নিপুণ’স স্যালন
আধা ঘন্টা ধরে গরম জলে শ্যাম্পু গুলে কাকুর পা ভিজিয়ে
রেখেছিল নিপুণ। এ ক’দিন ঝাড়া মুখস্ত করেছে প্রতিটা ধাপ। ঝামা দিয়ে পায়ের পাতার মড়া চামড়া খসিয়েছে, তারপরে প্রায় পনের মিনিট ধরে নরম
ব্রাশ দিয়ে নখের ভেতরের ময়লা পরিষ্কার করেছে। ঘাড় ধরে গেছে
নিপুণের। উঁহু! ক্লায়েন্টকে আরাম দিতে হবে, যেন চোখে ঘুম নামে। ধৈর্য ধৈর্য। কিউটিক্যাল পুশার
দিয়ে চেপে চেপে নখের চামড়াগুলো আলতো পেছনে ঠেলে নিপুণ।
ম্যানিকিউর প্যাডিকিউর কিটটা অর্ডার দিয়ে কাকুই আনিয়েছেন।
অনেক দাম। সরাসরি ইম্পোর্টেড। প্রায় পনের দিন ধরে ট্রেনিং চলেছে নিপুণের। কত কী
জানেন কাকু! কাকু অবশ্য বলেন, আজকাল ইউটিউব
দেখে সব জানা যা্ শুধু ইচ্ছেটাই জরুরি। ‘টাকাটাও’ মনে মনে বলেছিল নিপুণ।
আজ ওর প্যাডিকিউরের পরীক্ষা। প্র্যাক্টিক্যাল। সার্ভিস কার্ডে এর নাম
হবে, ‘প্যাডিকিউর ক্লিনিক’। কাকু বলেছেন, আজকের পরীক্ষায় পাশ হ’লে কাল থেকেই স্যালনের কাজ শুরু হয়ে যাবে। বুকের ভেতর
প্রজাপতিরা রিনরিনে পাখা নাড়ে; এই প্রথম নিপুণের কোনো চাওয়া প্রাণ পাবে। মনোযোগ
ফেরায় নিপুণ।
কাকুর নখের রঙ হলদেটে বাদামী। বয়েসের পুরুত্ব জমেছে নখে।
প্যাডিকিউরের ভারী নেইলকাটারও বেশ গায়ের জোর দিয়ে চাপতে হচ্ছে। অবশ্য কাকুর মতো
পুরু নখের ক্লায়েন্ট হবে না এখানে। ওর স্যালন কেবল মেয়েদের জন্যে। কাকু শিখিয়েছেন,
‘স্যালন, স্যালুন না’।
আজ বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর। শ্যাম্পুর ফেনায় আলো পিছলে রঙধনু
রঙ ছড়াচ্ছে। খুশির ওমে ছেয়ে যায় মন। এই তো আর কিছুক্ষণ, তারপরেই ‘নিপুণ’স স্যালন’। কাকুর পাটা
যত্ন করে সামনের জলচৌকির ওপর বিছানো টাওয়েলে তুলে নেয় নিপুণ।
ওর বিয়েটা হয়েছিল হঠাৎ। বাপ মরা মেয়ে, মামাদের কাছে মানুষ। এক
দুপুরে কলেজ থেকে ফিরেই শোনে, বিয়ে। ছেলের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। শহরে বাড়ি। বাবা নেই। এক ভাই, এক বোন। ওদের মা হঠাৎ
স্ট্রোকে শয্যাশায়ী। বিয়ের তাড়াহুড়ো এই কারণেই। নিপুণের কী ইচ্ছে কেউ জানতে চায়নি।
ছেলেরা কিছু চায় না, কেবল লক্ষ্মীমন্ত গোছানো একটা মেয়ে।
নিপুণ লক্ষ্মীমন্তই। শান্ত দুই চোখে সব ইচ্ছেদের গলা টিপে বউ হয়ে চলে
এলো শহরে; লক্ষ্মীমন্ত নিপুণ।
পুরনো শহরের ঘিঞ্জি গলির ভেতরে আধপাকা তিন কামরার ঘর। আশে
পাশের উঁচু বাড়িগুলোর জন্যে আলো ঢোকে না
ভেতরে। উঠোন আছে এক চিলতে। আর সেই উঠোনে আছে শিউলিতলা। দিনের আলোতে কিপ্টেমি,
কিন্তু ভরা জোছনা বিল্ডিংগুলোর গা পিছলে সেই এক চিলতে উঠোনের আধ চিলতে শিউলিতলাটা
ভাসিয়ে দেয়! নিপুণের চোখের তারা জাগে তখন।
প্রায় পনের দিন আগে ভর সন্ধ্যায়
স্যুটকোট পরা সৌম্য ভদ্রলোক কড়া নাড়ছিলেন। নিপুণ চিনতে পারেনি। তিনিও না। অলোকের বোন চুমকি
কি? চুমকি তো এখন ‘জান্নাতুল মাওয়া’। বান্ধবীর ভাইয়ের সাথে ভেগেছে বছর চারেক আগে।
পরিচয়টা নিজেই দিলেন। সোনাকাকু। অলকের বাবার একমাত্র ভাই। বাপমা মরা এই
ছোট ভাইকে সন্তান স্নেহে বড় করেছেন তিনি। দাদার টাকায় বিদেশে পাড়ি দিয়ে সে ভাই আর যোগাযোগ রাখেনি।
স্টোরটা খারাপ চলছিল না। নুডলসের
প্যাকেট, পাউরুটি-বিস্কুট, ডিপ ফ্রিজে আইসক্রিম, কনডম, স্যানিটারি ন্যাপকিন,
স্যালাইনের প্যাকেট সবই রেখেছিল অলক। কিন্তু দোভাষিদের পোড়ো মাঠটা ঘিরে বিশাল
এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স গজালো গত বছর। তার নিচের তলা জুড়ে অত্যাধুনিক কায়দার
দোকান। মাছ, মাংস, চিরুনি থেকে মশলাপাতি কী নেই? ট্রলি ঠেলে ঠেলে নিজের সদাই
নিজেই তোল! নিপুণ যায়নি কখনো, শুনেছে। অলকের দোকানের বিক্রিতে মন্দা সেই থেকে।
কাকু মার্কেটটা ঘুরে এলেন সেদিন আর ফিরেই এই ‘স্যালন’
আইডিয়া। অলকের দোকানে একপাশে পার্টিশন দিয়ে হবে ‘নিপুণ’স স্যালন’। অলক চুপচাপ শুনছিল। রাতে
বিছানায় বলল, ‘এসবে লাফিও না। মা’কে কে দেখবে? ফাজিল বুড়ো। এখন দরদ উথলাচ্ছে। ‘নিপুণ’স
স্যালন! ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পায় না।’
বিছানা তুলতে গিয়ে সেদিন কাকুর মানিব্যাগে সোনালি চুলের
বাচ্চা কোলে কারো ছবি দেখেছে নিপুন। ওরা কে আন্দাজ করেছে কিন্তু কাকু মুখ খোলেননি; এমনকি শাশুড়ির
উপর্যুপরি তীক্ষ্ণ খোঁচায়ও নয়।
নখটা বাঁকা হয়ে মাংসের ভেতরে ঢুকে আছে। কিছুতেই বেরোচ্ছে
না। পাশ থেকে নেইল কাটারের মুখটা ঢুকিয়ে
নখটা বের করল নিপুণ, তারপরে সব শক্তি দিয়ে নেইল কাটারের দাঁত চাপলো। হঠাৎ কাকুর
আর্তনাদ! গামলার জল ছল্কে চোখে ঝাপ্টায় নিপুণের; ঝটিতে পা ডুবিয়েছেন কাকু। ঝাপ্সা
চোখে নিপুণ দেখছে গামলার জল গোলাপি থেকে গাঢ় গোলাপি হয়ে যাচ্ছে। ফেনার ওপরের রঙধনু
মরে যাচ্ছে দ্রুত। ‘আজ পাশ হলে কাল থেকেই স্যালনের কাজ শুরু’ কাকু বলেছিলেন সকালে।
নিপুণের গাল বেয়ে জল গড়ায়। কানে ফিসফিস বাজে, ‘নিপুণ’স স্যালন!’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন