয়ন্ত্রণ থাকে কম। ফলে যেযালসেহরা’-র আক্ষেপে তারা অংশগ্রহণ না করে ‘freerider’ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলির দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহিপ্রবণতা বাড়াতে গেলে আর তাদের স্বতঃরফা / স্বয়মাপোষ কমাতে গেলে বহুদলীয় ব্যবস্থাই শ্রেয়, কারণ ছোট ছোট দলগুলির উপর ভোটারদের নিয়ন্ত্রণ আর তাদের লঙ্কার রাবণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কম। এত কথা এলো ওই একটি প্রবাদ থেকে, যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণপ্রবাদগুলি সামাজিক রাজনৈতিক জ্ঞানের স্বর্ণখনি। নয়? 


গ্রন্থসূত্র



1.   Frank Cunningham, Democratic Theory and Socialism (Cambridge: Cambridge University Press, 1987), pp. 62-33       




1 টি মন্তব্য: