বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

একুশে সেপ্টেম্বর


“কনগ্র্যাচুলেশান এন্ড হ্যাপি অ্যানিভারসারি”

রাত তখন ন’টা। মোবাইল মেসেজটায় চোখ রাখতে গিয়ে হোঁচট খেল নম্রতা।  সৌমেনের প্রথম মেসেজ।

অ্যানিভারসারি! কীসের? ক্যালেন্ডারে চোখ রাখল নম্রতা। একুশে সেপ্টেম্বর। পায়ের নীচে নাকি মাথার ভেতর টেকটনিক প্লেটের নড়ে ওঠার শব্দ পেল। 

সৌমেন অফিসের জন্য রওনা হতেই নম্রতার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। এইবার তার যাওয়ার পালা। ব্যাগে দু’একটা জামাকাপড়, একটা তোয়ালে, ব্রাশ,  টুথপেস্ট, সাবান, চিরুনি এবং স্লিপার ঢুকিয়ে কাঁধে তুলে নিল। দরজায় চাবি দেবার আগে একবার চোখ ফেরাল তার পঁচিশ বছরের সংসারের দিকে। সমস্ত হাবিজাবি ছাপিয়ে জেগে রইল শুধু দেওয়ালজোড়া বইয়ের আলমারিটা। পিঠ  থেকে ব্যাগটা নামাল কয়েকটা বই নেবার উদ্দেশ্যে। বই বাছতে গিয়ে বুঝতে পারল কাজটা কত কঠিন। ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকেও দিশা পেল না সে। হঠাৎ মাথার ভেতর বিদ্যুৎ। বইহীন জীবনটাকে একবার চেখে দেখলে কেমন হয়!

বেরিয়ে পড়ল নম্রতা। গন্তব্য শিবাজী টারমিনাস। ওয়েটিং রুমে বসে ঘড়িতে চোখ রাখল। প্রায় বারোটা। চোখের সামনে পড়ে রইল অপেক্ষা। কিন্তু বুঝতে পারল না অপেক্ষাটা কীসের। ব্যাগ হাতড়ে দেখল রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট। তাতে কেবল তারই নাম। তবে কি তার কোথাও যাওয়ার ছিল? কিন্তু সেখানে গিয়ে কী করবে? মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে মানুষের মুখগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে,
-যদি আমার কথামতো না চলতে পারো তবে আমায় মুক্তি দাও নম্রতা, প্লিজ...

হ্যাঁ, মনে পড়ছে এইবার। মুক্তি। মুক্তির কথা ভেবেছিল সে। কিন্তু কার মুক্তি? নিজের না অন্য কারো?

ট্রেনে উঠে নিজেকে আরো একটু গুছিয়ে নিতে চাইল। অথচ চোখ চলে যাচ্ছে জানালার বাইরে। অপেক্ষা শব্দের প্রতিশব্দগুলো হাতড়ে ফিরছে চোখ।  

ট্রেনটা একটু নড়ে উঠতেই প্রবল ধাক্কা খেল নম্রতা। না, ট্রেন ছাড়ল না। ইঞ্জিন জোড়া হলোতলিয়ে যাওয়া অস্তিত্ব থেকে নিজেকে টেনে বের করে চোখ রাখল  প্ল্যাটফর্মে। চোখের সামনে চাপ চাপ কালো কালো মাথা। মুখগুলো এমন অস্পষ্ট কেন? সে কি কোনো মুখের আদল খুঁজছে? মাথার ভেতর দোল খাচ্ছে মুক্তি শব্দের প্রতিশব্দগুলো। হৃৎস্পন্দন মাত্রা ছাড়াচ্ছে।

সবুজ সিগন্যাল। কালো মাথা ছাপিয়ে পরিচিত কোঁকড়ানো চুলের মাথা। অনেকটা দূরক্রমশ জেগে উঠছে বাঁকা ঠোঁটের বাঁদিক ঘেঁষা ছোট্ট তিল। জানালায় রাখা নম্রতার হাতের আঙুলে অস্পষ্ট তরঙ্গ। লাবডুব শব্দের প্রচণ্ড  আর্তনাদে কানটা বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের সামনেটা অন্ধকার।

ট্রেন ছেড়ে দিল। ধীরে। খুব ধীরেজানালার বাইরে থেকে এগিয়ে এল একটা  হাত। নম্রতার আঙুল ধরতে চাইল। স্পর্শ করার আগেই গতি পেল রাজধানী।      

মোবাইল মেসেজের বাকিটায় চোখ রাখল নম্রতা – “এঞ্জয় ইয়োর ফ্রিডাম”


কী উত্তর দেবে ভাবতে ভাবতে নম্রতা টের পেল, সেদিন জানালা থেকে এগিয়ে আসা হাতটা আসলে সে স্বপ্নে দেখেছিল। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন