ঠোঁট
রাত আটটা বাজার মিনিট খানেক আগে
ফোনে খবরটা পেলাম। খবরটা রিয়ানাই দিল। ‘সি পাস্ট অ্যাওয়ে!’ আমি জানি। তিন ঘন্টা
আগেই জেনেছি। ওঁর
ম্যাজেন্টা লিপস্টিক মাখা ঠোঁটজোড়া চোখের সামনে ভেসে উঠলো আবার।
আমরা যতক্ষণ ছিলাম উনি সাদা
দেয়ালটার দিকেই অপলক তাকিয়ে ছিলেন। আমরা ছ’জন গিয়েছিলাম। আমি ছাড়া অন্যেরা আগেও
একবার গিয়েছিল। খবরটা যেদিন শুনি সেদিন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল। মাত্র মাস
খানেক আগে মলে দেখা হয়েছিল। সেইল চলছিলো ‘ক্রিস্ট্যাল হাট’এ। এক জোড়া নীলচে সাদা টিয়ার
ড্রপ' দুল খুব মন কাড়লো। সত্তর ডলার দাম। আমার বাজেটের অ-নেক দূরে। রেখে দিতেই পাশ
থেকে কেউ বলে উঠেছিল, ‘পছন্দ হয়নি নাকি দামে মেলে নি?’ চোখ তুলেই দেখি তিনি।
সপ্তাহ্ খানেক পরে এক দুপুরে সেই
দুল জোড়া আমার নামে পার্সেলে এসেছিল। কোন উৎসব বা বিশেষ দিন ছিল না আমার। খুব অবাক
হয়েছিলাম। ফোন দিয়েছিলাম, ‘আমাকে কেন?’ উনি হেসেছিলেন, ‘মন চাইলো তাই’।
আজ হাসপাতালে
ওঁর মেয়েকে দেখলাম। ত্রিশের ওপারে হবে বয়স। নাম কৃস্টা। এর আগে আমি কৃস্টাকে
মুখোমুখি দেখি নি তবে ছবিতে দেখেছি। ওঁদের লিভিং রুমে বাঁধাই করা বড় একটা
পারিবারিক ছবি আছে। ও নিউইয়র্কে থাকে। বেশ বোঝা যাচ্ছিলো কৃস্টা আমাদের এত জনকে একসাথে দেখে মোটেও
খুশি হয়নি।
ওঁর স্বামী বিছানার কাছে ওঁর
হাত ধরে বললেন, ‘নিভা দেখ কারা এসেছে?’ ঠিক সেই সময়েই কৃস্টা ‘এক্সকিউজ মি’ বলে
বাইরে চলে গেল। রিয়ানা পাশ থেকে বিড়বিড় করেছিল, ‘দ্যাট ইজ সুপার রুড’। উনি দেয়াল থেকে চোখ সরাননি। ওঁর মুখে হালকা মেক-আপ । কিন্তু ঠোঁটে
ক্যাটক্যাটে ম্যাজেন্টা লিপস্টিক; ভীষণ চোখে লাগছিল। সম্ভবত কৃস্টাই
সাজিয়েছে অথবা নার্স। উনি স্বেচ্ছায় এমন রঙ পরতেই পারেন না। এখানে অসুস্থ অনেককে
দেখেছি হাসপাতালের বেডে পার্টি সাজ নিয়ে শুয়ে থাকতে, তাতে নাকি অসুখের মনমরা ভাবটা
ফিকে হয়। ওঁকে দেখে আমার উল্টোটা মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল জীবন ক্লাউনের মত
ম্যাজেন্টা লিপস্টিক হয়ে ভেঙচাচ্ছে।
ছোট টেবিলটায় ওঁর দিকে ঘুরিয়ে
আই প্যাড বসানো। তাতে
উমরাওজানের ‘ইন আঁখোকি মস্তি’ বাজছিল। ওঁর স্বামী নিচু স্বরে জানিয়েছিলেন আধ ঘন্টা ধরে ওভাবে
দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে আছেন। তাই মনোযোগ কাড়তে এই গানটা দিয়েছেন। ওঁর প্রিয় গান। রিয়ানা
কাছে গিয়ে ওঁর হাত ধরে প্রার্থনা করলো। মুখে বললো, ‘জিসাস আছে তোমার সাথে’। উনি শুনলেন
কিনা বোঝা গেল না।
এত উন্নত দেশ তাও ডাক্তারেরা কিছুই
ধরতে পারেনি। বছর বছর শরীরের কল কব্জার পরীক্ষা করাতেন নিয়ম করে। রশিদ
খানের কন্সার্ট ছিল সপ্তাহ্ দুয়েক আগে। সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে যান। সুগার ফল করেছিল। সব চেক আপ
করাতে গিয়েই ধরা পড়ে লিভার থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। লাস্ট স্টেজ। কেমো দেয়ারও
উপায় নেই। কেবল ব্যথানাশক দিয়ে সাময়িক উপশমের চেষ্টা আর দিন গোনা।
আমার চোখ বার বার আটকে যাচ্ছিলো
ওর উজ্জ্বল ম্যাজেন্টায় রাঙানো ঠোঁটে। মুখটা দৃষ্টিসীমা থেকে জোর করে কেউ যেন
ব্যাকগ্রাউন্ডে সরিয়ে দিচ্ছিলো। আমরা কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মাঝে মাঝে রিয়ানাই একটা
দুটো যা মনে হয় বলছিলো। হঠাৎ উমরাওজানের গানটা আমার কানে ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে।
শব্দ বাড়িয়ে দিল কি কেউ? আই প্যাডে কি ভিডিওটাও চলছে? আমি উলটো দিকে দাঁড়িয়ে, দেখা
যাচ্ছিল না। উমরাওজান
আমার বেশ ক’বার দেখা। গানের দৃশ্যটা চোখে ভাসছে। ঠিক দেখতে
পাচ্ছি রেখা ভ্রূ উঁচু-নিচু করে হাত ঘুরিয়ে ফারুখ শেখের সামনে নাচছে ‘আঁখো সে
পিলাতি হে’। আমার
চোখ চলে যায় আবার ওঁর ঠোঁটে। লিপস্টিকের রঙটা হঠাৎ চেনা লাগে বড়। সেই ঠোঁট!
কানের কাছে বাজে, ‘মেরা দিল তড়পা কিসিকি নযর কি লিয়ে’। ‘মুকাদ্দার কি
সিকান্দার’! ঠিক এই রঙের পোশাক আর ঠোঁট রাঙিয়েছিল রেখা। আশ্চর্য ওঁর ঠোঁট দুটো কেমন
রেখা হয়ে গেল নিমেষে!
আমি মনে মনে ধমকাই নিজেকে, কী
হচ্ছে!
কানে সেই দুল জোড়া পরে
এসেছিলাম। রিয়ানা বা অন্য চার জন জানে না এটা ওঁর দেয়া। আমি আজই প্রথম পরলাম। কাছে
গিয়ে হাত ধরি। কী ঠান্ডা হাত! ফিসফিস করে বলি, ‘তোমার দেয়া দুলটা পরেছি’। হঠাৎ মনে হ’ল হাতে
হাল্কা চাপ। বিদ্যুৎ বয়ে গেল শরীরে আমার। আমি ভালো করে মুখের দিকে তাকালাম। মুখ নয়
ঠোঁট জোড়ায় মৃদু হাসি ভেসে উঠলো যেন। আমি রিয়ানার দিকে ফিরলাম সাথে সাথে। ও ইশারা করছে
উঠে পড়তে।
দরজা দিয়ে বেরুবার সময় ফিরে
তাকিয়েছিলাম।
হাসিটা তখনো আলগা হয়ে ভাসছে ওপরে, ‘মেরা দিল বেচইন হে হামসফর কে লিয়ে’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন