শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

অরুণেশের অরুণেশগুলো (১)


ক) এমন এক সমাধিক্ষেত্রের শহরে ব’সে অরুণেশ স্মৃতিতর্পণ করছে যেখানে তার কোনও মেমোরিয়্যা টেকনিকা নেই।
খ) আলোক সংবেদী এই শহরে হিমায়ন সম্পন্ন হয়েছে (পুনরায় একে আর জীবিতের বাসযোগ্য রূপে বহাল করা যাবে না)
গ) পৃথিবীর তলার পাথর-সীমান্ত থেকে উঠে আসা কবর-পোকাদের নিয়ত আক্রমণে আরও রোগগ্রস্ত হবে এর জল ও বায়ু।
ঘ) জলাধার এবং তার পাশের ঘাস থেকে যে আলো, তাপ এবং শব্দ প্রতিফলিত হয় তা আলোকরশ্মির গতিপথের সরলরেখা থেকে বিচ্যুত হয়েছে, কবেই।
ঙ) জীবনের মৌলিক শর্ত ও নীতিগুলো এখানে যে উদ্ভট অবাস্তব ফিল্ম-রিলে পরিণত হয়েছে, যাকে অরুণেশ বলে, রিডাকসিও-অ্যাড-অ্যাবসারডাম।
চ) মাটি থেকে অত্যন্ত কম উচ্চতায় মেঘ এই শহরে এমনভাবে ঢেকে থাকছে, ঠিক শুয়োরের মাংসের ওপর যে শক্ত স্তর
ছ) অরুণেশ এবং এই শহরের কোনও অতীত নেই। ইতিহাস আছে। (অতীত, কুয়োর জলে প’ড়ে যাওয়া এক ইঁদুর। কুয়োর গোলাকার পাঁচিলে যে চক্রাকারে বন্‌বন্‌ ঘুরেই চলেছে। ইতিহাস, প্রসারণশীল। অতীতের রয়েছে রিজিডিটি। ইতিহাসের ইলাস্টিসিটি। ব্যক্তির অতীত হয়। পরিবারের, শহরের, দেশের, সভ্যতার হয় ইতিহাস।)
জ) কবর এবং এই শহরের মাঝখানে এখন শুধু রয়েছে অরুণেশ, একটা রিভেটের মতো।
ঝ) প্রতিদিন এর লয় ক্রম মন্থরায়িত হচ্ছে।
ঞ) অরুণেশের পা ও ফুসফুসের গতি চলাচলও শ্লথ হচ্ছে ক্রমশ।
ট) এবং ক্রমশ, সে, এপিসিন হয়ে পড়ছে। তার স্ত্রীঅঙ্গগুলি আরও প্রকাশ্য হ’লে ধীরে ধীরে সে নারীর ভূমিকায় অভিনয়ে দক্ষ একজন পুরুষ অভিনেতা হয়ে উঠবে, উঠতে পারবে, এমন আশা করে।
ঠ) যে কোনও অঙ্গ-গ্রন্থির যেমন একটা মূল অংশ থাকে, আসল যে পদার্থটা, যাকে প্যারেনকাইম্যা বলা হয়, এই শহরের প্যারেনকাইম্যা এখন অরুণেশ, ধারণ ক’রে আছে।
ড) অধর আর ওষ্ঠের ডান দিকের সন্ধিস্থলে একটা ফুসকুরি হয়েছে। মুখ বড় ক’রে হাঁ করা যায় না। জিভ ডান দিকে তেরছা বাঁকিয়ে সেটাতে আলতো ছোঁয়ায়। এতে তার ঠোঁট ও জিভ ইংরেজি Q আকৃতির দেখতে হয়।
ঢ) অর্থাৎ, আমরা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছি।



অরুণেশের অরুণেশগুলো (২)

টাঙানো মশারির একটা দড়ি খুলে নিলে যা হয় - শূন্যের ওপর নির্মিত ঝুলন্ত ত্রিভুজ। বিছানায় - সেই ত্রিভুজের ক্ষেত্রফলের বাইরে ব’সে আছে অরুণেশ। না, অরুণেশ নয় - অরুণেশের অরুণেশগুলো। তার ঘাড়, চোখ, খুলি, কনুই, হাঁটু, গোড়ালি, কব্জি, কোমর, নিতম্ব, ঊরু, লিঙ্গ, পায়ু, পাঁজর, পিঠ সবকিছু গয়নার মতো খুলে রেখেছে সে, বিছানায়। মশারির যে দড়িটা খোলা - সেদিকের পেরেকে, দেওয়ালে, মৃত দাঁড়াশ সাপের মতো, বিষহীন ঝুলছে - অরুণেশের মেরুদণ্ড।

অন্ধকার রাতে স্টেশন ইয়ার্ড থেকে অনেক দূরে যেমন শূন্য এক জঙ্গলের ভেতর থমকে থাকে মালবাহী ট্রেন; চোখের নিচে (যেন পুকুরের পাড় ঘেঁষে অল্প মাটি কেটে নিয়েছে কেউ), সেখানে সততই মানুষের কিছু অন্ধকার দৃশ্যমান, থমকে থাকে; চোখের এলাকা থেকে নেমে তারা এই ঘরে এলোমেলো উড়ছে। এলোমেলো। এখানে-সেখানে। বিছানায় অরুণেশগুলো এত সুবিন্যস্ত ধারায় সাজানো - দেখে মনে হয়, এক গরবিনী সধবা তার গয়নার বাক্স উপুড় ক’রে - একে-একে শাঁখা, নোয়া, পলা, কানপাশা, নথ, পৈঁছে, খাড়ু, জশম, তাসা, মাকড়ী, আঙোট, মল, নূপুর, বালা, টিকলি, বাজু, কঙ্কন, বাউটি, সাতনরী, চন্দ্রহার, অঙ্গুলীয়ক, জড়োয়া গয়না সব বিছিয়ে রেখেছে - দেখে দেখে যেন তার আঁখি না ফেরে - যত দ্যাখে ততই দ্যাখে। গরম রুটির ওপর পাতলা আরেকটা রুটির যে আবরণ তৈরি হয় - মাংস থেকে স’রে সেইভাবে চামড়া ফেঁপে উঠেছিল অরুণেশের। সেটাই বিছিয়ে রেখেছে, বিছানায়। তারই ওপর পরপর সাজানো অরুণেশের অরুণেশগুলো। রত্নপাথরের মতো। চামড়ার চাদর থেকে মাঝেমাঝে শুধু জিভটা ওড়ার চেষ্টা করে, ফরফর ক’রে। ডানায় চোট পাওয়া প্রজাপতি যেমন। লিঙ্গ আর অণ্ডকোষ দু’টি দোকানের দরজায় ঝোলা লেবু-লঙ্কার মতো যৌনতাহীন।

অরুণেশ তার অরুণেশগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবে - আরও একদিন সে এভাবে খুলে রাখবে নিজের ব্যাভিচার ও সৌন্দর্য। খুলে দেখবে তার সামরিক স্পর্ধা। গরবিনী বধূর গয়নার মতো নয়। যুদ্ধের রাতে তাঁবুর ভেতর সৈনিক যেভাবে গ্রেনেড ও বিবিধ আগ্নেয়াস্ত্র দ্যাখেকিংবা, নতুন বস্তিতে এসে উদ্বাস্তু সংসার - উঠোনে যেভাবে হাহাকার ক’রে ছড়িয়ে রাখে - শোকাকুল ঘটি, থালা, বাটি, গেলাস, হাঁড়ি, ট্রাঙ্ক, তোরঙ্গ, তোষক, পাতলা বালিশ, পানের ডিবে, সাবান ও খেলনা বাঁশি সরসর আওয়াজ হবে শরীরের ঝোপেঝাড়ে। মাটিতে লেজ আছড়াবে জ্যান্ত দাঁড়াশ।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন