ক্যাসানোভা
একটাই ঘরকে শো-কেস দিয়ে ভাগ করে সামনে দোকান এবং পেছনে
থাকার জায়গা। সেখানেই তক্তাপোশে গা এলিয়ে দিয়ে ডিভিডি প্লেয়ারে ‘ইয়ে দিল হ্যায়
মুশকিল’ দেখছিল কিষাণ। দরজায় টকটক আওয়াজ
শুনে ভল্যুমটা কমিয়ে দেওয়াল ঘড়িতে দেখল রাত পৌনে বারোটা। এত রাতে কে এলো! তাড়াতাড়ি
নেমে এসে দরজা না খুলেই গলা তুলে বলল, “কৌন?”
“ম্যায়, সুগন্ধা”। খুব আস্তে উত্তর এলো।
“ম্যায়, সুগন্ধা”। খুব আস্তে উত্তর এলো।
আওয়াজটা যেন চেনা! কিষাণের বুকের ভেতরে কী একটা অচেনা
উত্তেজনা কোটালের বানের মতো ফুলে ফুলে
উঠতে থাকল। লোহার হুড়কো দুটো সরিয়ে দরজাটা ফাঁক করতেই দেখল সামনে শর্মা ভাবী
দাঁড়িয়ে। আজ মাথায় ঘোমটা নেই, ঠোঁটদুটো
ফ্যাকাসে, আঁচল জড়ানো বুকের ওপর হাতদুটো জড়ো করা। ভেতরের
বাঁদিকের দেওয়াল ঘেঁষা ছোট টিভিটা থেকে নীল-সাদা আলো কিষাণের অনাবৃত কাঁধ ছুঁয়ে
এসে পড়েছে ঐ মুখে। নীলাভ আলোর ঘূর্ণিমায়ায় এই প্রথম শর্মা ভাবীর সম্পূর্ণ মুখটা দেখতে পেয়ে কিষাণ বিহ্বল হয়ে পড়ে। মুহূর্তে ঘোর
কাটিয়ে একদিকে সরে এসে আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে বলে,
“আচানক, ইতনা রাত মে? শর্মাজী ঠিক হ্যায় না?”
সুগন্ধা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনের অন্ধকার গলিটা দেখে নিয়ে দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
সুগন্ধা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনের অন্ধকার গলিটা দেখে নিয়ে দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
মহল্লার এক প্রান্তে এই যে এক কানা গলির মধ্যে কিষাণের অ্যাসবেস্টাসের ছাউনি দেওয়া দোকান, যেখানে চাল-ডাল থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন, কোল্ডড্রিংক্স থেকে প্লাস্টিকের মগ-বালতি সবই পাওয়া যায়, এটা মুম্বাই শহরের উত্তরসীমা পেরিয়ে হাইওয়ের ধারে গরিব-গুর্বো, দিন আনা-দিন খাওয়া মেহনতি মানুষের বস্তি। বিলাল পাড়ায় হলেও, এটা ভারতবর্ষের যে কোনো এক কোণেই হতে পারত। সে যাইহোক, পেটানো চেহারা, মাথা ভর্তি ঘন চুল আর ঝকঝকে হাসির বছর ছাব্বিশের অবিবাহিত কিষাণ কিন্তু মহল্লার সবার প্রিয়, বিশেষ করে মহিলাদের। ও জানে কোনো মহিলার সঙ্গে কীভাবে কথা বললে তার মন জয় করা যায়। শুধু গলির মাথায় পাকা মকানের এই শর্মা ভাবীর সঙ্গেই ও কোনোদিন ভাব জমাতে পারে নি। বড্ড গুমর। অপ্রয়োজনে একটা কথাও কখনো বলে না। যখনই দোকানে আসে নাক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে। কিন্তু ঐ ঘোমটার বাইরে লাল টুকটুকে ঠোঁট, রাজহাঁসের গলার মতো লম্বা দুই বাহু, ছোট কাঁচুলির নিচ থেকে কোমর পর্যন্ত মসৃণ গোলাপী দেহের অনাবৃত মধ্যভাগটি যখনই কিষাণের চোখে পড়ত, ওর শরীর যেন অসাড় হয়ে যেত। শর্মাজী মুম্বাইয়ে কন্ট্রাকটারীর কাজ করে, হাতে প্রচুর কাঁচা টাকা। কিন্তু ভাবীর যতই গুমর থাকুক, রোজ রাতে শর্মাজীর টলমল পায়ে বাড়ি ফেরা আর বউ পেটানোর কথা মহল্লার কারো অজানা নয়।
কিষাণ ঐ পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে চট করে দোকানের ছোট ফ্রিজটার ওপরে রাখা মিনারেল জলের বোতলগুলোর থেকে একটা তুলে নিয়ে ঢাকনা খুলে বলে, “প্যাহেলে পানি পিজিয়ে”।
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে শর্মাজীর বৌ সুগন্ধা গায়ের আঁচল সরিয়ে নিজের ডান হাত কাঁচুলির মধ্যে ঢুকিয়ে বের করে আনে কতগুলো ভাঁজ করে রাখা নোট। কিষাণের চোখে নিজের ভেজা ভেজা চোখ দুটো রেখে বলে, “অউর ভি হ্যায়। সব পাঁচশো কা নোট। অনেক কষ্টে জমা করছিলাম। কিছু টাকা জমলেই গাঁওয়ে পালিয়ে যাব। আর মারপিট সহ্য হচ্ছে না। লেকিন, একটু আগে টিভিতে দেখলাম আজ রাত বারোটার পরে সব ফালতু...”
কিষাণ কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রশ্ন করে, “শর্মাজী ঘরে ফেরে নি?”
“হ্যাঁ। মদ গিলে বেহুঁশ, তার কী এদিকে ধ্যান আছে! তাছাড়া, এসব টাকার কথা তো সে জানেও না!” সুগন্ধা যেন ফুঁপিয়ে ওঠে।
কিষাণ দোকানের দরজা ভেজিয়ে হুড়কো টেনে দেয়। তারপর ঠোঁটে ওর ভুবন ভোলানো হাসিটা ঝুলিয়ে ডান হাতটা দোকানের পেছনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “ম্যায় হুঁ না! প্যাহেলে আপ অন্দর তো আইয়ে!”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন