শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

সার্জিকাল স্ট্রাইক 

‘ওকে বলিস না, ও রাষ্ট্র করে বেড়াবে’ 

সুধীর এই বাক্যটা নিয়ে ভাবছিল। ভাবছিল কেন ‘রাষ্ট্র’ শব্দটাকে ‘সবাই’ অর্থে  ব্যবহার করা হয়? রাষ্ট্র মানে কি সবাই? রাষ্ট্র মানে কি সমাজ? দুই রাষ্ট্রের দ্বৈরথে মিডিয়া জুড়ে এখন যুদ্ধের মহড়া। সবাই সবার দেশপ্রেমের পরীক্ষা নিচ্ছে। পাশ করলে ভালো আর ফেল করলেই দ্বীপান্তর। গ্লোবাল মিডিয়া। পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকেই ডিজিটালি দেখা যায়। সুধীরও দেখছে ভিনদেশে বসে। দেখছে আর ভাবছে মাটির টান, একটা চেনা বাস্তবতার টান, ভাষার টান, একটা এলোমেলো জীবনের টান এইসব তাকে বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শ-স্বাদে যতই ভারতবর্ষের কাছে নিয়ে যাক, দেশপ্রেমিক হওয়া তার হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। দেশ মানে কি রাষ্ট্র? সবাই তো তাই বলছে! সবাই সারাক্ষণ সবাইকে পেড়ে ফেলছে। সোশ্যাল মিডিয়া খেউড়কে নতুন উচ্চতা দিয়েছে। সুধীরের সব থেকে যেটা মজা লাগছে সেটা হলো জিঙ্গইস্টরা দেশ-রাষ্ট্রের সংহতির কথা বলছে সার্জিকাল স্ট্রাইকের আস্ফালনের মাধ্যমে। সার্জারির ব্যবচ্ছেদ কবে সংহতির পতাকা হয়ে গেছে কেউ টের পায়নি। তো এই যুদ্ধবাজ পরিস্থিতিতে দেশের বাইরে বসে দেশের কথা ভাবতে গিয়ে সুধীরের তার ছোটবেলার প্রথম বন্ধু পাপ্পার কথা মনে হলো 

পাপ্পা ঝলমলে সাদা স্পিটজ। জন্ম থেকে দাদু দিদার বাড়িতে পাপ্পাকে দেখেছে। পাপ্পাকে সুধীর যাই বলে থাকুক না কেন, সে কখনো রাষ্ট্র করেনি। তার তো কোনো রাষ্ট্র  ছিলও না। ছিল কিরাস্তার কুকুরদের মুক্তাঞ্চল তাদের পাড়াপাপ্পার মুক্তাঞ্চল ছিল তার বাড়ি। ছোটবেলায় খাটের তলা আর জানালার বাইরের দিকের বাক্সসুলভ একেকটা চৌকোণায় অনেক নীরব সময় কেটেছে তার আর পাপ্পার। সে অনেক কিছু বলেছে পাপ্পাকে, পাপ্পা কিন্তু কখনো কাউকে সেসব সিক্রেট বলে দেয়নি। ১৯৯২এর ৬ই ডিসেম্বর যখন বাবরী মসজিদ ভেঙে ফেলা হচ্ছিল, তখন টিভিতে লাইভ  টেলিকাস্ট দেখতে দেখতে হঠাৎ তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করেছিল শান্তশিষ্ট মিষ্টি স্বভাবের পাপ্পা। সে কি কিছু বুঝতে পারছিল? সুধীরের চোখের তখন পলক পড়ছে না। সিনেমাতে দেখলেও অমন ‘মব’ ৭ বছরের সুধীর তার আগে রিয়ালিটিতে দেখেনি  কখনো। সেইদিনের পর থেকে পাপ্পা যেন খুব তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গেল। আগে যেমন সুধীরকে ছাড়া তার বাবা মা দাদু-দিদার কাছে এলে দরজা খোলামাত্র পাপ্পা নিচে গিয়ে সরোজমিনে তদন্ত করে আসত সুধীর বেসমেন্টে কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা। আস্তে আস্তে তা বন্ধ হয়ে গেলপাপ্পা কি রাষ্ট্রের একটা ছবি পেতে শুরু করেছিল? রাষ্ট্রের কি কোনো ছবি হয়

স্বদেশের বাল্য-স্মৃতিতে ছেদ দিয়ে সুধীর বাড়ি থেকে বেরোলো। বাজার না করলে রাতে রান্না করতে পারবে না। পায়ে চলা আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে এগোতে এগোতে পাশে একটা বাড়ির দরজা আসতে না আসতেই ভেতর থেকে কুকুরের হুঙ্কার। এই পথে যেতে যেতে এই হুঙ্কার শোনার অভ্যেস হয়ে গেছে। কুকুর নিজের বাড়ি পাহারা দেবে এটাই তো স্বভাবিক। সুধীর ভাবে, এই যে তার সারমেয়-প্রীতির কারণে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বাড়ির ভেতর থেকে কুকুরের এই সন্দিহান চিৎকারও ভালো লেগে যায় আর উল্টোদিকে কুকুরও তার ভালোবাসা, বাড়ির প্রতি আনুগত্য আর টান থেকেই তো বাড়ি মাথায় করছে! দরজা খুলে দিলে কে জানে হয়তো ছুটে বেরিয়ে  এসে কামড়ে ছিঁড়ে খাবে সুধীরকে। এ কি তবে কুকুরের দেশপ্রেম? রাষ্ট্রপ্রেম? নাকি শুধুই স্বগৃহপ্রেম? যদি কুকুরটা বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর, যদি তার মুখ থেকে, হাত থেকে, পেট থেকে খুবলে নেয় তাল তাল অতিরিক্ত মাংস, তখনও কি সুধীর অটল থাকবে তার কুকুরপ্রেমে? তখনও কি সে কুকুরের বিশ্বস্ত ভালোবাসার কথা ভাববে

কুকুরের চিৎকার বন্ধ হয়। সুধীর বাড়িটার গেট ছেড়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য: 

সুধীরের তখন বছর ১৫ বয়স হবে। পাপ্পা মারা গেছে। পাড়ার একপ্রান্তে মাটিতে কবর দেওয়া হচ্ছে। কবর যাতে চিনতে পারা যায় তার চারপাশটা ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। সুধীর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। 

কাট টু ফাইভ ইয়ার্স লেটার। 

সুধীর তখন কলেজে পড়ে। দাদু দিদা পাশের পাড়ায় ‘শিফ্ট’ করে গেছে। একদিন  কলেজ ফেরত এসে নতুন বাড়িতে ঢোকার আগে সুধীর পাশের পাড়ায় যায়। পাঁচ বছর অনেকটা সময়। ঝোপঝাড়ে জঙ্গল হয়ে ওঠা ঐ জায়গাটায় কিছুতেই পাপ্পার কবরটা কোথায় বুঝে উঠতে পারে না। খালি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। 

আজ বাজার করে ফেরার পথে আবার ঐ বাড়িটার সামনে দিয়ে ফেরার সময় কুকুরের গর্জন শুনতে পায় সুধীর। যাতায়াতের পথে আজ এই দ্বিতীয় হুঙ্কার। যেদিন পাপ্পার কবরটা হারিয়ে গিয়েছিল ঝোপঝাড়ে, সেইদিনই প্রথম বর্ডার ব্যাপারটা কি অনুভব করেছিল সুধীর। রাগ হয়েছিল দেশের মাটির ওপর যে প্রিয়জনের কবর মুছে দেয়। আজ দাদু দিদা পাপ্পা কেউ বেঁচে নেই। বাক্যের প্রতিটি বিশেষ্য পদে মৃত্যুর বাস। প্রিয়জনের স্মৃতি এবং স্মৃতি মুছে দেওয়া ঐ নির্মম মাটি তার দৃশ্য-দেশ। তার ভারতবর্ষ, যা সমাজও নয়, রাষ্ট্রও নয়। ব্যক্তিহীন ব্যক্তি-স্মৃতি। সুধীর শুধু ঐ মাটির সঙ্গে কথা বলে গেছে এতগুলো বছর। মাটি ধরে রেখেছে, মুছে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে, ছেড়ে দিয়েছে। সুধীর ভাবে একদিন গিয়ে সে ঠিক খুঁজে বার করবে ১৫ বছরের পুরনো সেই কবর। সেইদিন হয়তো সীমান্ত বরাবর সিজ ফায়ার ভায়োলেশন তুঙ্গে উঠবে। 

‘ও নিজেকে বলবে না যাতে রাষ্ট্র না হয়ে ওঠে’  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন