উত্তরকথা
(৭)
সেই সব মাঠ প্রান্তরের দিকে চলে যেতে যেতে, রোদ ঝড়ের
দুনিয়ায় ডুবে যেতে যেতে রাধাকান্তকে খানিক অন্যমনষ্ক হয়ে পড়তে হয়। তার চোখের
পাতায় বুঝি ঘুম নেমে আসে! সে কি টের পায়, কোথায় যেন বেজে উঠছে নিম কাঠের দোতরা! গাড়িয়ালি
গান! উদাসী নারীর দেহমনের বিষাদ বুঝি তাকে তাড়িত করে! ঘুমের ঝোঁকে ঝোঁকে রাধাকান্ত
তার যুবকবেলায় ফিরে যেতে থাকলে চারপাশে বিষাদকুয়াশার ঢল নামে। সে দেখতে পায়
সোমেশ্বরী ছুটে চলেছে খেতের আইলে আইলে আর তার নাচের মুদ্রায় খুব ঘন হয়ে নামছে
মাহুত বন্ধুর গান। কত কত
কালখণ্ডের ওপার থেকে গান ভেসে আসে, বাদ্যবাজনা ভেসে আসে-
‘যায় নিলীমন গৌরিপুরের হাটে
নীলমন নীলায় ও না
ঝিকো ঝিকো কড়ি রে
আঞ্চলে বান্ধিয়া রে’
তখন রসুনের খেতে খেতে অগণন পাখিরা। দূরের বড় রাস্তায় ১০০
গরুর গাড়ির গাড়িয়াল গাইতে থাকে বাওকুমটা বাতাসের গান। রাধাকান্তর মনে পড়ে কলসী বান্ধার
সেই এক রবিবারের হাটের কথা। ধানহাটিতে দেখা হয়ে যাওয়া তিন বুড়ির ফুরফুরে সেই
নাতনীর কথা, যার সাথে কত কত গল্পগাছা হত! জঙ্গলবাড়ির গল্প, রাজার হাতির গল্প, মহেশ্বর
দেউনিয়ার সাতফুটিয়া কাঠের বন্দুকের গল্প। সেই নাকে নোলোক দোলানো কইন্যার কথা আজো
খুব মনে পড়ে। জীবনের
কোনো দিক দিশাই খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবল রাধাকান্তর মগজের স্রোতে স্রোতে ভাসতে
থাকে সেই অলীক কইন্যার নাচ ও গান-
‘মুই নাইয়র আর যাবার নং গাড়িয়াল
তোমার গাড়িত চড়ি’।
একসময় কিন্তু তাকে ভ্রমবিভ্রম থেকে দেশদুনিয়ার বাস্তবতায়
ফিরতেই হয়। সব
ছাপিয়ে তখন রাধাকান্তকে হাটের পথেই পা বাড়াতে হয়।
(৮)
প্রথমে পেরোতে হবে তামাকবাড়ি। তারপরে মরিচখেত। এরপরেই
তারামোহনের টাড়ি। তারামোহন জোতদারের নাম ৫০/৭০ গাওগেরামের মানুষ একবাক্যেই চেনে।
কী তার বিক্রম! কী তার দাপতাপ! তারামোহনের গোলা গোলা ধান লুঠ হয়েছিল তেভাগার সময়। চলেছিল
গুলি, লাঠি, সড়কি। সে এক ধুন্ধুমার ব্যাপার। এই সব নিয়ে কিসসা ও গানও লেখা হয়েছিল।
৪৭-এর এক শীতের বিকেলে জারিধরলার পারে নিজের ঘোড়ার পিঠেই বল্লমের ঘায়ে মরতে হয়েছিল
তারা জোতদারকে। ১১ হাতির সেই তারা জোতদারের টাড়ি পেরোতে পেরোতে রাধাকান্তর সাথে
ইকবাল কসাই আর অনন্ত গীদালের দেখা হয়ে যাওয়ায় ও বেশ একটা গানবাড়ির মতোন জমজমাটি
ভাব এসে যাওয়ায় রাধাকান্তর হাটযাত্রাটা খানিক স্থগিত থাকে। তারা তখন দইচিড়া আর
নুতন সব গাথাগল্পগানটান নিয়ে বেশ জমিয়েই বসে পড়ে তারামোহনের টাড়ির ঘাস ও ধূলোর
নিবিড়ত্বে। এভাবে কথালাপ শুরু হয়। দেশদুনিয়ার কত শত খবরটবর নিয়ে তারা বুঁদ হতে হতে
নিবিড় হতে হতে বুঝি মহামহিম এক যাত্রাপালার জুলুস জমায়েতেই প্রবেশ করতে থাকে! কুষাণের
পালায় তখন ঝাপিয়ে নেমেছে দলবদ্ধ ছুকরি নাচ। মঞ্চ জুড়ে গান, গানের উচ্চগ্রামে সমবেত
দোহার-
‘আইসেক মাও মোর স্বরস্বতী
রথত চড়িয়া রে ভর
জয়জোগারে আইসেক মাও
মোর সভার ভিতর’
সে এক অনবদ্য বর্ণিলতা! জীবনের পরতে পরতে কেমন জুড়ে যাওয়া
এক অন্য জীবনের নকশী! হাট অপেক্ষায় থাকে। সওদাপাতি
পড়ে থাকে। ঘড়বাড়ি বিভ্রমের শিশিরেই ভিজে যায়। রাধাকান্তরা জীবনের পরতে পরতে এইভাবে
কেবল উৎসব সাজিয়ে যায়।
(৯)
দাদুবাড়ির কথা মনে পড়লেই গুনগুন গান এসে যায় সোমেশ্বরীর
কন্ঠে। দাদুর সেই বাদামী রঙের ঘোড়াটির কথা মনে পড়ে যায়। নদীর পারে পারে ঘুড়ে
বেড়ানো সেই ঘোড়াটির নাম সে দিয়েছিল ‘আদুরী’। তার পিঙ্গল চোখ, বারুণের মতোন
লেজ, আপনত্ব ভরা এক মরমিয়া গানের মতোন সবাক উপস্থিতি দিয়ে সেই ঘোড়াটি সোমেশ্বরীকে
মায়াময়তা শিখিয়েছিল। ব্যাপ্ত এক জীবনের গহনগভীর গাঙে কাশিয়ার ঝোপে ঝোপে লুকিয়ে
থাকা গুলাবাঘার সহসা ডেকে ওঠা এক রহস্যের ঘেরে সারা জীবন উজানভাটির ঢেঊয়ে তাকে তো
দুলেই যেতে হল। আঁচলের হলুদ, পেঁয়াজের ঝাঁজ, গাইগরু নিয়ে তাকে জীবনভর পাঁকঘরের শিদল
শুটকির উপর হুমড়ি খেতে হল। আর সব ছাপিয়ে লাউমাচার পাশে সে কেবল গাইতেই থাকলো-
‘হাপ্পা হাপ্পা নাফা রে ভাই
হাপ্পা হাপ্পা নাফা
রসুন তেলানী দিয়া
খাইতে ভারি মজা’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন