শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

অভিজিৎ মিত্র

পাঁচটা সতেরো


এখন ঘড়ি ধরে পাঁচটা সতেরো। বটু মাথা নামিয়ে শিয়ালদা চার-এ প্লাটফর্মে বসে আছে। এখানেই দেবে। রোজ এখানেই দেয়। ডিসেম্বর চব্বিশ। আজ বটুর শিয়ালদা আসার শেষদিন। নোটবন্দীর জেরে ওর চাকরিটা আজই গেল। এমন কিছু আহামরি কাজ নয়। একটা ছাপাখানার কম্পোজার। মাসে বড়জোর হাজার পাঁচেক। কিন্তু সেটাও আর নেই। আজ থেকে। মালিককে ও দোষ দিতে পারছে না। নভেম্বর আট তারিখের পর থেকে আর একটাও বইয়ের অর্ডার আসে নি। এবার বইমেলায় নতুন কোনো ছাপা আর থাকছে না। মালিক আজই ওদের দুজনকে ডিসেম্বরের পুরো মাইনে  ধরিয়ে বলে দিল।

ট্রেন ঢুকছে। এই পাঁচটা সতেরো ধরে বিগত সাত বছর বটুর যাতায়াত। সকালে আসার কোনো ঠিক নেই, কিন্তু বিকেলে এটাই। একটা গ্রুপ আছে, টোয়েন্টি-নাইন  খেলার। বাড়ি ফিরে রোজ ছোট্ট বাবলুর সঙ্গে খেলা। মায়ের হাঁটু নিয়ে সেই এক গল্প রোজ। তারপর লোপার সঙ্গে সংসারের খুঁটিনাটি কিনতে বেরোনো, মধ্যে কয়েক মিনিট গঙ্গার ধারে বসে মনখোলা হাসি। আজ এর কোনোটাই হবে না। আজ কাউকে সে  মুখ দেখাতে পারবে না।

ব্যাঙ্কে বাবার রেখে যাওয়া দু’লাখ আর ঘরে মা আর লোপা মিলিয়ে দুজনের চার ভরি সোনা – এটাই সম্বল। বাবলুকে এবছর স্কুলে ভর্তি করতে হবে, তিন বছর  হলো’মাস হয়ে গেল, লোপার একটা অপারেশন এখনো করা হয় নি টাকার অভাবে। নিজের ফাটা জুতোর দিকে তাকিয়ে বটু শুধু গান্ধীর চশমাটাই দেখতে পেল।

‘প্লাটফর্ম চার-এ আপ ডানকুনি লোকালের গার্ড, ট্রেন ছেড়ে দিন – আপনার সিগনাল দেওয়া আছে’। ট্রেন ছাড়ছে না। আজ প্রচুর লেট। হয়তো বটু উঠলে ছাড়বে, শেষবার। বটু এখনো প্লাটফর্মে। হাতে দুটো নতুন দু’হাজার আর একশ'র নোট। বটুর আশপাশটা দু’হাজারের গোলাপি আভায় ভরে উঠছে। কুয়াশাঘেরা সেই আভা ধীরে ধীরে আরো রহস্যময়। 

ট্রেন হর্ন দিয়ে ধীরে ধীরে ছেড়ে যাচ্ছে। বটু এখনো বসে। দু’হাজারের গোলাপি আলোয় বটু শেষবারের মতো শিয়ালদা দেখছে। বুঝতে পারছে না ওর এই ট্রেন ধরে  বাড়ি ফেরা উচিৎ নাকি কলেজ স্ট্রিটে আবার হাঁটতে হাঁটতে প্রত্যেকটা দোকানে...!
ব্যস্ত শিয়ালদার প্রত্যেক প্লাটফর্মে বটুরা চুপচাপ বসে আছেআর গোটা ষ্টেশনটা আস্তে আস্তে গোলাপি আলোয়... সবাই, এমনকি আলোও এই শীতঢাকা কুয়াশায় পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে...



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন