মেয়েখেলা (পর্ব - ১০)
দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়েআসছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে শ্বাসের একেকটি দৈর্ঘ্য। মৃত্যু টানছে দুর্নিবার। চোখের সামনে প্রবল সম্ভাবনময় গোলাপ বাগানটির সব ফুল একে একে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাদের বাচিঁয়ে রাখার সব প্রতিশ্রুতিই একটু একটু করে ঝরেপড়ছে। আমি কথা রাখতে পারিনি। প্রেম ঠকিয়ে নিয়ে গেছে অচিরেই আমার সব বিশ্বাস ও চেতনাl অস্তিত্ব ও ভালোবাসার সিংহদুয়ারে কাঁটা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেছে এক মৃত্যুপুরীতে l রুদ্ধনগরীরবন্ধ ফাটকের ঠিক পেছনে এক প্রকান্ড ধরাশায়ী জীবন ধিক ধিক করে জ্বলে আছে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত, গুলিবিদ্ধ কিন্তু পলাতক নয়। জীবন এখনো সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালে, রাতে তারাদের সাথে আলো বিনিময় করে। শুধু ফাটকের ভারী ভারী শেকলে পিষ্ট হয় জীবনের ভারবাহী নিঃশ্বাস। নিজের ক্ষত নিজেকেই লালন করতে হয়।আমি করি। কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। প্রতিদিন আমার মাতম। মৃত্যুকে
পরাস্ত করার কৌশল, নিত্য আপডেটেশনl বিশ্বের এক কিনারায় ধুলিকণা সম চুর্ণ বিচুর্ণ অণু একমনে মরণ আগলে ঠায় দাঁড়িয়ে, অন্যদিকে জনজোয়ারের গতি অব্যাহত জীবনের শাখায় শাখায়। সুখ, উল্লাসে স্নানাতুর সব প্রাণ।
জীবনের আনন্দ উপভোগ ও সেলিব্রেসনের কত না পথ খুঁজে পেয়েছে আধুনিক মানুষ। শুনেছিলাম লা ভেগাসে নাকি একসময় এমন এক বিনোদমূলক অনুষ্ঠান চালু ছিল নিশানাবাজির মতো। আমরা যেমন হাতে খেলনাবন্দুক নিয়ে একটা পঞ্চ লেয়ারের কেন্দ্রে গুলি ফাটিয়ে নিশানা লাগাতে থাকি সেরকম। আমাদের এখানে থাকে বেলুন আর ওখানে থাকে নাকি নগ্ন নারীদেহ। পয়সা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে বডি পার্টের বিভিন্ন পছন্দ মতো স্থানে নিশানা লাগানো যেতে পারে। এই কদর্য অনুষ্ঠান বা বিকৃতির পক্ষে স্থানীয় যুক্তিটি এমন যে ভোগের চূড়ান্ত জায়গা থেকে নিজেদের, মেয়েদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে মানে পুরুষের যৌনতা অবদমিত হচ্ছে যা মহিলাদের পক্ষে আখেরে নাকি শুভ। কমছে ধর্ষণের পরিসংখ্যানl কি আবোল তাবোলের পৃথিবীতে আমাদের বাস! সভ্যতাও এমন করে নগ্নতার কথা বলে যায় অকপটে।
চালাক বা বুদ্ধিমান ও সলিড পার্সোনালিটির ধারণাও বদলেছে। নিজের শ্বশুরবাড়ি ও স্বামীর চরিত্রের কথা সহসা যে প্রকাশ করে না তাকে আমরা বুদ্ধিমতী বলে থাকি। আবার হ্যাসব্যান্ডকে তৃতীয় মেয়ের কাছ থেকে সরিয়ে এনে সংসারের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছে যে নারী তাকে আমারা গর্বের সাথে সলিড পার্সোনালিটি বলে থাকি। যে মেয়ে সংসার থেকে বিদ্রোহ করে বা অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে বেরিয়ে আসে তাদের আমরা বোকা বলে থাকি। মেয়েদের আইকিউ কম বলে সমাজ, মানসিকতায় এক চেনা বলয় কাজ করে তারপর আবার তাদের জন্য এমন একটি ব্যবহারিক স্কেলও থাকে। এই নির্দ্ধারিত স্কেলে আমার মতো মেয়েদের সংখ্যা একটু কম। সকলেই খুব গোছানো, আত্মসচেতন, নিজেরটা নিজে বুঝে নিতে পারে। আমার মতো সারাটা জীবন অন্যেরটা বুঝতে ও বোঝা বইতে কেউ তেমন আগ্রহী নয়। আসলে নীট ফলটা তো শূন্যই সেখানে সেটা ক্যালকুলেট করার মতো প্রাজ্ঞ সকলেই।
আমার মা এখনো কাঁদেন এই বলে যে আমি কীভাবে সারাজীবন অন্যদের দান করে এসেছি। শুরু করেন আমার নিজের পিজি হষ্টেলে ফেলা রাখা বেডিং নিয়ে যাতে মায়ের একটি সাধের কম্বলও ছিল। সে এক করুণ অভিজ্ঞতা! আমি যে কম্বল ফেরৎ নিতে যায়নি এমনটা নয়। গিয়ে দেখি আমার নাইটি ইনারএর আকার নিয়ে একজনের দেহে বিরাজমান। কেটেকুটে তাদের নিজেরদের পচ্ছন্দমতো করে নিয়েছে আবাসিক কাম ছেড়ে আসা হষ্টেলমেট। চা করার সরঞ্জাম ভাগাভাগি হয়ে গেছে তাদের মধ্যে। বালিশ, বেডসিটেরও এক হাল। কম্বলের উপর প্রতিষ্ঠা হয়েছে ঘরোয়া ঠাকুর। আমার উপস্থিতির কারণ তাদের কাছে খুব আস্বস্তিকর তাই তাদের চাপ না বাড়িয়ে দেখা করার ফরম্যালিটি বজায় রেখে মায়ের কম্বলসহ বেডিংএর শ্রাদ্ধ সেরে ফিরলাম। তারপর অগণিত সময় জুড়ে দানপর্ব। অনেকটাই মা জানেন না তাতেই এত আফসোস। আমার জীবন আবার স্পেশাল মানুষে ভরা। তাদের অনেককেই বলতে শুনেছি কাউকে কিছু দান করলে বা ভালোবেসে দিলে তা প্রকাশ করতে নেই, তাতে দাতার মহিমা কমে যায়। নিতে মহিমা বাড়ে বুঝি! যার সাথে কোনোভাবে জুড়ে নেই তার দেওয়া জিনিস ধারণ করা খুব কঠিন। শুনেছি এক বিখ্যাত বলিউড অভিনেত্রীর কাছে তার প্রাক্তন প্রেমিক তার গিফট দেওয়া ফ্ল্যাট ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা পাননি। যে পুরুষ নিয়ত পয়সার জন্য প্রেমিকার কাছে হাত পাতে তাদের কী বলে আমার জানা নেই, কিন্তু পরবর্তীতে তারা গর্ব করে বলে টাকা তো ফিরিয়ে দিয়েছিলাম! এমন চালবাজ লোকেরাও নিজেরদের প্রেমিক হিসাবে তুলে ধরতে পারে মেয়েদের সামনে!
অভিজ্ঞতায় চোখ ছেয়ে থাকে। একজন পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি রাতের পর রাত মেসেজ করতে থাকে। নানা অব্জেক্সনাবেল বা আনপ্লিজাণ্ট কথা বলে তার প্রতিবাদ করলে অবোধ শিশুর মতো বলে এ ম্যাসেজ তিনি সকলকে পাঠিয়ে থাকেন কেউ কিচ্ছুটি বলেনি। আমিই প্রথম মানে আমি বেশি পাকা। সুন্দর সোনা সম্বোধনকে আমি কালো করে দেখছি। এমন সফিষ্টিকেটেড পার্ভার্টদের চিহ্নিত করতে শুরু করলে ঠগ বাছতে গা উজাড় হয়ে যাবে এই আর কি! এদের আবার একজন বিশ্বস্ত স্ত্রী আছে যার গল্প ও তাদের বন্ডিং-এর কথা কথায় কথায় পেড়ে ফেলেন এরা। ঘরের মহিলাটিকে একদম তার বিপুল বিনোদন ও স্বভাবের বাইরে রেখে থাকেন তারা। একটা ডুয়াল পারসোনালিটির জীবন তাদের। শিকারী শুধু শিকার চেনে, বাকীদের কাছে সে সাধারণত ভদ্রমানুষ হিসেবে কাউণ্টেবেল। এদের কাছেই শোনা সিঙ্গল মাদার নাকি খুব পপুলার হয়ে উঠেছে। এদের খুব ডিম্যান্ড। বাহ! কি অপুর্ব দৃষ্টিকোণ! সমাজের একশ্রেণীর শিক্ষিত মানুষের প্ল্যাটফর্মেও এমন ভাবা হয় নাকি! কি অপার বিস্ময়ে ভাবি এই সিঙ্গলশব্দটার পেছনে যে কি হাহাকার আর দৈন্যতা পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে তা তাদের পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব যারা এইপথটা পেরোয় এবং নিঃশব্দে যারা খুব কাছ থেকে দেখে এই জার্নি কতটা দুর্গম, কতটা অনিশ্চয়াতার! এই লম্বছায়ার দৈর্ঘ্যের ফাঁকে ফাঁকে কিছু শ্রদ্ধার মানুষরা তাদের স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভারে অবনত হতে পারাটাও এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
মহিলাদের কমোডিফিকেশনের দায় শুধু সিরিয়াল, সিনেমার নয়, এগুলিতে আমারা তার রিফ্লেকশন দেখি মাত্র। এদের সেন্সুয়াস করে তোলে পুরুষের দৃষ্টি। সমাজই মিনিয়েচার সোসাইটি যাতে একটি রাবিশ ছবির প্রাণ পোঁতা আছে, যার কলেবর দিন দিন আয়তনে বাড়ছে যা বর্তমানে প্রায় অনিয়ন্ত্রিত। মেয়েদের মর্য্যাদা সেখানে মূল্য রাখে অক্ষরে, কথায়, শপথে, পূজায় কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে কমোডিটির কন্সেপ্ট থেকে ফোকাস সরে না কিছুতেই। হস্টেলের
গেট অনির্দিষ্টকালের জন্য সব্ধ্যে ৬ টা
বেজে ৩০ মিনিটেই বন্ধ হবার নির্দেশ থাকে। হোলির দিনে ক্যাম্পাসের বাইরে না যাওয়া
বা নিজের বাড়িতে চলে যাওয়ার নির্দেশ থাকে। সমাজ বদলায়, মানুষ চাঁদ জয় করে, শুধু মেয়েদের
সিকিউরিটি প্রোভাইড করার বদলে অবরোধকেই বেছে নেওয়া হয়। অন্দরমহল খুব সুরক্ষিত
কেননা সেখানে দায় পরিবারের। রাষ্ট্রীয় সাইনবোর্ডের যে প্রচার তাতে আঁচড় না
কাটলেই সফল প্রশাসন ও সমানাধিকারের সাংবিধানিক বার্তার মহিমান্বিত প্রতিষ্ঠা। আসলে ফেক বিজ্ঞাপনের চেয়েও খোকলা মানুষের নারীর
অধিকার চেতনা ও ক্ষমতার ধারণা। যার বিরুদ্ধে যতবার রব ততবার শতাব্দীর এক সেরা
খারাপ মেয়ের উত্থান। নতুন করে তার চরিত্র ও স্বভাবের ক্রুশিফিকেশন। আবার
রেজারেক্সন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন