শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

তমাল রায়

কবিতার জন্ম


সন্ধ্যার অশান্ত দোলাচলে আপাতত সারি সারি পক্ষীকূল ঢেকে দিচ্ছে রাঙা সূর্যকে সাক্ষী পাহাড় ভাঙা গড়াই যার আজন্ম অভিজ্ঞান পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেছে নদী, ছোট পাহাড়ি নদী যেমন হয় পাথরে ধাক্কা মারতে মারতে এগিয়ে চলেছে, ক্ষীণ গতি, কিন্তু জীবন্ত সমতলে সেই হয়তো জনপদ গড়েছিল কখনো, আজ যা টিম টিম করে জ্বলে নদী আর পাহাড়ের মাঝে কাঁটাতার বিভাজনই সত্য, সত্য জলপাই বারুদগন্ধী সন্ত্রাস কিছু দূরে যেখানে বক উড়ে এসে বসছে শস্য ক্ষেতে, সেখানে দাঁড়িয়ে লোকটা, একক, কিন্তু স্থির তাকিয়ে আছেন দূরে...

মাথায় জ্বলে উঠছে আখর, বিস্মৃতি, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে পরক্ষণেই উত্তরের জনপদ থেকে অঞ্চল বড়জোর পঁয়তাল্লিশ কী পঞ্চাশ কিমি তবু এতদ তল্লাটে  কিছু  প্রান্তিক জীবন, নিতান্তই দিন আনি দিন খাই-এর উপাচারে, স্রেফ বেঁচেই আছে

পুরনো টাউনে কখনো ট্রেন যেত চঞ্চল থাকত বিকি কিনিতে লোকজন, হৈ হট্টগোল, পালা, পার্বন এবং মৃত্যু তথাগত বলতেন,তুমি যা হতে চাও, তুমি তাই হয়ে উঠবে টাউন মানে তো কোনো ভূখন্ড নয়, সেখানকার মানুষ তারা কি মৃত্যুই চেয়েছিল জনপদের? প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে মাথায় ঘোরে, তিনি কখনো আকাশ দেখেন, কখনো নদী, দূরের পাহাড় রাঙা করা সূর্যাস্ত আর অক্ষরমালায় ডুবে যাচ্ছেন তিনি, বাস্তবে লিখছেন না কিছুই হয়তো মাথাই তা লেখার খাতা সেই যেবার খুব  বন্যা হলো, ভেসে যাচ্ছে সব, একা নদীতীরের কাছে এক পরিত্যক্ত ঘরে তিন রাত জেগে প্রত্যক্ষ করেছিলেন নদীর ভয়াবহ রূপ যা বিপজ্জনক তার মধ্যেও লুক্কায়িত থাকে এক অপরূপ সৌন্দর্য!

প্রকৃত জ্ঞান মানুষকে বিনম্র করে, এই শিক্ষায়, যে বিপুল জ্ঞান ভান্ডারের খুব সামান্যই তুমি জানো অহমিকা প্রদর্শন পাপ

মাঠের ধারে  রাখা একটা সাইকেল হলুদ রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে মাঠ দুটো শূন্য গোলপোস্ট খেলা নেই, খেলার ছেলেরা নেই, মাঠ আছে, আর তিনি এতক্ষণ শুয়ে ছিলেন হাত পা ছড়িয়ে, দিন আগেও অলীক আসত, নীলু, পিংকু পাশে বসে বলত, আজ কি লিখলে, শোনাও ওরা সব শহরে চলে গেছে, গ্রামগুলো যেভাবে শহর গিলে খায় এখন তিনি উঠবেন হেঁটে যাবেন ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বুক খোলা হাওয়াই শার্ট গুন গু করে সুর ভাঁজছেন-আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ... আদতে এক মৃত নগর, সবআছেগুলো কেমন করেছিল হয়ে যায় অজান্তেই

সার সার বন্ধ দরজা জানালাকে দুপাশে রেখে তিনি হেঁটে চলেছেন চাএর দোকানে, ওখানেই আসবে বিশাখ, অমররা আর তারপর ধোঁয়া ওঠা কাপ আর জমে যাওয়া তর্কগুলো কেমন উষ্ণ করে দেবে শীতের দুপুরগুলো বিশাখ, সমর আসত আর আসে না চা দোকানটা আছে যেমন থেকে যায় মৃতের খাট, বালিশ বিছানা কার্তিক চা বানাতে বানাতে তাকিয়ে দেখে তাকে মুখে হাসি আনমনে কীসব বিড় বিড় করে যাচ্ছে
- দাদা, খেতে যাবেন না?
- না
- খিদে পায় না?
- নারে!  
খাবে কি, টাকা কই? কার্তিক পাশের লোকটাকে চা দিতে দিতে বলে, কত বড় বাড়ির ছেলে, কী হাল!
সন্ধ্যে নামার আগে উঠে পড়েন তিনি যা অল্পকিছু আয়, সে তো ট্যুইশন পড়িয়েই অতএব পা চালাতে হয় সূর্যাস্তের সময়... জয়ন্তী পাড়া দিয়ে হেঁটে চলেছেন, দুনম্বর  গুমটির পাশ দিয়ে রেললাইন টপকে ওপারে পথে বসতবাড়ি আগে ছিল, এখন নেই এবার তিনি অন্যদিকে তাকালেন, উদাসীনতা কখনো গুরুত্বেরই পরিপূরক পাখিরা ফিরে চলেছে বাসায় তিনি?

পড়ে যাওয়ায় কোনো গরিমা নেই প্রতিটি পতন শেষে যখন উঠে দাঁড়াও, তা গর্বের শহুরে কাটাকুটি খেলায় তিনি বারবার হেরেছেন বাঘবন্দী খেলায় বন্দী  তিনিই আপাতত নদীর মিহি তরঙ্গের সামনে তিনি নিচু হয়ে কী যেন করছেন দূর  থেকে দেখে মনে হয় মাছ ধরছেন না, নদীর  ভাষা আছে, ছন্দ বিভিন্নতার বিস্তার তিনি তা বোঝার চেষ্টায় নদীর ওপারে অবিন্যস্ত পদচারণায় মৃত মা কিছু অস্পষ্ট, কিন্তু হাসলে এই ম্রিয়মাণ আলোতেও বেশ বোঝা যায় তা গজদাঁত মা  ডাকছেন তাকে তার মুখে  শিশুর সারল্যময় হাসি শৈশব আসলে, সকালগুলো ভোরের পাখি তো উড়ে আসে আচমকা কিছু সরে গেলেন তিনি নদীর জলে  তা নয় অন্য কার যেন ছায়া চমকে তাকাতেই দেখেন বাবা কপালে ভাঁজ, সরে যাবার চেষ্টা মাত্রই, তীর্যক হাসি বাবার মুখে আজীবন বাবার ছায়া থেকে সরেই থাকতে চেয়েছেন পেরেছেন কিনা জানি না তবু তো চেষ্টাই মাথা ঘুরছে টলে যাচ্ছে শরীর জল থেকে উঠে আসলো ভুলুস্যর -কিহে বলেছিলাম না! কবিতা হলো তোমার জীবন তোমার দহন শেষে, যতটা ছাই পরে আছে, সে তোমার কবিতাই 
মুখ দিয়ে অস্পষ্ট উচ্চারণে বেরিয়ে এলো স্যার... স্যর কই? শ্রীতমা শ্রীতমার কোলে এক ফুটফুটে সন্তান শ্রীতমা তার স্ত্রী কখনো একলা পথে হাঁটতে হাঁটতেই দেখা হয়ে গেছিলো, দুটো পথের, যেমন হয় তারপর আবার সব আলাদা বাচ্চাটা কি তাঁরই? তিনি যত এগোতে লাগলেন শ্রীতমা দূরে সরে... এবার পড়ে গেলেন তিনি, টাল সামলাতে না পেরে এখন অন্ধকার, চারদিক আর তিনি উঠে দাঁড়াচ্ছেন, হাতড়ে হাতড়ে গা কুয়াশা নেমেছে নদীর ধারে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে এক ছায়ামূর্তিকে... যিনি অবিন্যস্ত পায়ে, ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কি যেন খুঁজছেন...

জীবন জীবিতর আঘ্রাণ, মৃত্যু মৃতের, মাঝে বেঁচে থাকা, হয়তো বিস্তৃত সঙ্গীতের মাঝে  তুমিই হয়তো সে অশ্রুত সুর, যে কবিতা হয়ে উঠছ ক্রমশ...
রাতের একটা আলো থাকে, যা একক সন্ধানী নদী যে জনপদ গড়েছিল কখনো, তাকে কি করে যেন পেরিয়ে গেছেন কাঁটাতার পেরোতে মাড়িয়ে যেতে হয় বিভাজন, জলপাই বারুদী সন্ত্রাস এবার পাহাড় অরণ্য ভাঙা-গড়াই যার অভিজ্ঞান, আদিমতাই যেখানে ইতিহাস, এবার তার ভেতর সেঁধিয়ে গেলেন মানুষটা দূরে ওপারে দেখা যাচ্ছে, একটি সাইকেল নদীর জল ধুয়ে দিচ্ছে তার চাকা ওপারের গা কৃষ্ণবৎ শ্যামলিমায় তিনি মিশে যাচ্ছেন, জলপাই স্যাংচুয়ারিতে, তিন-দুই-এক
লোকটা দু: পান করত, গেয়ে উঠত রবি ঠাকুরের গান, একক ছিলেন, একক
কিছু পর মেঘ মুক্ত আকাশে চন্দ্রমা চাঁদ হাজির হলো এবার জন্ম নেবে কবিতা  





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন