শিক্ষানীতি
প্রণয়নে প্রয়োজনীয়তাঃ ধর্মীয় সচেতনতা নাকি বিজ্ঞান মনস্কতা?
বাংলায়
বহু পুরনো একটি প্রবাদ বাক্য আছে এরকম, “জ্ঞান অর্জনের জন্য
সুদূর চীনদেশ পর্যন্ত যাও।” -- মহাপ্রাচীর পরিবেষ্টিত দূর্লঙ্ঘ্য চীন পর্যন্ত জ্ঞানতাপস বিদ্যার্থীদের
যাওয়ার যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তা কি ধর্মভিত্তিক
শিক্ষালাভের জন্য? নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞানের নব নব সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনা অর্জনের জন্য?
আসুন, প্রবাদটির
অন্তর্নিহিত বক্তব্যের দিকে একটু মনোযোগী হই। সোশালিষ্ট পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না
মানে সমাজ-প্রজাতন্ত্রী গণচীনের অধিবাসী চীনা বংশোদ্ভুতরা
কি পৃথিবীর সবক’টি প্রধান প্রধান ধর্মের ধারক বাহক? -- না,
তা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা মহামতি বুদ্ধের বা কনফুসিয়াসের
অনুসারী। তাহলে প্রতীকি অর্থে সে দেশের কথা বলা হলেও, আসলে
কি এরকম কোনো স্থানেই ধর্মভিত্তিক শিক্ষালাভের জন্য যাওয়া আদৌ ফলপ্রসু হবে কারো
জন্য?
বেছে
বেছে এই বিশেষ প্রবাদটিকেই ব্যবচ্ছেদ করলাম এজন্য যে, বহু
প্রাচীন কাল থেকেই শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানাবিধ শাখা-প্রশাখা
চর্চার জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়ে আসছে। সেক্ষেত্রে এই একবিংশ শতকের
প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা মূলতঃ ধর্মের ছায়ারূপ থেকে শিক্ষালাভ করবে -- এই
ধরনের চিন্তার সূচনাই একটি ভিত্তিহীন বাহুল্য প্রসঙ্গ মাত্র।
ইসলাম, হিন্দু,
বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ইহুদী, জৈন, পার্সী,
জরস্থ্রুশীয়, বাহাই -- এগুলো মোটামুটি
এখনকার বিশ্বে প্রচলিত প্রধানতম ধর্ম। যাদের অধিকাংশের উদ্ভব বহু শতক বছর আগে এবং
এসব ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থগুলোও সেই পুরনো সময়েই রচিত। বেশির ভাগই ঐশীবাণী হওয়ায়
কালের সাথে তা সংশোধন বা পরিমার্জনের কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু মানব সভ্যতা এক
জায়গার দাঁড়য়ে নেই। এখন প্রশ্ন, কালের বিবর্তনে পৃথিবীর বুকে সভ্যতার যে বিকাশ বা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে,
তার সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষালাভ না করলে, আদৌ কি সেই শিক্ষা বাস্তবমুখী হবে? অথবা
বিদ্যার্থীদের বা সমাজের কোনো কাজে আসবে?
একটি
ঘটনার উল্লেখ করি,
ইসলাম ধর্মের অনুসারীগণ অনেকেই এই সংবাদ পাঠ করে চমৎকৃত হয়েছিলেন যে, নাসার বিজ্ঞানী সুনীতা উইলিয়ামস চন্দ্র পরিভ্রমণে গিয়ে মহানবী( সাঃ) কর্তৃক অঙ্গুলী ইশারায় চন্দ্র
পৃষ্ঠকে দ্বিখন্ডিত করার চিহ্ন এখনো বিদ্যমান দেখতে পেয়ে, খ্রীষ্টান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছেন। (সংবাদের
সত্য / মিথ্যা আমার জানা নেই।) ধরে নিলাম ঘটনা সত্যি, আলহামদুলিল্লাহ।
কিন্তু, হে মুসলিম উম্মাহ, চাঁদ
পর্যন্ত যাওয়ার জন্য, আগে সুনীতাকে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে
উদ্ভাবিত রকেটযানে চড়তে হয়েছে, সে কথাও মনে রাখতে হবে
আমাদের।
আরো
বিপত্তি,
মনুষ্যকুলের যে ক্রমবর্ধমান অংশ এথিষ্ট বা নাস্তিক, আরেক কথায় কোনো প্রচলিত ধর্মেরই অনুসারী নয়, অপ্রচলিত
ধর্মেরও নয়, আরেক কথায় তারা অনেক সময় হিউম্যানিষ্ট... সেই
সব মানুষেরা কি তাহলে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রে
যাওয়া থেকে বিরত থাকবে? নাকি নিজেদের জন্য ভিন্ন
শিক্ষাব্যবস্থা চালু করবে? সেটা কি সম্ভবপর হবে?
চিকিৎসা
এছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের প্রার্থনা কেন্দ্র সমূহ, মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডা-মঠ
সব স্থাপনাগুলোই কিন্তু আগে স্থাপত্যনীতি শিক্ষালাভ ক’রে,
তবে বানাতে হয়েছে ওগুলোর
নির্মাতাদের। এবার আসি ধর্মভিত্তিক শিক্ষার বিষয়বস্তু নিয়ে। ধর্ম হচ্ছে মূলতঃ বিশ্বাসকেন্দ্রিক
জীবনাচরণ। প্রায় সব ধর্মেরই প্রতিপাদ্য বিষয়
হচ্ছে, কী উপায়ে সৎ পন্থায় জীবনাচরণ করলে ইহলৌ্কিক এবং পারলৌকিক মোক্ষধামে শান্তিলাভ করা সম্ভব। অপরপক্ষে, বিদ্যাশিক্ষার
দ্বারা মূলতঃ মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান বা ধারণা লাভ করে একটি বিশ্বাসে বা
সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যে দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী
প্রক্রিয়া পরস্পরের থেকে একেবারে ভিন্ন,
তা একসাথে মিলিয়ে ফেলা যাবে কোন যুক্তিতে বলুন? সেক্ষেত্রে, এই দ্বিমুখী প্রক্রিয়ার দ্বন্দ্বে,
জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ধীরে ধীরে ডালপালা মেলে
আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে, তা থেকে কি বিরত থাকা সম্ভব
আজকের আধুনিক মানুষের পক্ষে?
আরো
গুরুতর সমস্যা,
শিক্ষাব্যবস্থা যদি ধর্মীয় রীতিতেই ঢেলে সাজাতে হয়, তাহলে এতগুলো প্রচলিত ধর্মের মধ্যে কোনটির রীতিনীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে? কোনো দেশের জনসংখ্যার
ধর্মভিত্তিক সংখ্যা গরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে ও যদি সেদেশের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়, তাহলে
সংখ্যা লঘিষ্ঠরা কি শিক্ষাগ্রহণ থেকে বিরত থাকবে? নাকি আলাদা আলাদা
ধর্মানুসারীদের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হবে?... অত্যন্ত জটিল আবহ নয় কি?
শাস্ত্র, গণিত,
স্থাপত্যবিদ্যা, চারুকলা, ভাষাতত্ত্ব, নৃ-বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, ভূগোল... বিদ্যাশিক্ষার এরকম নানা
বিষয়ের কোনটি মূলতঃ ধর্মীয় চিন্তাধারা থেকে রচিত? উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়,
চিকিৎসা শাস্ত্রে যত শত রোগের নাম ও প্রতিকার শিক্ষালাভ করা যায়
বা শল্যবিদ্যার কোনো কৌশল, কোনটাই কি মূলতঃ কোনো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জানা সম্ভব?
উপসংহারে
বলতে চাই,
ধর্ম মূলতঃ একটি বিশ্বাস, অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই বংশ পরম্পরায় অনুসারিত, আবার
কখনো তা অন্ধ বিশ্বাসেরও নামান্তরমাত্র, তা মেনে চলা হয়
অতীতের জ্ঞান বা বাণী অনুসরণ করে। অপরপক্ষে বিদ্যাশিক্ষা (বা প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষা) শিক্ষক-ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে একটি নিরন্তর অনুশীলন বা চর্চার
ফলশ্রুতি; বলা যায়, বর্তমানের
ধারক বাহক। এই দুটি ভিন্ন প্রক্রিয়াকে একত্রে জারিত
করার মতো কোনো জারক রস আমার জানা নেই, যদিও দুটোরই উদ্দেশ্য
মানুষকে পরিশীলিত করা। তবুও এমন কোনো দ্রাবকের সন্ধান আজ
পর্যন্ত পাওয়া যায়নি,
যা দ্বারা এই দুইটি বিষয়কে একত্রে দ্রবীভূত করা যায়। সে চেষ্টা করতে গেলে, মিঠা
স্বাদের শরবত না হয়ে, বরং তালেগোলে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে
যাওয়ারই সম্ভাবনা প্রবল।
তাই
এরকম একটি অবান্তর ব্যবস্থার চকিত চিন্তাও যদি কারো স্বপ্নমানসে উদিত হয় বা কোনো
অতি ঊর্বর মস্তিষ্কে এর বীজ অংকুরিত হয়, তবে
যুক্তি-বুদ্ধির শানিত কুঠারাঘাতে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে, এ ধরনের উদ্ভ্রান্ত চিন্তার মর্মমূল, বিষবৃক্ষের
শেকড় খুব বেশি গভীরে প্রোথিত হওয়ার আগেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন