মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সুমনা পাল ভট্টাচার্য্য

সখী, ভালবাসা কারে কয়...




"তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালবাসা, ভালবাসা...
সখী ভালবাসা কারে কয়?"...
এফ এম চলছে বোধহয়...
বসন্ত বাতাসে এই ভালবাসার সুর কেমন মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে!

কালকেই ১৪ বছরের কিশোরী রাঙতা এক গোছা লাল হার্ট শেপড বেলুন নিয়ে এক আবেশমাখা মুখে ফিরছিল বাড়ির পথে
বারান্দা থেকে হাঁক দিয়ে জিগ্যেস করলাম, "কী রে, এত্তোগুলো?"
মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে একটা উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দিয়ে বলল, "হ্যাপী ভ্যালেনটাইন ডে, আন্টি... লাভ ইউ সো মাচ"
আমিও খিলখিলিয়ে হেসে বললাম, "হ্যাপী ভ্যালেন্টাইন ডে, লাভ ইউ টু"

সামনেই মানিকের দোকান।
এইসব মরশুমি দিন বুঝে উপযুক্ত সব জিনিস সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে মানিক ওর পান সিগারেটের দোকানে।

দেখলাম সারি সারি গ্রিটিংস কার্ড, নানা ধরনের টুকটাক শো-পিস, লাল লাল তুলোর নরম তুলতুলে একগাদা হৃদয়, আরো কত কী দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে মানিক ওর দোকান।

প্রায় একবছর হতে চলল, মানিকের বউয়ের ক্যানসার ধরা পড়েছে।
রোজ দুপুরে দোকানে পুঁচকে পল্টুকে রেখে নিয়ম করে বাড়ি যায় সে।
জানে পল্টুকে লোকে ঠকিয়ে নেয়। পল্টুও হিসেব দিতে পারে না, ঠিকমতো।
তবু, এই ঠকে যাওয়ার আঘাত যে তার গায়ে লাগে না, কারণ তার পশমে ভালবাসার টাটকা ওম লেগে থাকে যে...

রোজ বউকে নাইয়ে, খাইয়ে, অসুধ দিয়ে তবে আবার সে ফিরে আসে দোকানে।
দোকানটার আয় দিয়ে কুলোচ্ছে না শুধু।
শুনলাম দেশের জমিজমাও বেচে দিয়েছে ছেলেটা।
বউটাকে যে ভাল করতেই হবে!

এমনই সব ভাবতে ভাবতেই বারান্দার এই উত্তরের দিকটায় এসে দাঁড়ালেই পাড়াটা যেন খোলা খাতার মতো নিজেকে আমার সামনে মেলে ধরে।

হঠাৎই ভোম্বল জ্যেঠুর গলার আওয়াজ, "ভালো আছো তো মা?"...
দোতলার বারান্দার গ্রিল থেকে খানিক ঝুঁকেই বললাম, "হ্যাঁ জ্যেঠু ভালো, আপনি, হাঁটতে চললেন?"...
"আর বোলো না মা, এই অভ্যেস তো তোমার জ্যেঠিমাই করে দিয়ে গেছেন, সেই কবে থেকে তার তো তেতো অসুধগুলো খেতে ইচ্ছে করত না, বাচ্চাদের মতো তখন পাড়া ঘুরিয়ে হাতে জলের বোতল নিয়ে একটা একটা করে অসুধ খাওয়াতে হতো..."
আমি মুচকি হাসলাম, এ গল্প শুধু আমি কেন পাড়ার প্রায় সবাই বহুবার শুনেছে। ভোম্বল জ্যেঠুর নাম তাই ভাঙা রেকর্ড...
জ্যেঠু বলেই চলল, "ওই যে বাজারের দিক অবধি আবার হাঁটার অভ্যেস। তার তো আবার রান্নার শখ ছিল না খুব, এই ঘন্ট, ওই চচ্চড়িকোন মাথা, কোন কাঁটা সব তার কেনার দরকার থাকতো নিজের হাতে, তারপর ফেরার সময় ওই মানিকের দোকান থেকে একখান মিঠে পান কিনে দিতে হত তাকে, সেটা চেবাতে চেবাতে তবে ফিরতো আমার বিবি, বুঝলেখুব আহ্লাদী ছিল কিনা! "
শেষ কথাটা বলতে বলতেই জ্যেঠুর গলাটা কেমন কেঁপে উঠলো।
জ্যেঠিমা নেই আজ তিনবছর হয়ে গেল।
কিন্তু কী অদ্ভুত ভাবে তাদের সেই উষ্ণ প্রেম এখনো ছড়িয়ে আছে জ্যেঠুর পাঁজরের  সবকটা হাড়ের ভেতর অমলিন।
তাই তাঁর ভাঙা রেকর্ড হয়ে ওঠাটা তাঁর ভালবাসার রেকর্ডকে হারাতে পারে নি।

আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছেন জ্যেঠু, আমি স্থির চোখে চেয়ে আছি ঠিক এমনই সময়, রমা পিসিমা তাঁর ঘরের জানালাগুলো খুলে দিচ্ছেন উল্টোদিকে।
আমার চোখে চোখ পড়তেই বললেন, "বিকেলের দিকে জানালাগুলো না খুলে দিলে, হয় বলো তো!
তোমার দিদিমা মোটেই রাজি নয়, কী যে করি!"
"আজ কেমন আছেন?"
" ওই একই"
আমি হেসে বললাম, "আর আয়া রাখলেন না পিসি?"
"না: গো, কে অতো গালাগাল সইবে বলো তো, আর কেনই বা সইবে? এই আমিই আছি এক পাগলি, তাই সহ্য করি।"
আমি হেসে বললাম, "আপনারা যে উদাহরণ"
পিসি খুব শান্ত স্বরে কোনোমাত্র উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে বললেন, "আসি গো, ভিতরে যাই, নইলে এখুনি বালিশ, বিছানা ভাসাবে
আমি ঘাড় নাড়লাম সম্মতিতে।

পিসির নিজের মা মারা গেছিলেন পিসি যখন স্কুলে।
তারপর দাদু অর্থাৎ পিসির বাবা বিয়ে করে আনেন এই দিদাকে।
শুনেছি রীতিমতো সুন্দরী ও শিক্ষিতা এই মহিলা কখনো নিজের সন্তানধারণের আবেগকে প্রশ্রয়ই দেননি, কেবল এই মা-মরা মেয়েটির মা হয়ে ওঠার তাগিদ নিয়ে।
দাদু নাকি সেই ত্যাগের মূল্যই দিতে পারেননি।
শারীরিক উত্তাপের নেশায় তিনি নাকি বহু নারীসঙ্গে নিজেকে লিপ্ত করে ফেলেছিলেন।
ফলস্বরূপ এই মহিলাটির একাকীত্ব ও আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্যহীনতা

আজ দাদু নেই বহু বছর।
পিসি বিয়ে করেননি।
এই মা'ই তাঁর প্রাণভোমরা।
আয়াদের হাতের যত্ন দিদার মোটেই সয় না, তারাও বোঝে না, দিদার ঠিক কী চাই।
কালো ফিতে দিয়ে টানটান করে দুটো সাদা বিনুনি বেঁধে দিতে দিতে কেবল পিসিই বুঝে নেন তাঁর ৮৫ বছরের ছোট্ট মেয়েটার এখন ঠিক কী দরকার।

"দিদি, চা নাও"
"ওমা দেখি, ওটা কি লুকোচ্ছিস?"
"কই! কিছু না তো"
"কি কিছু না, দেখা..." হাতের কব্জিটা সোজা করে ঘুরিয়ে ধরতেই, কালশিটের দাগগুলো দগদগে হয়ে উঠল চোখের সামনে।
"আবার মেরেছে? তোকে না কতবার বলেছি এভাবে পরে পরে মার খাবি না। আজ তুই ফিরবি না, আসুক তোর বর তোকে নিতে, আমি কথা বলব, রোজ রোজ মদ গিলে মারবে, ইয়ার্কি নাকি!"
এতক্ষণে মাটিতে বসে পড়েছে প্রতিমা। হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে জড়ানো  গলায় বলতেই লাগল, "লোকটা তো এমন ছিল না দিদি, ওই কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেলো, কী যে এক মরণের নেশায় ধরলো মিনসেকে। আমারও দোষ আছেওইসব ছাইপাঁশ খেয়ে এসেছে দেখলেই মাথার ঠিক রাখতে পারি না, ব্যস, তারপরেই ওর রাগ সব আমার শরীরে পড়ে..."

প্রতিমা একটু থেমে গেল একমিনিট, তারপর এক অদ্ভুত মায়ার স্বরে বলল, "ওই বা কী করবে দিদি গো, সাতকূলে তো আর কেউ নেই, রাগ দেখানোর তো এই  প্রতিমাই আছে, তাই মেরে শান্তি পায় একটু..."

আমি বেশ বিরক্তির গলায় ঝাঁঝিয়ে উঠলাম এবার, "পারিস বটে"

আর একটা শব্দও না বলে হাতের থেকে কাপটা নিয়ে কাজে চলে গেল প্রতিমা।
এই গোধূলি বেলায় চারপাশ কেমন অদ্ভুত স্বপ্নময় হয়ে থাকে।

সেনকাকুদের বাড়ির দোতলায় মাস তিনেক হল ওই ছেলে আর মেয়েটি এসেছে। সেদিন প্রতিমাই বলছিল, “বিয়ে করেনি গো দিদি, ‘লিভ টিভ’ কীসব বলে, ওই করে, একসাথে শোয় গো...! ও মেয়ের আর বিয়ে হবে দিদি?"
আমি থামিয়ে দিয়ে বলি, "অমনি, মেয়েটার কথাই মনে হল তো, কই বললি না তো ছেলেটার বিয়ে হবে কিনা!"
"ছেলেদের আবার কিছু হয় না কি! সব তো মেয়েছেলেদেরই জ্বালা গো দিদি!”
"কেন? ছেলেদের শরীর নেই?  মন নেই? সেনকাকুকেই দ্যাখ"...
প্রতিমার মুখে তালা পড়ে গেছিলো। আর কথা বাড়ায় নি।

সেনকাকু।
কী অদ্ভুত মানুষ!
লোকে যে মানুষটাকে নিয়ে কত কথাই বলে! সারাজীবন বিয়েই করল না লোকটা।
রনেন কাকীমাকে নাকি ভালবেসেছিলেন কাকু।
পরকীয়ার কুশ্রী ইঙ্গিত এড়িয়ে তার এই দীর্ঘ দিনের স্থির প্রতীক্ষা কখন যে পুজোর মতই পবিত্র হয়ে গেছে, তা মানুষটার চলাচল না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
রনেন কাকুর হার্টের চেইক আপ, কাকীমার বাপের বাড়ির জমি নিয়ে মামলার ঝক্কি, রনেনকাকু আর কাকীমার একমাত্র ছেলে, আর হবু ছেলের বউএর খুনসুটি থেকে সমস্যা, কাকীমার ছাদের জলের পাইপ ফেটে গেলে, বা সাধের লতানো ফুল গাছটায় কী সার দেবে এসব কিছু দেখার ভার সেনকাকুর।
রনেনকাকু কি মনে মনে তার স্বামীত্বের অধিকারের বাইরে দাঁড়িয়ে কখনো অবনত হন কাকীমা আর সেনকাকুর এই সম্পর্কের ঘরে! 

কাকীমাও অসম্ভব সংযমে সংসারের শাশুড়ি থেকে সন্তান সবার প্রতি নিষ্ঠা ভরে দায়িত্ব পালন করে গেছেন আজীবন।
কেবল, এখনো রোজ, নিয়ম করে এই সন্ধ্যে সন্ধ্যে গানের ছাত্র-ছাত্রীরা চলে গেলে  সেনকাকু গিলে করা পাঞ্জাবি আর পাজামায় নিজেকে মুড়ে, বাতাসীর তেলেভাজার দোকান থেকে কাকীমার খুব প্রিয় বেগুনি আর পেঁয়াজি নিয়ে হাজির হন রনেন কাকুদের বাড়িতে।
কাকীমার পায়ের গতিতে তখন রাইকিশোরী। কুচো সাদা চুলগুলি কপালের ঘামে ইতিউতি আটকে গেলে, কাকু অপলক দৃষ্টিতে শুষে নেন সেই মৌতাত।

চার চোখ পৃথিবীর সব ধূলো উড়িয়ে পরষ্পরকে কেবল বলে যায়, "আমি তোমারই, আমি তোমারই"...

দরজায় কলিংবেলের শব্দ।
কে এলো দেখতেই যাবএমন সময়, "দিদি ও এসেছে"...
"কে? তোর বর?"
"হ্যাঁ"
"কই, ডাক ভিতরে, আজ আচ্ছা সে দেবো"
"না গো দিদি, পায়ে পড়ি, কিছু বোলো না, ওর সম্মানে লাগবে যে"
আর একদন্ডও না দাঁড়িয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে এলাম দরজার কাছে, "ভিতরে আসুন"
"না দিদি, ঠিক আছে"
চোখ আর মাটি থেকে তুলল না, রোগা ক্ষয়া, পেট ঢোকা লোকটা।
আমি বেশ তেজ নিয়েই বললাম, "আসু ন, ভিতরে, দরকার আছে প্রতিমা ফ্রিজে মিষ্টি আছে, দে এনে"
লোকটি প্রায় লাফিয়ে ওঠে, "না দিদি আমি খাবো না"
"কেন? লজ্জা পাচ্ছেন কেন?"
"না দিদি লজ্জা নয় গো, আসলে মিনসের এই এক রোগ"... বলেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল প্রতিমা। আর লোকটা লজ্জায় যেন নতুন কনের মত মাটিতে মিশে যেতে লাগল।
আমি কিছুটা কৌতূহলে, কিছুটা বিরক্তিতে অস্থির হয়ে বললাম, "বলবি তো!"
"আমায় পেটালে বাবু একদানাও তোলে না গো মুখে। রেঁধে বেড়ে, সিনেমার টিকিট কেটে রাখে, আমার মান ভাঙিয়ে, আমায় খাইয়ে, সিনেমা দেখিয়ে পায়েশ্চিত্তির করে গো!"
লজ্জায়, আদরে, আহ্লাদে মাটিতে পায়ের পাতা ঘষছে প্রতিমা।
আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না, শুধু বললাম, "আয় আজ, কাল তাড়াতাড়ি আসিস, আর আপনাকে বলছি এতই যখন ভালবাসেন মারেন কেন? মারতে কষ্ট হয় না?"
লোকটির ঘোলাটে হয়ে ওঠা দুটি চোখ এই প্রথম আমার চোখের দিকে চাইল, হাত জোড় করে বলল,"আসি দিদি"
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না।
কেবল বুঝলাম আজ অভিমানের পাহাড় ভাঙবে আদরের চাঙরে।

এফ এমে এখন "ক্যা এহি প্যার হ্যায়..."
আলমারিটা খুলে শাড়িগুলি দেখতে দেখতে হলুদ জামদানীটাতে চোখ আটকে গেল।

তখন কতই বা আমি, ১৭ হয়তো।
এক সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যায় এমনই একটা হলুদ শাড়ির বুকের ভাঁজে আমার জীবনের প্রথম শিহরণ লুকানো ছিল।
সে কথা মনে পড়তেই হঠাৎ আমার জানালায় পলাশ বসন্ত আর রামধনু  প্রজাপতিরা উড়ে এসে ভিড় করতে লাগল।
বাতাসে এখন অজস্র লাল হৃদয় ভেসে যাচ্ছে আপন আপন ঠিকানায়।
আহা! যেন কেউ পথ না হারায়...

'ভালবাসা
তুমি ভালো থেকো আর ভালো রেখো...








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন