বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়

তোমার মাঝে




ভাদ্র মাস শেষ হতে  চলল। রাত বাড়লে হাল্কা কুয়াশা। বাষ্পীভূত চশমার কাচ ভেদ করে দেখি সন্ধ্যায় একদল গ্রামের ছেলে এগিয়ে আসছে। সামনে একজন পুরুষ মহিলা সেজেহাতে একটা মাটির পুতুল। দরজা খুলে দাঁড়াতেই ভাদু গান। পায়ের ঘুঙুর যেন তালে বেতালে বেজে যাচ্ছে। পুতুলের নীল শাড়ি। এই সেই ভাদ্রবতী।  ভাদ্র মাসের ধান দেবী । নীলমণির  কুড়িয়ে পাওয়া ভদ্রাবতী না ধান।  কবিরাজি  গন্ধ ভেসে আসে।  অঞ্জনকে ভালোবেসে ভদ্রাবতী  নিখোঁজ, না  বর্ধমানের রাজার ছেলে  ডাকাতের হাতে মারা গেলে সহমরণ ভালোবাসার ত্যাগ আজ হাতে হাতে  ঘুরছে।  কোথায় শোক ভাদু তোমার এই ত্যাগের! 
"তিনটি ভাদু জলকে গেছে কন ভাদুটি আমাদের?
কাথাল বাঁকা ,উলখি -পরা ওই ভাদুটি আমাদের। "
এই গানের কথায় কোথায় সেই বেদনাকেন ঘুরে ফিরছো এ গ্রাম সে গ্রাম।  ধান দেবী সকলের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষাপাত্র হাতে উল্লাসের লোকগীতি হয়ে  বিসর্জনের  এ এক নতুন ঝাঁপ। চাঁদের আলোয় ভাদু অন্তর-ধান  কুড়িয়ে বিধবা কুয়াশা। ঝিম   ইনবক্সে দীপকে লেখাটা পাঠিয়ে লিখল, কেমন রে লেখাটা?’ ‘এই পৌষমাসে  ভাদু   নিয়ে লেখা ব্যাপারটা ঠিক লাগল না’,  দীপের  উত্তর  তুই তো  জানিস আমি বর্ধমানের মেয়ে, এই ভাদু নিয়ে লেখার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল এটা আমাদের রাঢ় লোকউৎসব এতদিন লেখা হয়নি। আজ লেখাটা এলো।  টুসু নিয়ে লিখেছে আমার এক বান্ধবী, ওর লেখাটা পড়ে... বুঝলি!’ ‘তোর  সেই বান্ধবীর কি নাম?’ দীপ জানতে চাইলে ঝিম জানালো,  মৌ’ টুসু, ভাদু গানের কথা আমি শুনেছি  কিন্তু পড়া হয়নি বা এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না রে’,  দীপ লিখে পাঠাতেই  ঝিম ভেংচি পাঠিয়ে লিখল, ‘তা জানবি কী করে, কলকাতার লাট যে, এসব লোক কালচার তো জানার কথা না তোর!  লিখতে গেলে সব পড়তে হয়, আমার গুরু বলে । আমি পাঠাচ্ছি মৌয়ের লেখাটা, পড়িস’

অফিসিয়াল ভ্যালেন্টাইন্স ডেএখনও এক মাস পরে। তার আগে টুসুর মেলায় তারই পরশ। রঙ্গিন টুসু চৌদলের অমোঘ টান আর তরুণ তরুণীদের বিপুল সংখ্যায় জমায়েত বুঝিয়ে দিল, টুসু পরব এখনও সুপার হিট। সরস্বতী পুজো যদি বাংলার  ভ্যালেন্টাইন্স ডে  হয়, তবে গ্রাম-পুরুলিয়ায় ১৪ ফেব্রুয়ারি’-র থেকে এগিয়ে থাকে পৌষ সংক্রান্তি বা টুসু সংক্রান্তি। 
টুসু নামের উৎপত্তি নিয়ে একাধিক গল্প প্রচলিত আছে। ধানের তুষ, শীতের সময় যা জ্বালিয়ে আমাদের গ্রামে গঞ্জে লোকেরা আঁচ পোহায়, সেই তুষ থেকেই টুসু নামটি এসেছে। আবার  দীনেন্দ্রনাথ সরকারের মতে, তিষ্যা বা পুষ্যা নক্ষত্র থেকে অথবা ঊষা থেকে টুসু শব্দটি এসেছে আবার কখনো তিনি বলেছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রজনের দেবতা টেষুব থেকে টুসু শব্দটি তৈরি হয়েছে ।  ফুল বেল পাতা নয়, এই  তুষ দিয়েই  এ পুজার ডালি সাজানো হয়। একে আবার পৌষালী বিজয়া নামেও ডাকা হয় । বলা যেতে পারে, এটাই মানভূমের জাতীয় উৎসব ।

টুসু এক কুমারী কন্যা। এর পূজা করেন কুমারী কন্যারা। আমরা যাদের নিম্নবর্গের  মানুষ বলি সেই তাদের বাড়ির কুমারী কন্যারা। কিন্তু এ পূজার কোনো মন্ত্র তন্ত্র, নেই নির্ধারিত ক্রিয়া-কর্ম , কোনো বিশেষ উপাচারও নেই। অঘ্রাণ মাসের শেষ দিন থেকে পৌষ মাসের শেষ দিন অবধি রাঢ় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে এই টুসু পূজিত হন যেহেতু মন্ত্র তন্ত্র নেই, তাই এ পূজায় কোনো ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয় না।
রং-বেরংয়ের চৌদল নিয়ে জেলার নদীর ঘাটগুলিতে জড়ো হন মেয়েরা। টুসুর গান গাইতে গাইতে নতুন পোশাক পরে দল বেঁধে তাঁরা চৌদল নিয়ে নদীর দিকে যান। তরুণীদের আগ্রহ এক্ষেত্রে দেখা যায় সব থেকে বেশি। মেলায় টুসুর চৌদল ভাসানোর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে হৃদয় দেওয়া-নেওয়ার পালাও। তাও আবার গানে গানে। টুসু উৎসবের প্রধান হল টুসু গান মেলায় আসা যুবকদের দিকে মেয়েরা ছুড়ে দেয় নানা গৃহস্থালি সংক্রান্ত প্রশ্ন। ছেলেরা বান্ধবীকে কীভাবে সুখী করবে, তা নিয়ে পাল্টা জবাব দিতে থাকে। বৌদিরা খানিকটা চটুল প্রশ্নও ছুঁড়ে দেন কুমারী ননদদের হয়ে। বয়স্ক দিদিমা, ঠাকুরমাদের ধরে সেই প্রশ্নের রসিক জবাব দেয় তরুণরা।


এই একটা দিনে আঞ্চলিক যুবক-যুবতীদের প্রকাশ্য মেলামেশায় সাত খুন মাফ। টুসু নিয়ে কুমারীরা নিজেদের পছন্দ মতো মেলার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। নদীর চরে বসে ঝুমুর গায়। আঁকিবুঁকি কাটে। লাজুক চোখে তাকিয়ে দেখে তার গান কতজনকে আকৃষ্ট করছে।
এ তাদের প্রাণের গানের ভাষা আর সে গানে কখনো তাদের টুসু একেবারে আটপৌরে মেয়ে, তাদেরই মতোন

টুসু সিনাচ্ছেন , গা দলাচ্ছেন
হাতে তেলের বাটি
নয়ে নয়ে চুল ঝাড়ছেন
গলায় সোনার কাঠি...

আবার কখনো তাকে নিয়ে গ্রাম্য কোন্দল -
আমার টুসু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝনঝন করে গো
উয়ার টুসু হ্যাংলা মাগি, আঁচল পাইত্যে মাগে গো।
গাঁয়ের মেয়ে যখন শহরে চলে যায় লেখাপড়া শিখতে তখন সে কিছুটা শহুরে হয়ে যায়, হয়তো তার গ্রামের প্রতি টান কমে যায়, তেমনি একটা অভিমানের জায়গা থেকে গান বেরিয়ে আসে -
না রহিবেন গাঁয়ে টুসু যাবেন ইবার শহরকে
আলতা চরণ জুতায় ঢেকে দিবে না পা ডহরকে
গীত গাহিবেন অবাক কলে , পান কিনিবেন দোকান লে
বছর বছর সাধ জাগিলে আসতে পারেন উখান লে
গঙ্গা সিনান , সিনেমা টকি , গড়ের মাঠ আর কালীঘাট
বতর পাইলে লেখাপড়ায় হরেক কিসিম লিবেন পাঠ’
আবার টুসু যেন তাদের প্রিয় সখী, তাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার আহ্বান-
চল টুসু খেলতে যাবো রানীগঞ্জের বটতলা
অমনি পথে দেখাই আইনব কয়লাখাদের জল তুলা
উলোট পালট ফুলুট বাঁশিতে
আমার মন মানে না ঘরেতে ...

আবার এ গানেরই শেষের লাইনে সেই জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার ব্যথা টুসুর কাছে কিন্তু কোনো চাওয়া নেই , রূপণ দেহি , ধনং দেহি নেই , জমিতে ধান না হওয়ার জন্যে কোনো অভিযোগ নেই , বরং তাকে সঙ্গী করেই চলুক জীবন সংগ্রাম
চল টুসু চল টাটা যাবো                                              
ধান হইল না কি খাবো
রোদ বৃষ্টির মধ্যে বনে জঙ্গলে যাদের বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করতে হয় তাদের দেবতাকে তো নেমে আসতে হবে তাদের সঙ্গে বনে জঙ্গলে। তাই টুসুর গানে উঠে আসছে-
‘বড় বোনের লতা পাতা
ছোটো বোনের শাল পাতা
কুন বনে হারালো টুসু
সোনার বরণ লালছাতা
চিড়কা রোদে ধরেছে মাথা’
আবার
ও টুসু বিটির বিহা দিব কেমনে
জামাই পণ করেছে হিরো হোন্ডা দাও কিনে
বলাই বাহুল্য, গানে উঠে আসে সাম্প্রতিকও এবং তাদের গাঁ-ঘরের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শুধু প্রেম বা সুন্দর সংসারের কথাই নয়। মেয়ে হওয়ার দুঃখও উঠে আসে তাদের গানেকখনো থাকে ক্ষোভ প্রতিবাদ, কখনো থাকে দুঃখ বিষাদ। এক মাস ধরে এই মন্ত্রহীন পূজার শেষে মকর সংক্রান্তির দিন ব্যথিত হৃদয়ে তাদের ঘরের মেয়ের প্রাণের প্রতিমাকে তারা বিসর্জন দিয়ে আসে তাদের কাছের কোনো এক নদী অথবা পুকুরে। কোল, মুন্ডা, ওরাওঁ, সাঁওতাল, ভূমিজ, ভুঁইয়া, কুর্মি, মাহাতো,বাউরী বাগদী মহিলারা এই পুজো করেন। কিন্তু আশ্চর্য লাগে এই ভেবে, গোটা পূজার্চনার  ব্যাপারটা পরিচালিত হয় এই শ্রেণীর মহিলাদের দ্বারা আর এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ এই মেয়েদের তাৎক্ষণিক ভাবে রচিত রচিত গান। নতুন ফসল ঘরে  আসার খুশি উদযাপনের এর চেয়ে সুন্দর রূপ আর কী বা হতে পারে!

ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপের যুগেও এতটুকুও ম্লান হয়নি পুরুলিয়ার টুসু উৎসব। এক হাতে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল আর অন্য হাতে রঙ্গিন চৌদল নিয়ে পুরুলিয়ার তরুণীর গলায়
যাব টুসু মিতের কাছে থাকবি শুধু তুই
খেলব ভালবাসার খেলা আঁকড়ে ধরে ভুঁই’
দীপ : হুম পড়লাম,  পড়ে তো খুব ইচ্ছে হচ্ছে একবার টুসু দেখতে যেতে, যাবি সামনের বছর?’  
 ঝিম সম্মতি সূচক  বুড়ো আঙ্গুল পাঠিয়ে দেয়।  ‘তোর সাথে তো যেতে পারি বহুদূর। প্রতিদিন তোকে দেখতে ইচ্ছে করে আমার তো  ইচ্ছে করে টুসু কুমারীদের মতো সবার সামনে নির্বাচন করি তোকে’
ঝিম ও দীপ লেখালিখি করে বলতে গেলে দুজনেই নতুন কলমে আঁচড় কাটছে।  তবে দীপ তার মধ্যে ভালোই নাম করেছে কবিতায়বেশ স্ট্রং কবির তালিকায়  বলা যেতে পারে। ফেসবুকেই পরিচয় দুজনের  এখন যে যা লেখে একে অপরকে সবার আগে পড়ায়, মতামত নেয়ঝিম দীপের মতো নাম না করলেও দীপের কাছে  ঝিমও ভালো লেখেদুজনের বন্ধুত্ব লেখা ছাপিয়ে বিশ্বাসের, আস্থা, একে অপরের  মানসিক সাপোর্ট, বোঝার  জায়গায় এতটা দৃঢ় যে দুজনের মধ্যেই যেন এক অলীক বন্ধন।  ম্যাসেঞ্জারে দুবার ভিডিও কলিংএ দেখা করেছে ঠিকই কিন্তু সামনাসামনি দেখা হয় নি তাতে দীপ ও ঝিম কেউ কোনো দিন প্ল্যানও করে নি দেখা করবে বলেযদিও এমন কিছু দূরত্বে থাকে না -  ঝিম বর্ধমান আর দীপ কলকাতাএই শারীরীক উপস্থিতির দেখা করার চাহিদা যে কারোর নেই তা বললে ভুল বলা হবে,   তবে কেউই সেভাবে সময় করে উঠতে পারে না নিজেদের অফিসের কাজে
দীপ: কিরে চুপ করে আছিস যে বুড়ো আঙ্গল দেখিয়ে’ঝিমের ঘোর কাটে : বল’  ঝিম  :  জানিস আজ কত তারিখ!’  দীপ : হুম আজ ১৩ ই ফেবরুয়ারী’  ঝিম   : ‘বল তো  আজ কি ডে?’ দীপ : জড়িয়ে ধরার দিন’ ঝিম :  ‘ছিঃ এভাবে বলে নাকি,  Hug day বা আলিঙ্গন করার দিন বল’ দীপ  : ‘ওই একই তো কথা’ ঝিম :   ‘তুই তো কলির কেষ্ট, তো কে কে তোকে জড়িয়ে ধরল?’  দীপ :  ‘হুম , অনেকে , কাজ আছে পরে কথা হবে আবার’   
ঝিম চুপ করে ভাবতে থাকে কী যে ভাবছে কিছুই কুল কিনারা পায় না বুকের ভিতরটা হু হু করেএকা  একাই বিড়বিড় করে বলে ওঠে,  আমার জন্যে সত্যিই  কোনো অনুভূতি নেই তোর! শুধুই বন্ধু  আমি! তোকে এত বুঝি এটাই শুধু না! সরস্বতী পূজার স্কুল কলেজে বাঙালি ভ্যালেন্টাইন ডে উপভোগ করা হয় নি, ডাকাবুকো গোছের মেয়ে ছিল বলেএসব নিয়ে ভাবনাও তখন জমাট বাঁধে নি, ক্যারিয়ার ছিল একমাত্র লক্ষ্যদীপের সাথে  কথা বলতে বলতে বেশ  নারীত্বের অনুভূতিগুলো সুড়িসুড়ি দিয়ে উঠছে আজকাল

ঝিম রাতে অনলাইন হয়ে আজ রাত ১২ টাতে দীপের  মেসেজের অপেক্ষা করতে থাকে,  কিন্তু  মেসেজ করে না দীপও কোনো মেসেজ করে না অনলাইনে থেকেও। এরকম হয় অনেক সময়, অনলাইনে থেকেও কথা বলে না কেউ।
সকাল থেকে অফিসের কাজে ঝিমের আর ফেসবুক অন করা হয় না, কতকটা ইচ্ছে করে একটা চাপা অভিমান, ‘মেয়ে হয়ে সে কেন আগে বলবেনিশ্চয় বন্ধু ছাড়া আর কিছু না আমি!  আমি প্রকাশ করলেই খারাপ হবেকী ভাববে!   বন্ধুত্বটাও যদি না রাখে!  কিন্তু আমাকেও এত বোঝে আর এটা বোঝে না!

অফিস থেকে বেরিয়ে  সিঁড়ি দিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিচে নামতেই  ঝিমের সামনে গাড়ির দরজা খুলে একগুচ্ছ লাল গোলাপ, কাঁথাল বাঁকা উলকি-পরা এই ভাদুটিই আমার। তোর মাঝে আমার অন্তর্ধান লেখা কার্ড এগিয়ে - আজ প্রথম মুখোমুখি

২টি মন্তব্য: