শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

মৌসুমী মণ্ডল দেবনাথ

নীলপরী

লাশকাটা ঘরে একা শুয়ে নীলপরী মেয়ে
তার নিথর তুষারপাতের চোখ জেগে ওঠে,
চারদিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়
এই ঘরে কোন জানালা নেই,
শুধু আছে বেরিয়ে যাওয়ার দরজা
আর আছে শীতল বরফের ঘ্রাণ
অনন্ত কফিনের কাঠে  স্বর্ণচাঁপা ফুলের সুবাস
আহা, মৃত্যুতে এত শান্তি যদি আগে জানতো!
সেই ঝড়ের রাত, মনে পড়ে যায়
যে রাতে স্বামী তাকে অ্যাসিড পান করায়
হয়েছিলো নীলবর্ণ দেহমুখে পোড়া দাগ,
শুকনো ঠোঁটে কত্তদিন ক্রিম জোটেনি।"
— "তা হোক, তবু তুমি আমার মনের মানুষ,
তুমি আমার নীলপরী।
তুমি নেক্রোফিলিয়ার মানে জানো?
জীবিতের সাথে মৃতের প্রেম।
কাল সকালের সোনালী আভায়
তোমায় উড়িয়ে দেবো স্বর্গের পানে।"

জীবিত ও মৃতের কথোপকথনে
মৃত কন্যার ঘুম ভাঙে একসময়
টিউলিপ ক্ষেতে মৃদু বাতাস বয়ে যায়
ঈশ্বর চোখ বন্ধ করেন
ডোমের ষড়ঋতুর চোখে নেচে ওঠে
নটরাজের অবধারিত শতপুষ্পের/ শৃঙ্গার রস-মুদ্রা
নীলপরী উড়তে থাকে
                  উড়তে থাকে
                        উড়তে থাকে


নিহত দিন

মহাকাল নামের মেয়েটা চোখ মেলে দেখতো সমুদ্র উপচে পড়ছে
অন্ধকার ও আলোয়।
কোনও এক হৈমবতী রাত শেষের ভোরে জন্মেছিলো সে।
পাখিদের জাদুলন্ঠন জ্বলছিলো আঁতুরঘরে।
ওর শিশু মনের ওষ্ঠাধারে ছিলো চন্দনের চেয়েও মূল্যবান কোন পবিত্র সুগন্ধী। 
ফুলেরা, জ্যোৎস্না কণারা হেরে যেতো ওর জোনাকি
হাসির কল্লোলে।
ঝাপসা বৃষ্টিরা সারাটা দিন বন্ধ করে রেখেছিলো, রোদ্দুরের আরশিমহলের দরোজা।

এই ভ্যাসভ্যাসে গরমে স্কুল না ফেরত মেয়েটি চিত্ হয়ে শুয়ে আছে
জুঁইরঙা চাদর গায়ে।
হরিণীর মতো টানাটানা চোখগুলো আধখোলা, বিস্ফারিত।
ঠোঁটের কষ্ বেয়ে কখনো নেমেছিলো তাজা লাল লোহিতের ধারা।
শুয়ে আছে গরমের লাশকাটা ঘরে
আরও কিছু নাম গোত্রহীন লাশের সঙ্গে।
একজন অপরিচিত লাশ জিজ্ঞেস করে,
এই মেয়ে তোমাকে নাকি ফেলে গিয়েছিলো
কাশবনের ঝোঁপে?
তোমার কি কোন সুরাহা হলো?
না, এখনো হয়নি। 
তবে, ফাইল তৈরী হয়ে গেছে।
হয়ে যাবে নিশ্চয়।
এটা আমার প্রথমবারের মতো
কাশবনে, শরতের মেঘ দেখা জানো?
সে কি অপরূপ বহুমুখী দৃশ্য! আহা!
এই মেয়ে, তুমি কি ক্লারা জেটকিনের
কথা জানো না?
পড়োনি মারিয়া কারেলিনা দে হেসুসের লেখা বিপ্লবী কবিতা
কেন,বিপ্লবী হতে পারলে না?
না পারিনি।
তবে আমার ঐ নিহত দিন
অনেকের রেটিনায় বুনে দিয়েছে শব্দহীন মোম আলোর বিপ্লবী বীজ।


অভিসার

বিস্মৃতির  সুদীর্ঘবেলায় সব আশাই যখন জলের মতো তরল, তখন অরণ্যে আঁকা বৃক্ষগুলোর ঘন যাপনের পথ ভেঙে উদাস গ্রীষ্ম হেঁটে আসে স্থুল শব্দে, রাঙা ধূলো উড়িয়ে। লাবণ্যের মাধবীলতা শাড়ির আঁচলে বুনো নিঃশ্বাস নাচে আর সাতখানা ধনেশ পাখি বসন্তের ছেড়ে আসা হলুদ আলোয় উড়ে যায় জয়ন্তীয়া পাহাড়ের দিকে। রামধনুর রঙেরা পঞ্চভূতে লীন হওয়ার অনুভূতিতে সদ্য অধ্যয়ন সাঙ্গ করে আকাশপথে ভিড় করা মেঘরাশিকে সরিয়ে এক অম্লান গৃহস্থ আলো অমিতের পাইন কাঠের জানালায় পাঠায়। ওহে প্রেমাষ্পদ তোমার অনিচ্ছুক শিশিরভেজা পায়ের ছাপ অই পথের তণ্বীদেহে ফেলো না। 
বার্মিজ ছাতার অ্যাম্ব্রয়ডারি ছাপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে বিকেলের পাহাড়ি শহরে। ফার্নেরা পরেছে চকচকে মেখলা -চাদর। শোন ক্যামেলিয়ার ঝোপ যদি না পারো করতে শাপমোচন, তবে অধরে আঁকা দেবদারুর নীড়ে ঢেকে রেখো না সূর্যাস্ত। শেষের সেই
কবিতা যেন অন্যরকমের এক গোলাপ ফুল, তার শব্দকোষে প্রাণের সমান এক সমুদ্র আছড়ে পড়ছে ঝাউবনের ধারে।

বৃষ্টিতে ভেজা গানগুলো যখন নন্দিত হয়, পিয়ানোর অষ্টআশি সাদা-কালো রিডে তখন সেইরাতেই অমিত-লাবণ্য একই জানালা ভাগ করে দেখেছিলো জ্যোৎস্নায় চন্দ্রবোড়ার সঙ্গমরত নৃত্য। শুধু ওরাই জেনেছে রাতের পিছনের বেদনায় বেহাগ কতবার বাঁশি হয়ে বেজেছে রক্তকরবীর সাজে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন